ইলেকট্রন (Electron) জিনিসটা কী, তা আমরা অনেকেই জানি। পদার্থের সবচেয়ে ছোট অংশ হল পরমাণু, যার মধ্যে ওর সব ধর্ম বা গুণ বজায় থাকে; আর এই পরমাণুর মূল উপাদান তিন ধরনের : ইলেকট্রন (Electron), প্রোটন আর নিউট্রন। ইলেকট্রন নেগেটিভ বা ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট, প্রোটন ধনাত্মক বা পজিটিভ চার্জবিশিষ্ট, আর নিউট্রনদের কোনও চার্জ নেই। তা এই ইলেকট্রন ঠিক কতটা ছোট?
এমনিতে খালি চোখে এই ক্ষুদ্র এবং হালকা কণাদের দেখতে পাওয়ার কোনও উপায় নেই। উপায় নেই কোনও যন্ত্রের মধ্যে দিয়েও সরাসরি দেখবার। তবে বিজ্ঞানীরা এমন কিছু ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারেন, যার ফলে অন্যভাবে দেখে নেওয়া যায় এই ধরনের কণাদের।
এই ইলেকট্রনেরা (Electron) আবার বেশ কিছু ঘটনার জন্য মূল দায়ী। যেমন তড়িৎ প্রবাহের ফলে আলো জ্বলে ওঠা, টিভি চলা, রেডিওর বাজনা বা নানান চৌম্বকীয় ঘটনা— এ-সবই আসলে ইলেকট্রনদের কীর্তি। ওই ধরনের ঘটনাও যেমন ইলেকট্রনের জন্যে ঘটে, তেমনই আবার বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্যেও দায়ী এই ক্ষুদ্র কণারা। আর এই ইলেকট্রনদেরই (Electron) নানান বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটা হল এদের গতি। আমরা তো জানিই যে পরমাণুর মধ্যে কেন্দ্রে থাকা ভারী নিউক্লিয়াসের চারপাশে দুরন্ত গতিতে পাক খায় ইলেকট্রনেরা। তা, ওদের দেখবার উপায় তাহলে কী?
হ্যাঁ, সেরকমই একটা উপায় আলোচনায় এসেছে সম্প্রতি। আর এই উপায়ের আবিষ্কর্তাদেরকেই বেছে নেওয়া হয়েছে এই গ্রহের সবচেয়ে বড় পুরস্কার দেওয়ার জন্য।
নোবেল-তালিকার বিজ্ঞানীরা
এই বছরের বিভিন্ন বিষয়ে নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের নাম ঘোষিত হয়েছে সম্প্রতি। তাঁদের নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ইতিমধ্যেই আলোচনা হয়েছে, তাঁদের নাম বা কাজের কথার সঙ্গে আমরা পরিচিতও হয়েছি। পদার্থবিদ্যায় এবারের নোবেল পেয়েছেন তিনজন বিজ্ঞানী— পিয়ের অ্যাগস্টিনি (Pierre Agostini, ইনি আমেরিকার ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক), ফেরেঙ্ক ক্রাউৎজ (Ferenc Krausz, ইনি জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অভ কোয়ান্টাম অপটিক্স-এর বিজ্ঞানী) এবং অ্যানি এল’হুইলিয়ার (Anne L’Huillier, ইনি সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী)। এঁদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড় পিয়ের, তিনি বিরাশি বছরের। আর অ্যানি হলেন নোবেল-ইতিহাসে পঞ্চম মহিলা যিনি পদার্থবিদ্যায় এই পুরস্কার পেলেন।
এই বিজ্ঞানী দলের কৃতিত্ব, এঁরা অত্যন্ত ক্ষুদ্র সময়ব্যাপী কিছু আলোকীয় পালস বা ঝলক তৈরি করতে পেরেছেন লেজারের সাহায্যে। অত্যন্ত ক্ষুদ্র বলতে ঠিক কতটা সেটা আমরা একটু বাদেই বলব। আর আলোর পালস জিনিসটা বোঝার জন্য ওটাকে ভাবা যেতে পারে খুব কম সময়ের জন্য জ্বলে ওঠা আলোর ঝলকানিকে। টর্চের আলো জ্বেলে সঙ্গে সঙ্গে নিভিয়ে দিলে যে সময়টুকু আলোটা গিয়ে দেওয়ালে পড়ে, সেইটাকেই একটা আলোর পালস ভাবা যেতে পারে। আর ওঁদের এই আলোর পালসের সময়সীমা জানলে চোখ আকাশে উঠবে। সেটার সময়সীমা মাত্রই এক অ্যাটো সেকেন্ড। এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক ভাগকে বলি আমরা এক মিলিসেকেন্ড, আর এইভাবেই যদি এমন আলোর ঝলক তৈরি করা যায় যেটা জ্বলবে মাত্র এক সেকেন্ডের একশো কোটি ভাগের একশো কোটি ভাগের এক ভাগ, সেইটাই হবে এক অ্যাটো সেকেন্ড আলোর ঝলক!
বিগ ব্যাং নামে এক বিস্ফোরণের ফলে আমাদের এই মহাবিশ্বের জন্ম। সেই ঘটনা ঘটেছিল আজ থেকে তেরোশো কোটি বছর আগে। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত যত সেকেন্ড সময় অতিবাহিত হয়েছে, এক সেকেন্ডের মধ্যে অতগুলো অ্যাটো সেকেন্ড রয়েছে!
পারমাণবিক স্তরের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে ইলেকট্রনের যতটুকু সময় মুখ দেখা যায়, মানে যেটুকু সময় ও উঁকি দেয় গতিশীল থাকতে-থাকতে, সেইটুকু সময়ের মধ্যেই ওর ছবি তোলা গিয়েছে ওঁদের এই বিশেষ আলোর সাহায্যে। আর সেই কাজের স্বীকৃতিতেই এই নোবেল। যার অর্থমূল্য ১.১ সুইডিশ ক্রোনার, ভারতীয় মূল্যে যা আট কোটি টাকার কিছু বেশি।
এই তিন জনের মধ্যে অ্যাগাস্টিনি বেশ কয়েক বছর আগে, ২০০১ সালে খুব ক্ষুদ্র আলোর ঝলক বা পালস তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর ওই সময়কার পরীক্ষায় তৈরি হওয়া আলোর ঝলকগুলো আড়াইশো অ্যাটো সেকেন্ড সময়কাল স্থায়ী হয়েছিল আর ওটাই ছিল ওই সময়ের সাপেক্ষে সবচেয়ে কম সময়ের আলোর ঝলক তৈরির কাজ। প্রায় একই সময় ক্রাউৎজও আলাদাভাবে প্রায় ওই একই সময়কালের আলোর ঝলক তৈরি করেন, পরে এই দুটো পদ্ধতির মেলামেশার মধ্যে দিয়ে আরও-আরও কম সময়ব্যাপী আলোর ঝলক তৈরির কাজ এগোতে থাকে।
আরও পড়ুন- পণবন্দি জার্মান তরুণী হামাসের হাতে প্রাণ দিলেন
আলোর ঝলক তৈরি করে কী লাভ?
কিন্তু এইবারে অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এত কম সময়কাল ধরে স্থায়ী হওয়া আলোর ঝলক আমাদের কী কাজে লাগবে? বা আগামী দিনে আদৌ কোনও কাজে লাগবে কি?
এর উত্তরে বলতে হয় যে হ্যাঁ, অবশ্যই কাজে আসবে। সেরকম কয়েকটা প্রয়োগের কথা বলে এ আলোচনায় ইতি টানব আমরা।
প্রথমত, ইলেকট্রনিকস জিনিসটা আগামী দিনে যে আরও বেশি দ্রুতগতির অর্থাৎ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে চলেছে, তাতে এই প্রযুক্তির বড় ভূমিকা থাকবে। ‘আলট্রা ফাস্ট-সুইচিং’ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আরও বেশি কর্মক্ষম হয়ে উঠবে, সেই সঙ্গে দ্বিতীয় যেটা ঘটবে, তা হল চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটা নতুন দিগন্ত খুলে যেতে পারে। রক্তের কোনও নমুনাকে অতি ক্ষুদ্র সময়ব্যাপী আলোর ঝলক দিয়ে যদি পরীক্ষা করে দেখা যায় তাহলে ওই নমুনার মধ্যেকার ইলেকট্রনের গতি কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, সেই অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিবর্তনকেও মেপে নেওয়া যাবে। এবং সেই অনুসারে চিকিৎসা বা রোগ নির্ণয় করতে পারা যাবে। বিশেষ করে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে ক্যান্সারের চিকিৎসায় এই আবিষ্কার বড় ভূমিকা নিতে চলেছে। তৃতীয়ত, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ব্যবস্থায় এই ধরনের পালস বড় সাহায্য করবে। সব মিলিয়ে আগামী দিনে ডিজিটাল তথ্য সঞ্চয় বা তথ্যের আদানপ্রদানে আরও বড় যে ঝড় আসতে চলেছে, তাতে এই ধরনের ক্ষুদ্র বস্তুর অন্দরমহলে সেঁধিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াগুলো যে কতটা যুগান্ত ঘটিয়ে ফেলবে, তার দিকচিহ্ন মেপে ওঠাই মুশকিল।