বাজির দূষণ

Must read

বাতাসে বাজির বিষ-বাষ্প একদম নয়। বাজির দূষণের নানা দিক নিয়ে বললেন রাতুল দত্ত

রুদ্রজার মনখারাপ এবার অনেকটাই কম। একটু বড় হয়েছে। ফুলঝুরি, ফানুস, ডলফিন ড্রাইভ, রংমশাল, তুবড়ি, চরকি, রকেট— এরকম অনেক নতুন নতুন শব্দ শিখেছে মা পত্রলেখার কাছ থেকে। তবে কী একটা ভাইরাস না কী সব এসেছে! সবাই বলে করোনা। কতদিন ধরে স্কুল বন্ধ, বাইরে বেরনো বন্ধ, টিউশন বন্ধ, নাচের ক্লাস বন্ধ, রোল-চাউমিন খাওয়া বন্ধ। তাই এই দীপাবলিতে একটু আনন্দ করবে ভেবেছিল। বাবাকে বলেছে, আমায় এবার হরেকরকম বাজি কিনে দেবে? বাবার পাকানো চোখ দেখে আর সাহস হচ্ছে না কিছু বলার। আসলে, করোনা ভাইরাস তো শ্বাসপথ আর ফুসফুস দুটোকেই আগে আক্রমণ করে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বাজির বিষ বাতাসে মিশে সুস্থ মানুষদেরই অসুস্থ করে তোলে। করোনা রোগীদের তা হলে কী হবে এই দীপাবলিতে! তাই এবার আইন করে সব বন্ধ। এ-সব কথা মা-বাবা বলেছেন রুদ্রজাকে।
শব্দবাজির দাপটে
শব্দের তীব্রতা অর্থাৎ শব্দ কতটা জোরে হচ্ছে তা মাপা হয় ডেসিবেল একক দিয়ে। ৮৫ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ আমরা সহ্য করতে পারি। শব্দবাজি, তা ৮০ ডেসিবেলের বেশি তীব্র হলে, কোর্টের নির্দেশে তা নিষিদ্ধ বাজি। এর বেশি হলে দেহের নানা ক্ষতি হয়। যার মধ্যে আছে ধীরে ধীরে শ্রবণক্ষমতা কমে যাওয়া, হার্টের গতি ও রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়া, নানা মানসিক বৈকল্য, স্নায়ু রোগ ইত্যাদি। ১৬০-এর বেশি শব্দ কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়। বাজির শব্দ থেকে কানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। কানের পর্দা সরাসরি ফেটে যেতে পারে। কানে সাময়িক বধিরতা দেখা দিতে পারে, অন্তঃকর্ণের স্নায়ু চোট পাওয়ার জন্য। বাবার কাছ থেকে এ-সব মন দিয়ে শুনেছে রুদ্রজা।

আরও পড়ুন-বাজির দূষণ

চোখ আর ত্বকের ক্ষতি
বাজি থেকে চোখেরও ক্ষতি হয়। আগুনের ফুলকি, সালফারের গুঁড়ো চোখে এসে পড়তে পারে। অনেক সময় বাজির আগুনের ফুলকিতে চোখের কর্নিয়া পুড়ে যেতে পারে। আলোর বাজি, অনেক সময় সোজা চোখে এসে পড়তে পারে। আগুন ধরানোর সময় অনেক বাজি দড়াম করে চোখের ওপরেই ফেটে যেতে পারে। ফল? চোখ নষ্ট! বাজি পোড়ানো মানেই তো আগুন নিয়ে খেলা।
বাজির বিষ কীভাবে ছড়ায়
বিপদ শুধু শব্দবাজিতেই নয়, লাল-নীল, হলুদ-সবুজ— চোখধাঁধানো সবরকম আলোর বাজিতেও রয়েছে বিষ। অধিকাংশ বাজিতেই কমবেশি সীসা থাকেই। বাজিতে থাকে চারকোল, পটাশিয়াম নাইট্রেট বা সোরা এবং সালফারের গুঁড়ো বা গন্ধকের মিশেল। নানা রং তৈরির জন্য বাজির মশলায় মেশানো হয় একাধিক ধাতু (লাল রঙের জন্য স্ট্রনিয়াম, সাদার জন্য অ্যালুমিনিয়াম, নীলচে রঙের জন্য কপার সল্ট বা কপার নাইট্রেট, কমলা রঙের জন্য ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, হলুদ রঙের জন্য সোডিয়াম অথবা লোহাচুর)। ফাটার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়ায় তৈরি হয় কার্বন ডাইঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড। যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করলে শ্বাসনালির জ্বালাপোড়া, ফুলে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেসব ধাতব পদার্থ বেরোয় বাজির সঙ্গে, সেগুলি শরীরে বেশি মাত্রায় প্রবেশের ফলে মাথাধরা, গা-বমি, শ্বাসকষ্ট, মাথার যন্ত্রণার মতো সাময়িক সমস্যা তৈরি করে। বেশিক্ষণ ধরে বাজি ফাটানো হলে চোখের জ্বালা-পোড়া, এমনকী চোখকে সুস্থ রাখার জন্য চোখের যে গবলেট সেলগুলি জল তৈরি করে, সেই কোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকলে অনেক সময় রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে সালফিউরিক অ্যাসিডের মতো রায়ায়নিক পদার্থ তৈরি হয়। যেসব বাজি পুড়লে সাদা আলো হয়, তাতে সাধারণত অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যাডমিয়াম বা টাইনেনিয়ামের যৌগ থাকে। কমলা আলোয় ব্যবহার করা হয় লোহা ও বিভিন্ন ধরনের কার্বনেট যৌগ, হলুদ আলোর জন্য সোডিয়াম, নীল আলোর জন্য তামা, লাল আলোর জন্য স্ট্রোনসিয়াম যৌগ, সবুজ আলোর জন্য বেরিয়াম নাইট্রেট, বেরিয়াম ক্লোরাইডের মতো যৌগ।

আরও পড়ুন-রাতের ত্রিপুরায় আক্রান্ত সংহিতা, বিজেপির হার্মাদরা হাত ভেঙে দিল মহিলা তৃণমূল প্রার্থীর

বিষ-বাষ্পে শ্বাসকষ্ট
এর উপরে বাজি থেকে নির্গত বালি, ধুলো, সিলিকন সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ), হাঁপানির রোগীদের সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে। কোভিড-আবহে তাই সতর্কবার্তা মেনে চলা বাধ্যতামূলক। কারণ, কোভিডে দেহের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলেও মূলত এটি শ্বাসতন্ত্রের অসুখ। ফুসফুসের রক্তবাহী নালিতে রক্ত জমাট বেঁধে সমস্যা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি পোস্ট কোভিড ফাইব্রোসিস’ও রয়েছে। গুরুতর আক্রান্তদের মধ্যে একাংশের ফুসফুসের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা শেষ করে দিচ্ছে কোভিড। অল্প পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা এমন রোগীও রয়েছেন। অনেকেই আছেন, দীর্ঘদিন একমোর সাহায্যে বেঁচে ছিলেন। বাজির ধোঁয়া তাঁদের কাছে দমবন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি করবে। কোভিড যে অনেককে দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভোগাচ্ছে, তা ভুললে চলবে না।
ধোঁয়ার বাজিতে শিশুদের সমস্যা
কালীপুজোর সময় যেভাবে বাজি পোড়ানো হয়, তাতে শিশুর ফুসফুসে সমস্যা হতে পারে। কিংবা যে-সমস্ত বাচ্চার ঠান্ডা লাগার ধাত রয়েছে, বাজির বিষাক্ত ধোঁয়া সেই বিপদ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
রুদ্রজা, তুমি তো লক্ষ্মী মেয়ে। এত কিছু জানার পর এ-বছর তো একদম আর বাজি পোড়াবে না নিশ্চয়। বায়নাও করবে না। বাজিহীন অলোকময় দীপাবলি উদ্যাপন করবে এবার। বন্ধুদের, বাড়ির, পাড়ার সকলকে বলবে, কোনও বাজি না পোড়াতে। তাতে সকলেই ভাল থাকবে। আগামী বছর করোনা বিদায় নিলে বন্ধুদের নিয়ে না হয় শুধু আলোর বাজি ফাটিও। এবার কোনও বাজি নয়, শুধুই আলোর উৎসব। কেমন?
কীসে কী ক্ষতি
● নাইট্রেট যৌগ : মানসিক অস্থিরতা ও মানসিক ব্যাধি ● ক্যাডমিয়াম : অ্যানিমিয়া, কিডনির বিভিন্ন অসুখ ● ম্যাগনেসিয়াম : পাকস্থলীর ক্ষতি ● তামা : শ্বাসযন্ত্র ও শ্বাসলানির রোগ ● জিঙ্ক : বমি-বমি ভাব ● সোডিয়াম : ত্বকের অসুখ ● সীসা : স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা ● সালফার : চোখজ্বালা৷

কীসে কী রং
রং—–ধাতু—–যৌগের উদাহরণ
লাল (তীব্র / মাঝারি)—–স্ট্রন্টিয়াম, লিথিয়াম—–স্ট্রোটিয়াম কার্বনেট, লিথিয়াম ক্লোরাইড, লিথিয়াম কার্বনেট
কমলা—–ক্যালসিয়াম—–ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড
হলুদ—–সোডিয়াম—–সোডিয়াম নাইট্রেট
সবুজ—–বেরিয়াম—–বেরিয়াম ক্লোরাইড
নীল—–তামা—–কপার ক্লোরাইড
বেগুনি-নীল—–সিজিয়াম—–সিজিয়াম নাইট্রেট
বেগুনি—–পটাশিয়াম—–পটাশিয়াম নাইট্রেট
বেগুনি-লাল—–রুবিডিয়াম—–রুবিডিয়াম নাইট্রেট
সোনালি, সাদা—–টাইটানিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, বেরিলিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম—–এদের নাইট্রেট বা ক্লোরাইড যৌগ

Latest article