দেবাশিস পাঠক: “আস্ফালিছে লক্ষ লোল যেন জিহ্বা নিষ্ঠুর নীলিমা— / তরঙ্গ তাণ্ডবী মৃত্যু।”
রবি কবির এই কথাগুলো আপন অভিজ্ঞতা দিয়ে চিনেছিল গুজরাত, ২০০২-তে।
দু-দশক আগে রক্তমাখা লাশ, পোড়াঘর ও শরীর, দুষ্কৃতীর পৈশাচিক উল্লাস, এসব কিছু তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ‘বিজেপি ভারতবর্ষে’ ‘একমাত্র দোষ’ হল ‘মুসলমান ঘরে জন্মগ্রহণ’।
আর এই সদ্য অতিক্রান্ত পঁচাত্তুরে বৃদ্ধ স্বাধীনতা পরবে ‘স্বাধীনতার সামনে দিনভর / খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েই আছি / শত চেষ্টাতেও গলা দিয়ে / বেরোচ্ছে না স্বর! / কিছুতেই বলতে পারছি না / তখন যিনি ছিলেন গুজরাটে / সর্বোচ্চ আসনে সমারূঢ় / তিনিই এখন দিল্লীশ্বর…”।
সোজা কথা সোজা ভাষায় বলা। আড়াল সরিয়ে দিয়ে কোদালকে কোদাল বলে চেনানো। কথার আলঙ্কারিক বর্মে না-মুড়েই ভয়ানক সত্যের নির্মোক পরিবেশন।
এই সহজ পরিবেশনার দাপটেই জেগে ওঠে ‘কঙ্কাল’। কেবল জেগে ওঠে না। জাগিয়েও রাখে। জাগিয়ে রাখে মুছতে বসা স্মৃতিকে। সেই সঙ্গে বিবেককেও।
আরও পড়ুন-জলপোকাদের জীবন
সময় বেগবান। স্মৃতি তার চেয়েও দ্রুতগতিসম্পন্ন। ১৮টি কবিতা আর একটি ‘কবিতার পরিবর্তে প্রতিবেদন’-এর কৃশকায় সংকলন গ্রন্থের রচয়িতা যিনি, ‘কঙ্কাল’-এর কবি জয় গোস্বামী সেই অমোঘ কথাটি ভালমতোই জানেন। জানেন এবং মানেন। আর তাই, তাই-ই ৩২ পৃষ্ঠার ‘কঙ্কাল’ কবিতাগ্রন্থের শুরুতেই উদ্ধৃত করেন মিলান কুন্দেরার একটা উচ্চারণ, ক্ষমতাসীনের সঙ্গে মানুষের লড়াইটা আসলে স্মৃতি বনাম বিস্মৃতির লড়াই। The struggle of man against power is the struggle of memory against forgetting.
শুধু অন্যের কথার উজ্জ্বল উদ্ধারেই পরিণতি পায় না তাঁর কবিকর্ম।
আরও পড়ুন-প্রবীণরা ভাল থাকুন
সেজন্যই জীবনানন্দীয় শাব্দিক সৌকর্যে তিনি মনে করিয়ে দেন, ‘জীবন গিয়েছে চলে… কুড়ি কুড়ি বছরের পার’, আর যুগপৎ জানতে চান, সমকালীন গণস্মৃতির কাছে, এই সময়ের যুব মানসের কাছে, ‘আজ যারা কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছ’ তাদের কাছে, ‘তারা কেউ জানো, একজনও কি জানো / নারোদা পাতিয়া আর গুলবার্গ সোসাইটির গণকবরের / ভিতরে পাশ ফিরে শোয়া কতজন কঙ্কালের হাড়?”
‘পার’ আর ‘হাড়’-এর ধ্বনিসাযুজ্যে, অন্ত্যমিলের ঝলকানিতে ঝাঁকুনি খায় আমাদের স্মৃতি ও সত্তা, ইতিহাসবোধ ও আগামীর আলপনা। চোখ থেকে তখন জল নয়, রক্তই গড়ায়। ‘কঙ্কাল’ কি তবে স্মৃতির অতলে চলে যাওয়া কথাটুকুকে ঠেলে তোলে? ‘ত্বক মাংস ক্ষয় হল’ বলে কেবল হাড়ের ঠকঠকানি শোনায়?
না! তা বোধহয় নয়।
না! তা মোটেও নয়।
আরও পড়ুন-ভালবাসার শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস
‘কঙ্কাল’ কালপ্রসৃতিকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে সমকালের ভেতর সংগুপ্ত ফেলে-আসা কালবীজকে চেনায়।
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০২। সাংসদ এহসান জাফরিকে টুকরো টুকরো করে কেটে তাঁর গলায় জ্বলন্ত টায়ার ঝুলিয়ে দিয়েছিল গুজরাতের হিন্দুত্ববাদীরা। তাঁর অপরাধ, তিনি দাঙ্গায় সন্ত্রস্ত মুসলমান পরিবারগুলোকে নিজগৃহে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
১৩ মে, ২০২২। জয় গোস্বামী তাঁর ‘লণ্ঠন’ কবিতায় লিখলেন গভীর আশায়, সত্যের বিজয়ের বিষয়ে গভীরতর প্রত্যয়ে, “সকলকেই মেরে ফেলল। কেবল একজন / পালাতে পেরেছিলেন, এহসান জাফরির স্ত্রী— / জাফিয়া জাফরি। / তিনি কেস লড়ছেন এখনও।”
২৫ জুন, ২০২২। শীর্ষ আদালত জাকিয়া জাফরির করা মামলা নাকচ করে দেয়। কবিতার অন্তিমে পাদটীকার মতো সেই খবর বিষণ্ণতার আখরে ধরা থাকে।
আরও পড়ুন-চা-শ্রমিক সংগঠনের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন
আর কবিতাটি পাঠের শেষে শুনতে পাই কোনও এক শুদ্ধ স্বর গভীর অনাস্থায় প্রতাপ ভানু মেহতার মতো কণ্ঠে বলছে, “Rather than being the guardian of rights, the superme court is now a significant threat to it.” কিংবা সংবিধান বিশেষজ্ঞ অনুজ ভুয়ানিয়ার মতো বিষণ্ণতার অন্তস্তল থেকে উগরে দিচ্ছে বারুদ জলের শব্দমালায়, “During the Modi period, not only has the Court failed to perform its constitutional role as a check on governmental excises, it has acted as a cheerleader for the Modi government’s agenda.”
এভাবেই ‘কঙ্কাল’ নিছক অন্তর্লীন স্বগতোক্তির কাব্যিক প্রকাশ হয়ে টিকে থাকার দায় বহন করে না। ৭৫ বছরের বার্ধক্যলাঞ্ছিত গণতন্ত্রের কঙ্কালসার চেহারার সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়ার দায় পালন করে। স্মৃতি সলতে উসকে দিয়ে বিস্মরণ থেকে মননে ঠেলে দেয় এমন একটা মন্ত্র, এমন একটি সারসূত্র, যে পাঠক ফের টের পান, গণতন্ত্রে ‘গণের জোরেই গণকে ঠকায় গণদ্বেষী মন্ত্র’।
আরও পড়ুন-সন্দেশখালিতে ত্রাণ
‘কঙ্কাল’ পাঠান্তে তাই স্মৃতি জাগানিয়া মন জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা কয়। আত্মপরিচয় প্রদানের লগ্নে সে অফুরান। প্রাচীন কিন্তু অনিবার্য। তার সোচ্চার স্বীকারোক্তি, “নেই কিছু আমার নতুন / কুড়ি বছর আগেকার ওই / হত্যাকথা জ্বেলে রেখে দিক / এই ক্ষুদ্র বই।”
বইটি তাই ক্ষুদ্র হলেও, সেটির নিবিড় পাঠ এই সময়ে জরুরি হয়ে ওঠে।