প্রবীণরা ভাল থাকুন

আজ ২১ অগাস্ট, বিশ্ব প্রবীণ নাগরিক দিবস। পৃথিবীর সকল প্রবীণ মানুষ শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকুন। আনন্দে থাকুন। নিজেদের যেন গুরুত্বহীন মনে না করেন। অবসাদে না ভোগেন। কীভাবে মানসিকভাবে ভাল থাকবেন তাঁরা? জানালেন দুই বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ জয়রঞ্জন রাম এবং ডাঃ রাজর্ষি নিয়োগী। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

হাওড়ার এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মহাশয়। বিপত্নীক। ৮০ পেরিয়েছেন কয়েক বছর আগে। দীর্ঘদিন ছিলেন গ্রামের বাসিন্দা। গত দুই দশক শহরে। ফেলে আসা গ্রামকে কিছুতেই ভুলতে পারেন না। মাঝেমধ্যেই ছেলের কাছে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার বায়না ধরেন। সারাদিনের কথাবার্তায় শুধুমাত্র অতীতের স্মৃতিচারণা। পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে তাঁর দুই চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে।
একজনের নয়, বর্তমানে এই সমস্যা দেখা যায় অনেকের মধ্যেই। কথা হল বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ জয়রঞ্জন রামের সঙ্গে। বিষয়টি সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘এঁরা অতীত আকড়ে বাঁচতে ভালবাসেন। আগামী দিনের কথা ভাবেন না। কারণ এঁরা নিজের ইচ্ছে মতো কিছু করতে পারেন না, পারেন না কোথাও যেতে। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ হয় না। তাই মনের মধ্যে হতাশা গ্রাস করে। এটা এক ধরনের মানসিক সমস্যা। একাকীত্ব এই সমস্যার মূল কারণ। তার সঙ্গে আছে শারীরিক সমস্যা এবং পরনির্ভরশীলতা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এঁদের বাড়িতে বিষয়টাকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মনে করা হয়—বয়সজনিত কারণেই সমস্যা হচ্ছে। এটা কোনও ব্যাপার না। বলা হয়, হাতে কোনও কাজ নেই তো, তাই এই অবসাদ। এই সব বলে এড়িয়ে যায়। এটা কিন্তু উচিত নয়। বয়স্কদের ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, ভুলে যাওয়ার মতো ঘটনাকে অগ্রাহ্য না করে আমাদের পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখতে হবে।’

আরও পড়ুন-মশা মশাই

এটা ঠিক, দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজ বয়স্কদের অপাঙ্‌ক্তেয় মনে করে। পাঠিয়ে দেওয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। বিভিন্ন কারণে বয়স্কদের ধারণা হয়, আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমরা এখন গুরুত্বহীন। তাই তাঁরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অতীত আঁকড়ে বাঁচতে ভালবাসেন। যথাযথ চিকিৎসায় এইসব মানসিক সমস্যার নিরাময় সম্ভব। কী ধরনের চিকিৎসা?
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘কাউন্সিলিং এবং ওষুধ। মারাত্মক মনখারাপ হলে, অযথা রেগে গেলে বা কান্নাকাটি করলে তখনই চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে। এইগুলোই ডিপ্রেশনের উপসর্গ।’

আরও পড়ুন-ভালবাসার শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস

চিকিৎসার পাশাপাশি আর কী কী করা উচিত? তিনি জানালেন, ‘বয়স্কদের বাড়াতে হবে নিজস্ব জগৎ। করতে হবে সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট। যোগাযোগ বাড়াতে হবে পরিচিত ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে। বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী হতে হবে। প্রয়োজনে আশেপাশের মানুষকে সাহায্য করতে হবে। এইভাবে বাড়াতে হবে মেলামেশা। আনন্দে রাখতে হবে মনকে। তবেই প্রবীনদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।’
জানা গেছে, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ডিপ্রেশন বেশি হয়। কারণ তাঁরা সাধারণত নিজস্ব আইডেন্টিটি তৈরি করতে পারেন না। গোটা জীবনটা উৎসর্গ করেন স্বামী-সন্তানের জন্য। সন্তানরা বড় হয়ে কর্মসূত্রে বাইরে চলে গেলে বা স্বামী গত হলে এই মহিলারা অনেক বেশি একা হয়ে যান। তখন তাঁরা ডিপ্রেশনের শিকার হন। কেউ কেউ মনে করেন, আমার বেঁচে থেকে লাভ কী! পাশাপাশি চিন্তা বাড়ে ছোটখাটো অসুখ নিয়ে। বিভিন্ন ধরনের ওষুধপত্র খেলেও সাইড এফেক্ট হয়। তার ফলেও দেখা দেয় মানসিক সমস্যা। একদিন মনে অবসাদ গ্রাস করে। এই পরিস্থিতিতে খুব সামান্য জিনিসও কিন্তু এঁদের আনন্দ দিতে পারে, ব্যস্ত রাখতে পারে।

আরও পড়ুন-এশিয়া কাপে নেই আফ্রিদি

ডাঃ জয়রঞ্জন রাম জানালেন, ‘আমার এক আত্মীয়ার ৮২ বছর বয়স। ওঁকে আমরা ১২ বছর আগে একটা আইপ্যাড উপহার দিয়েছিলাম। তারপর থেকে তিনি আইপ্যাড নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। মেতে থাকেন ফেসবুক, টুইটার, নিউজ চ্যানেল নিয়ে। আইপ্যাডেই পড়েন বই। ‌এই ভাবেই সময় কাটান। অবসাদ তাঁকে বিন্দুমাত্র গ্রাস করতে পারেনি। এটা কিন্তু দেখার মতো। অন্যরাও ট্রাই করতে পারেন।’
লকডাউনের সময় ডিপ্রেশনের শিকার হয়েছিলেন একজন বয়স্কা মহিলা। তাঁর কথা শোনালেন বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ রাজর্ষি নিয়োগী। জানালেন, ‘বয়স্কা মহিলার বাড়ি বেলঘরিয়ার। ছেলে থাকেন আমেরিকায়। ওই মহিলা বছরে ছয় মাস আমেরিকায় ছেলে-বৌমা-নাতির সঙ্গে হইহই করে কাটান। বাকি ছয় মাস থাকেন বেলঘরিয়ায়। মূলত পুজোয়। লকডাউনের সময় ছেলে-বৌমা-নাতির কাছে যেতে পারেননি বলে ওই মহিলা ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলেন। শেষমেশ কাউন্সিলিং। এখন সুস্থ।’

আরও পড়ুন-হাতি ও শাবকের রহস্যমৃত্যু

কেন দেখা দেয় এই ধরনের সমস্যা? ডাক্তারবাবু বললেন, ‘শূন্য-ঘর এই সমস্যার মস্তবড় কারণ। এখন বহু শিক্ষিত পরিবারের ছেলেরাই কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। বাড়িতে থাকেন মা-বাবা। সন্তান, পুত্রবধূর, নাতি-নাতনিদের কাছে না পেয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অবসাদে ভোগেন। হয়তো নিয়মিত ফোনে বা ভিডিও কলে কথা হয়। তবে সেটা মন ভাল রাখার পক্ষে যথেষ্ট নয়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মধ্যে কোনও একজন মারা গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যায়। একাকীত্ব থেকে অন্যজনের বেড়ে যায় ডিপ্রেশন, রাগ, অ্যাংজাইটি। হয়ে যান অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ। অনেকেই এটাকে স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করেন। কিন্তু বিষয়টা তা নয়। যথেষ্ট চিন্তার।’

আরও পড়ুন-লর্ডসেই সম্ভবত বিদায় ঝুলনের

সমস্যার সমাধানের উপায় শোনালেন তিনি, ‘নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। দুই বেলা আধঘণ্টা হাঁটাহাঁটি। রুটিন অনুযায়ী চলা। ডায়েট মেইনটেইন। পর্যাপ্ত ঘুম। অন্তত আট থেকে নয় ঘণ্টা। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়া। কথা বলতে হবে পরিচিতদের সঙ্গে। মুখোমুখি, ভিডিও কল অথবা টেলিফোনে। মিশতে হবে সমাজে। যেতে হবে ক্লাবে। সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার কোনও তুলনাই নেই। প্রতিদিন ডায়েরি লেখার অভ্যাস করতে পারলে খুব ভাল। শুনতে হবে গান। দেখতে হবে সিনেমা। অনেকেই ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক ব্যাপারে আগ্রহী। আছে বিভিন্ন চর্চাকেন্দ্র। সেখানে সময় কাটানো যেতে পারে। যুক্ত হওয়া যায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গেও। জনসেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারলে মনে শান্তি পাওয়া যায়। যুক্ত থাকা যায় পাড়ার পুজোর সঙ্গেও। এইভাবে নিজেকে বিভিন্ন কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে হবে। তবেই আনন্দে থাকবে মন, কেটে যাবে ডিপ্রেশন। একাকীত্ব দূর করার জন্য অনেকেই ফ্যামিলি অ্যাডপ্ট করেন। খুব বিশ্বস্ত কাউকে বাড়িতে রাখা যেতেই পারে। বিদেশে এই কনসেপ্ট বহুদিন আগেই চালু হয়েছে।’

আরও পড়ুন-মাঠে লিমা, এলেন ইভান

শেখার কোনও বয়স নেই। তাই যে কোনও সময় শেখা যায় নতুন কিছু। এই প্রসঙ্গে ডাক্তারবাবু করলেন একটি ঘটনার উল্লেখ। বললেন, ‘আমার একজন বয়স্ক বাঙালি পেশেন্ট আছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলেন। ছেলে থাকেন জার্মানিতে। খুব বেশি কথা বলার সুযোগ হয় না। একদিন ভদ্রলোক ঊর্দু শেখা শুরু করলেন। কিছুদিন পর দেখলাম, নতুন ভাষা শিখতে শিখতে অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর ডিপ্রেশন দূর হয়ে গেছে। এইভাবেই তিনি মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেন।’

আরও পড়ুন-নিম্নচাপের জেরে রাতভর ঝড়বৃষ্টি দুই মেদিনীপুর ও সুন্দরবনে

আজ ২১ অগাস্ট। বিশ্ব প্রবীণ নাগরিক দিবস। পৃথিবীর সকল প্রবীণ মানুষ শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকুন। আনন্দে থাকুন। নিজেদের যেন গুরুত্বহীন মনে না করেন। অবসাদে না ভোগেন। চাইলেই ভাল থাকা যায়। আছে বিবিধ উপায়। সুস্থ সমাজের জন্য প্রবীণ নাগরিকদের ভাল থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। ভুললে চলবে না, তাঁরা আছেন বলেই আজ আমরা আছি।

Latest article