আকরিক
এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (28th KIFF) বাংলা প্যানোরামা বিভাগটি ছিল আকর্ষণীয়। দেখানো হয়েছে তথাগত ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘আকরিক’। অসমবয়সি বন্ধুত্বের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি আছে গভীর একাকীত্ব। চরিত্ররা অনেকের মাঝে আশ্চর্য রকমের একা। সেইসঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নব্য-প্রাচীন দ্বন্দ্ব। আছে বিচ্ছেদ। তবু শেষপর্যন্ত জয়ী হয় ভালবাসা। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় শুধুমাত্র অন্যের অবনমন ঘটায় না, মানসিক উত্তরণও ঘটায়। দেখিয়েছে এই ছবি। পাহাড়ের কোলে জন্ম নিয়েছে এক নতুন দর্শন।
বহুদিন পর বাংলা ছবিতে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মার্জিত অভিনয় ছবির মস্তবড় সম্পদ। ছবিতে তিনি যৌথ পরিবারের আবহে বেড়ে ওঠা একজন উচ্চশিক্ষিত প্রবীণ মানুষ। অনুরাধা রায় অভিনয় করেছেন তাঁর অসুস্থ স্ত্রীর ভূমিকায়। আছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। সিঙ্গল মাদার স্ক্রিপ্ট রাইটারের চরিত্রে। এই সময়ের নারী। স্বাধীনচেতা। তাঁর সন্তানের চরিত্রে অঙ্কন মল্লিক। সিঙ্গল পেরেন্টিংয়ের ছায়ায় বেড়ে ওঠা এক শিশু। এই শিশুর সঙ্গেই গভীর বন্ধুত্ব জমে ওঠে ভিক্টর অভিনীত চরিত্রের। আছে ঘটনার ঘনঘটা। কখনও ফিরে ফিরে এসেছে অতীত। সবমিলিয়ে পেয়ে হারানো এবং হারিয়ে পাওয়ার এক আন্তরিক গল্প ফুটে উঠেছে।
অসাধারণ অভিনয় করেছেন প্রত্যেকেই। পাশাপাশি পরিচালনা, চিত্রনাট্য, ক্যামেরা, সম্পাদনা প্রশংসার দাবি রাখে।
ক্লোজ
নির্ভেজাল বন্ধুত্বের ছবি ‘ক্লোজ’। বন্ধুত্ব ১৩ বছরের দুই কিশোরের। একজনের নাম লিও, অন্যজন রেমি। নিরীহ অন্তরঙ্গতায় তারা গরমের ছুটি কাটায়। ভাগ করে নেয় ছোট ছোট খুশি, আনন্দ। তাদের চোখে মুখে ফুলের সারল্য। হাসি ভোরের নরম আলোর মতো নির্মল।
কিন্তু স্কুলের সহপাঠীদের বাঁকা চাউনি বন্ধুত্বে ছন্দপতন ঘটায়। সম্পর্কে অন্যরকম গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করে। উড়ে আসে তির্যক, অপমানজনক মন্তব্য, বিদ্রুপ। বিপর্যস্ত হয় তারা। মারাত্মক প্রভাব পড়ে মনে। পরিস্থিতি বুঝে রেমি নিজেকে লিওর থেকে দূরে রাখার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। মিশে যায় অন্য বন্ধু-বান্ধবীদের দলে। এইভাবেই রেমি লিওর থেকে দূরে চলে যায়। অনেক দূরে। চিরতরে। লিওর মনের উঠোনে নেমে আসে গভীর
শূন্যতা।
লুকাস ধোন্ট পরিচালিত ছবিটি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (28th KIFF) দেখানো হয়েছে সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল বিভাগে। ফরাসি-ডাচ ভাষার ছবিটি বেলজিয়ামের প্রতিনিধিত্ব করেছে। লিও চরিত্রে ইডেন ডামব্রিন এবং রেমি চরিত্রে গুস্তাভ ডি ওয়েলের অভিনয় মনে রাখার মতো। অন্যান্য চরিত্রে এমিলি ডেকুয়েন, লিয়া ডুকার, কেভিন জানসেনস, মার্ক ওয়েইস, ইগর ভ্যান ডেসেল, লিওন বাটেইলে যথাযথ। অসাধারণ দৃশ্যায়ন ছবিটিকে বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। চিত্রনাট্য, ক্যামেরা, আবহ এবং সম্পাদনা প্রশংসনীয়।
২০২২-এর ২৬ মে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পামে ডি’অরের প্রতিযোগিতায় এই ছবির বিশ্ব প্রিমিয়ার হয়। জিতে নেয় গ্র্যান্ড প্রিক্সে পুরস্কার। পাশাপাশি আরও কয়েকটি দেশে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। ছবিটি কিছুটা হলেও ‘দোস্তজী’-র কথা মনে করিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন-সরকারকে সাহায্য করছেন রাজ্যপাল: মুখ্যমন্ত্রী
কল অফ গড
কিম কি ডুক পরিচালিত শেষ ছবি ‘কল অফ গড’। ছবিটির আসল নাম ‘কোনে টায়েভাস্ট’৷ ছবির কেন্দ্রে একজন তরুণী। সে ছিল তুমুলভাবে প্রেমের প্রত্যাশী। হৃদয়ে উন্মুক্ত করে রাখে অফুরান ভালবাসার জন্য। ভেসে যায় আবেগে। স্বপ্ন দেখে। ঘুমে-জাগরণে লিপ্ত হয় প্রিয় পুরুষের সঙ্গে। আনন্দের পাশাপাশি পায় তীব্র বঞ্চনা। একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি তাকে আবেগ এবং ইন্দ্রিয়ের জগৎ আবিষ্কার করতে সাহায্য করে। নিয়ে যায় রঙিন এক ‘স্বর্গের দরজায়’। যেখানে তার জন্য, তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে জয়, আনন্দ, ভালবাসা।
অনুভূতি যত গভীর, আবেগ তত তীব্র। প্রতিটি মেয়েই একদিন তার ভালবাসার সঙ্গে দেখা করার স্বপ্ন দেখে। ছবিটির মূল বিষয় সেটাই। একটি রাস্তার মোড়ে দেখা হওয়া দুজন মানুষের প্রেমের গল্প সার্থকভাবে তুলে ধরে ছবিটি৷
শ্যুটিং চলাকালীন কোভিডের কারণে মারা যান পরিচালক কিম। অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন বন্ধুরা।
ছবিটি নির্মেদ। কোথাও নেই অতিকথন। প্রত্যেকের অভিনয়, চিত্রনাট্য, ক্যামেরা, সম্পাদনা, আবহ এককথায় অসাধারণ। প্রিমিয়ার হয়েছিল ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে।
রাশিয়ান, কিরগিজ ভাষায় নির্মিত ছবিটি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (28th KIFF) ছিল এস্তোনিয়ার প্রতিনিধি। প্রদর্শিত হয়েছে সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল বিভাগে। পেয়েছে দর্শকদের ভরপুর প্রশংসা।
ট্রায়াঙ্গেল অফ স্যাডনেস
গল্পের কেন্দ্রে কার্ল। সে একজন নামী মডেল। তার বান্ধবী ইয়ানা। যথেষ্ট প্রভাবশালী। দুজনের মধ্যে খুনসুটির সম্পর্ক। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা অতি সক্রিয়। অর্থ এবং লিঙ্গের ভূমিকা সম্পর্কে নিজেদের ভাবনা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে। প্রশংসিত হয়। স্বীকৃতিস্বরূপ একটি বিলাসবহুল ক্রুজে আমন্ত্রণ পায়। ক্রুজে ছিলেন সমাজের বহু গণ্যমাণ্য এবং ধনী ব্যক্তি। সেখানে ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা।
একদিন ক্যাপ্টেন সবাইকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। সেইসময় আছড়ে পড়ে সমুদ্র-ঝড়। বেশ কিছু অতিথি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্যাপটেন এবং এক যাত্রী সেইসময় ইন্টারকমে সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ নিয়ে তর্ক জুড়ে দেন। অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে যাত্রীরা। হঠাৎ ঘটে যায় বিদ্যুৎ-বিভ্রাট। সকালের আলো ফুটতেই আক্রমণ করে জলদস্যুরা। তাদের নিক্ষেপ করা গ্রেনেডে ডুবে যায় বিলাসবহুল জাহাজ।
কার্ল, ইয়ায়া-সহ কয়েকজন যাত্রী প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়। ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যায় একটি নির্জন দ্বীপে। অ্যাবিগেল নামের একজন মহিলা নিজেকে দলের প্রধান ঘোষণা করে। কারণ সে মৎস্য শিকারে দক্ষ। খাবার সংগ্রহ করতে পারে। এই কারণে সে লাইফবোটের ভিতরে ব্যক্তিগত বিছানা পেয়ে যায়। বিশেষ সুবিধার আশায় তার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে কার্ল। ঈর্ষান্বিত হয় ইয়ায়া।
ভগ্ন-হৃদয় ইয়ায়া দ্বীপের অন্য প্রান্তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। খুঁজে নিতে চায় পথ। অ্যাবিগেল তার সঙ্গে যেতে চায়। খুঁজতে খুঁজতে সত্যিই অন্য দ্বীপের পথ আবিস্কার করে ইয়ানা। অ্যাবিগেলের মন চায় না ফিরে যেতে। সে পাথর দিয়ে ইয়ানাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। সমস্ত কিছুতেই উদাসীন ইয়ায়া অ্যাবিগেলকে তার সহকারী হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেয়।
রুবেন ওস্টলন্ড পরিচালিত বহুচর্চিত ছবি ‘ট্রায়াঙ্গেল অফ স্যাডনেস’। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মনের আলো-অন্ধকার।
ইয়ায়ার চরিত্রে চার্লবি ডিন, কার্ল চরিত্রে হ্যারিস ডিকিনসন অসাধারণ অভিনয় করেছেন। ক্যাপ্টেন চরিত্রে উডি হ্যারেলসন, অ্যাবিগেল চরিত্রে ডলি ডি লিওন যথাযথ। অন্যান্য চরিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। চিত্রনাট্য, ক্যামেরা, সম্পাদনা, আবহ প্রশংসনীয়।
২০২২-এর ২১ মে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রিমিয়ার হয়েছে। পেয়েছে পালমে ডি’অর পুরস্কার। পাশাপাশি টরন্টো, নিউ ইয়র্ক, উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষার অসাধারণ ছবিটি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের (28th KIFF) সিনেমা ইন্টারন্যাশনাল বিভাগে সুইডেনের প্রতিনিধিত্ব করেছে।