যশোরের রাড়ুলি গ্রামের জমিদার হরিশ্চন্দ্র রায়ের সন্তান প্রফুল্লচন্দ্র (Acharya Sir Prafulla Chandra Ray) বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে পড়াশুনো করে গিলক্রাইস্ট স্কলারশিপ নিয়ে যাত্রা করেন বিলেতে, সেখানে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন রসায়নবিদ্যায় এবং পরে ডিএসসি-ও পাশ করেন। ওখানে তিনি গবেষণা করেছিলেন বিখ্যাত রসায়নবিদ আলেকজান্ডার ক্রাম ব্রাউন-এর কাছে, অবশ্য ক্রাম ব্রাউনের বিষয় ছিল জৈর রসায়ন, প্রফুল্লচন্দ্র সে পথে হাঁটেননি, তিনি বেছে নিয়েছিলেন অজৈব রসায়ন বিষয়টিকে।
ডক্টরেট হওয়ার জন্য গবেষণা শেষ করবার পর তিনি আরও একটি বৃত্তি পেলেন, হোপ প্রাইজ নামে। এতে তাঁর বিদেশবাস আরও এক বছর বাড়ল। এই সময়সীমা শেষ হলে তিনি দেশে ফেরেন এবং কিছুদিন অপেক্ষার পর প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। যদিও তাঁকে অপেক্ষাকৃত নিচু পোস্টে চাকরি দেওয়া হয়েছিল, কারণ সে-সময় ভারতীয়দের কাউকেই শিক্ষাবিভাগে উঁচু পোস্টে নিয়োগপত্র দেওয়া হত না। আমাদের মনে পড়তে পারে আর এক বিলেতফেরত জগদীশচন্দ্রের কথা, তিনিও দেশে ফেরবার পর প্রেসিডেন্সিতে অধ্যাপক হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন, কিন্তু তিন বছর ধরে তাঁকে সাহেব অধ্যাপকদের চেয়ে অনেক কম মাইনে দেওয়া হত, যদিও তিনি প্রতিবাদে সে-মাইনে নেননি, তিন বছর পর চাকরি পাকা হলে একসঙ্গে তাঁকে সমস্ত বকেয়া টাকা দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার, আর ইউরোপীয়দের সমান বেতনই তিনি পেয়েছিলেন।
জগদীশচন্দ্রের মতোই, কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি প্রফুল্লচন্দ্র মেতে থাকতেন নানারকম রাসায়নিক নিয়ে বিক্রিয়ায়। ১৮৯৬ সালের দিকে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট নামে একটি যৌগ আবিষ্কার করেন, যা তাঁকে দেশ-বিদেশের রসায়নজগতে পাকাপাকিভাবে দেশ-একটা জায়গা করে দেয়। পারদ ছাড়াও আরও নানারকম অজৈব পদার্থ যেমন সালফারের বিভিন্ন লবণ নিয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ করেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গবেষণাপত্রে একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর লেখা পেপার।
কিন্তু এই পরিচয়ের বাইরে তাঁর আর একটা বড় পরিচয় তিনি তৈরি করে ফেলেছেন ততদিনে, নিজের পুঁজির সাতশো টাকা দিয়ে ১৮৯২ সালে একটি সংস্থা তৈরি করেন, আর নাম দিলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কস, ঠিকানা হিসেবে দেওয়া রইল তাঁর একানব্বই নম্বর আপার সারকুলার রোডের বাড়ির ঠিকানাটি। শিক্ষিত বাঙালিদের চাকরির সন্ধানে না ছুটে আরও বেশি বেশি করে আসা উচিত ব্যবসার দিকে, এই ধারণায় তিনি এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন যে নিজেই সেই স্বপ্নের উদাহরণ হিসেবে নিজেকেই খাড়া করবার প্রচেষ্টায় এই সংস্থার নির্মাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁর বহুদিনের স্বপ্নকে সত্যি করবার পথে সঙ্গে পেয়েছিলেন ছাত্র অমূল্যচরণ বসুকে, যিনি ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার এবং ওষুধ-বিশেষজ্ঞও। এই দুজনে মিলে শুরু করেন গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত নানা ধরনের কেমিক্যাল তৈরির কাজ। পরের বছর কলকাতায় যখন কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসে, তখন সেখানে তাঁদের তৈরি নানারকম ভেষজ ওষুধ প্রদর্শিতও হয়েছিল।
আরও পড়ুন: শীতলকুচি কোচবিহারের ১০ জন তীর্থযাত্রীর আত্মীয়দের প্রতি সমবেদনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
কিন্তু ১৮৯৮ সালে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে অমূল্যচরণের মৃত্যু হয়, যার পর প্রফুল্লচন্দ্র (Acharya Sir Prafulla Chandra Ray) একা হাতে ব্যবসার হাল ধরেন। নতুন শতকের গোড়ায়, ১৯০১ সালে এই সংস্থাটিকে একটি লিমিটেড কোম্পানির আকার দেওয়া হয়, নাম হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস প্রাইভেট লিমিটেড, তখন এর পুঁজি প্রায় দু লক্ষ টাকা। বঙ্গভঙ্গের সময়, সেই উত্তাল স্বদেশি আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে না পড়লেও প্রফুল্লচন্দ্রের কারখানার জিনিসগুলি দেশের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, আর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় সংস্থার লাভের অঙ্ক। উত্তর কলকাতার মানিকতলার কাছে ছিল বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রথম কারখানা, পরে ১৯২০ সালে পানিহাটিতে বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রায় পঁয়তাল্লিশ একর জায়গা কেনে, ওখানে আর একটি ফ্যাক্টরি বানানো হয়। আরও কয়েক বছর পর ১৯৩৮ সালে বোম্বাইয়ে সংস্থার তৃতীয় কারখানাটি স্থাপিত হয়। আর চতুর্থ কারখানাটি কাজ শুরু করে ১৯৫৯ সালে, কানপুরে, ততদিনে অবশ্য প্রফুল্লচন্দ্র প্রয়াত। সে-সময় এই কারখানাগুলিতে বহু রকমের ওষুধ তৈরি হত, যার মধ্যে সিপ্রোবেন, কুইনাইন, নিমুসেট, রেমক্স, বেঞ্জেসিক, ক্লোরোকুইন এরকম কিছু উদাহরণ। বিশিষ্ট সাহিত্যিক রাজশেখর বসু, যিনি পরশুরাম নামেই বেশি পরিচিত, এই সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছিলেন দীর্ঘকাল।
আসলে দেশের মানুষের কীভাবে কত উপায়ে সেবা করা যায়, এইটাই ছিল প্রফুল্লচন্দ্রের ধ্যানজ্ঞান। ছাত্রদের কোনও চাহিদায় সাহায্য করতেন প্রাণখুলে, বন্যাদুর্গতদের সেবায় কতবার ত্রাণতহবিল তৈরি করে ছুটে গেছেন সেইসব এলাকায়, সে হিসেব রাখাই দুষ্কর। নিজে যেমন এইসব কাজে মেতে থাকতেন, ছাত্রদেরকেও সুযোগ পেলেই টেনে নিতেন সেই দলে। প্রফুল্লচন্দ্র রায় কী পরিমাণে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন, তার একটি সুন্দর উদাহরণ মেলে মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনীতে। সেখানে তিনি লিখছেন, গোপালকৃষ্ণ গোখলে যখন তাঁর সঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্রের আলাপ করান, তখন বলেন, এই যে মানুষটিকে দেখছেন, ইনি মাসে মাইনে পান প্রায় আটশো টাকা, যার মধ্যে মাত্র চল্লিশ টাকা নিজের জন্য রেখে বাকি সবটাই দিয়ে দেন সমাজের নানা কাজের জন্য। ইনি এই জন্যে এমনকী বিয়ে অব্দি করেননি, আর করবেনও না। এরপর মহাত্মা লিখছেন, সেই আলাপ হওয়ার পর থেকে আজ অব্দি আমি এই মানুষটিকে একইরকম দেখে আসছি, একটুও বদলাননি। তাঁর পোশাক একইরকম, কোনও বাহুল্য নেই, শুধু বদলেছে তার উপাদান, আগে তিনি পরতেন ইন্ডিয়ান মিলের তৈরি সুতি, এখন পরেন খদ্দরের কাপড়। মহাত্মা গান্ধীর চরকা আন্দোলনের সময় প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর বড় এক সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। বেঙ্গল কেমিক্যালের আর একবার সুসময় আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। ওই সময় সেনাবাহিনীর মধ্যে নানারকম ওষুধ এবং চিকিৎসা-সামগ্রীর চাহিদা প্রচুর বেড়ে যায়, যার জোগান দিতে হয় বেঙ্গল কেমিক্যালকেই।
কিন্তু ১৯৪৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্রের (Acharya Sir Prafulla Chandra Ray) মৃত্যুর পর এই প্রতিষ্ঠানের হাল খারাপ হতে শুরু করে। যদিও কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়নি কখনও, কিন্তু কর্মচারী এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণেই এই সংস্থা আস্তে আস্তে ধুঁকতে শুরু করে। ষাট-সত্তরের দশকেও নানারকম ওষুধ, ন্যাপথালিন বা সেই বিখ্যাত হাতুড়িমার্কা ফিনাইল এক্স— এসব তৈরি হত এখানে, আশির দশকে এই কোম্পানিকে সরকার অধিগ্রহণ করে। কিন্তু তাতেও বেঙ্গল কেমিক্যালের হৃতগৌরব ফেরানো যায়নি।
অবশেষে ২০১৬-’১৭ সালের দিকে এই সংস্থা ষাট বছর পরে প্রথমবার লাভ করতে শুরু করে, সে-বছর চার কোটি টাকা লাভ হয়েছে, তার আগের চার বছরে সংস্থাটির ক্ষতি ছিল ছত্রিশ কোটি (২০১৩-’১৪), সতেরো কোটি (২০১৪-’১৫), ন কোটি টাকা (২০১৫-’১৬) করে। এখন এরা তৈরি করে ফিনাইল, ন্যাপথালিন, পারফিউম, ঘর পরিষ্কার করবার কেমিক্যাল ইত্যাদি, এগুলি খোলা মার্কেটে বিক্রি হয়, আর এদের তৈরি ওষুধ কেবল পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালগুলিতে।
আর বছর দুয়েক আগে, করোনা ভাইরাসের বাড়বাড়ন্তের সূচনাকালে আমরা দেখেছিলাম এই প্রতিষ্ঠানকে আবার খবরের শিরোনামে উঠে আসতে, সৌজন্যে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নামে এক রাসায়নিক, যা আসলে ব্যবহৃত হত ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে। করোনা আক্রান্তদের হাসপাতালের আইসিইউতে থাকবার সময়কে কমিয়ে এনেছিল এই ওষুধ। বিদেশের বহু জায়গা থেকেও এর চাহিদার খবর আসতে থাকে, আর তখন বেঙ্গল কেমিক্যালসই ছিল ভারতের একমাত্র কোম্পানি, যারা এই ওষুধ তৈরির অনুমতি পেয়েছিল ড্রাগ কন্ট্রোলারের দফতর থেকে। বেঙ্গল কেমিক্যাল আমাদের বাঙালিদের গর্বের এক প্রতিষ্ঠান, একে বাঁচিয়ে রাখা তাই যে কোনও মূল্যে আমাদের কাছে অত্যন্ত জরুরি।