জীবনপুরের পথিক অনুপকুমার

মঞ্চে ও পর্দায় সমান দাপুটে নট অনুপকুমার। অজস্র ছবিতে কাজ করেও দর্শকদের আকর্ষণ কখনও হারাননি। আগামিকাল তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে শিল্পীকে স্মরণ করেছেন তাঁর এক সময়ের সহ-অভিনেতা ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

তরুণ মজুমদারের ধনুকভাঙা পণ
আংটি চাটুজ্যের ভাই বসন্ত ভবঘুরে বাউন্ডুলে। নায়ক হওয়ার কোনও গুণ তার নেই। থাকার মধ্যে আছে উদার হৃদয় আর কণ্ঠে আছে গান। হরিমতী বসন্তের ঘরনি হয়ে এসে তাকে বাঁধতে পারেনি। ঝুমুর দলের লাস্যময়ী গোলাপ অথবা ময়না কেউই তাকে বুঝতে পারেনি। এই ভুল বোঝার বোঝা বইতে বইতে পা তার ভারী হয়ে এসেছে। তবু থামতে পারেনি। নিজের গলায় সেকথা স্বীকার করে নেয় গানের মধ্যে দিয়ে— ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই, কোনো দেশেই সাকিন নাই’। সেই বসন্ত হরিমতীর মৃত্যুর পর সবকিছু ছেড়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। যে-ছবির গল্প বলছিলাম তার নাম ‘পলাতক’। যাত্রিকের খোলস ছেড়ে এই ছবি পরিচালনা করতে এলেন তরুণ মজুমদার। কিন্তু চিত্রনাট্য নিয়ে দরজায় দরজায় ঘুরেও প্রযোজকদের সাড়া পেলেন না। তার কারণ অনুপকুমারকে নায়ক করে কোনও প্রযোজক ছবি করতে এগিয়ে এলেন না। কিন্তু তরুণ মজুমদার চিত্রনাট্য লিখেছেন অনুপকুমারকে (Anup Kumar) নায়ক হিসেবে ভেবেই। অবশেষে ভি শান্তারাম এগিয়ে এলেন তরুণ মজুমদারের ডাকে এই ছবি প্রযোজনা করার ব্যাপারে। দেখা গেল তরুণ মজুমদারের এই যে প্রচেষ্টা তা সার্থক। সুপার ডুপার হিট হয়েছিল ‘পলাতক’। এর গান আজও লোকের মুখে-মুখে।

পরম্পরা
বাবা ধীরেন্দ্রনাথ দাস ছিলেন গায়ক-সুরকার, অভিনেতা। যদিও তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল সত্যেন্দ্রনাথ। বাবার প্রেরণাতেই অনুপকুমার অভিনয় জগতে আসেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র চার। তৎকালীন বিখ্যাত পরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘হাল বাংলা’ ছবিতে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান অনুপকুমার। ১২ বছর বয়সে মঞ্চে প্রবেশ। তারপর দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। যেমন সিনেমায় তেমনি পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে। ‘ধাত্রী দেবতা’ ছবিতে তিনি শিবনাথ। পিসির চরিত্রে ছায়া দেবী। ছবি চলল না। পরের ছবি ‘সংকল্প’। তিনি নায়ক। নায়িকা শিখারানি বাগ। সেই ছবিও চলল না। কিন্তু তিনি এতে দমে যাননি। নায়ক চরিত্র ছেড়ে নায়কের বন্ধু বা নায়িকার ভাই— এমন সব চরিত্রে তিনি নিজেকে স্বচ্ছন্দ করে তুললেন। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে অনুপকুমারের (Anup Kumar) গায়ে কমেডিয়ানের তকমা। বাংলা ছবিতে তখন অনুপকুমার সফল এবং অপরিহার্য।

শিল্পীর বিপরীতে নায়িকারা
নায়ক চরিত্র যে একেবারে করেননি, তা নয়। অনুপ কুমারের বিপরীতে সন্ধ্যা রায় নায়িকা হয়েছেন পলাতক, জীবন কাহিনী, ঠগিনী, নিমন্ত্রণ ছবিতে। তিনি নায়িকা হিসেবে পেয়েছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় (কানামাছি, কাঁচামিঠে), সবিতা বসু (দেবত্র, জন্মতিথি), মাধবী মুখোপাধ্যায় (নিষ্কৃতি, খেয়া), লিলি চক্রবর্তী (জয়া, বিবাহবিভ্রাট), সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় (বসন্ত বিলাপ, সুবর্ণলতা), আরতি ভট্টাচার্য (হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ), জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায় (বালিকা বধূ), শকুন্তলা বড়ুয়া (লাল গোলাপ, একান্ত আপন), রাজেশ্বরী রায়চৌধুরী (অনুরাগের ছোঁয়া) প্রমুখ শিল্পীদের। এঁদের বিপরীতে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করে অনুপকুমার প্রমাণ করেছিলেন বয়স কোনও চরিত্রের পক্ষে প্রতিবন্ধক নয়।

আরও পড়ুন- সর্বনাশের কিনারায় দেশ, দায়ী মোদি সরকার

যখন তিনি পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে
হাতিবাগানের পেশাদারি রঙ্গমঞ্চগুলির নাটকে অভিনয়ে অনুপকুমারের আরেক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। স্টার থিয়েটারে ‘শ্যামলী’ নাটকে উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের পাশে চুটিয়ে অভিনয় করেছিলেন। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে স্টার থিয়েটারে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন ‘তাপসী’ নাটকে। তাঁর অভিনয়সমৃদ্ধ নাটকগুলি হল— ঘর, স্বীকৃতি, অঘটন, নুরজাহান, ইন্দ্রাণী ইত্যাদি। অপর্ণা সেনের বিপরীতে কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ‘পান্নাবাঈ’ নাটকে কিছুদিনের জন্য অভিনয় করেছিলেন। অনুপকুমারের শেষ মঞ্চাভিনয় বিজন থিয়েটারে ‘চন্দনপুরের চোর’ নাটকে। সৌমিত্র-অনুপ জুটির এই নাটকে চন্দনপুরের রানিমা হয়েছিলেন অলকা গঙ্গোপাধ্যায়।

অর্ধাঙ্গিনী অলকা
ব্যক্তিগত জীবনে অলকা গঙ্গোপাধ্যায় অনুপকুমারের (Anup Kumar) স্ত্রী। বেশি বয়সের বিয়ে। অনুপ-অলকার প্রেমপর্বের সূচনা কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ‘মল্লিকা’ নাটকের মধ্য দিয়ে। সেখানে তাঁরা ভাই-বোনের চরিত্রে অভিনয় করতেন। যাত্রাপালাও পরিচালনা করেছেন তিনি। ‘আমি রাস্তার মেয়ে নই’ যাত্রার পরিচালক অনুপকুমার। নামভূমিকায় ছিলেন সংঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়।

স্মরণীয় চিত্রায়ণ
অনুপকুমারের অভিনয়সমৃদ্ধ কিছু ছবির নাম উল্লেখ করতেই হয়। সেই তালিকায় আছে শশীবাবুর সংসার, দেড়শও খোকার কাণ্ড, বেনারসি, হাইহিল, বর্ণচোরা, তাহলে, দাবি, একটুকু বাসা, দিনান্তের আলো, মুখুজ্যে পরিবার, বৌদি, মায়াবিনী লেন, নতুন জীবন, উত্তর পুরুষ, হঠাৎ দেখা, বালুচরি, দাদু, নিশিপদ্ম, মঞ্জরী অপেরা, বিরাজ বৌ, ফুলেশ্বরী, মৌচাক, রাগ অনুরাগ, প্রক্সি, গণদেবতা, দাদার কীর্তি, শহর থেকে দূরে, খেলার পুতুল, প্রতিনিধি, অমৃতকুম্ভের সন্ধানে, ইন্দিরা, লাল গোলাপ, মোহনার দিকে, শত্রু, ভালবাসা ভালবাসা, আশীর্বাদ, দেবীবরণ, অহংকার, মঙ্গলদীপ, দেবতা, অভাগিনী, মায়া মমতা, নটি বিনোদিনী, মেজ বউ, নবাব, ইন্দ্রজিৎ ইত্যাদি ছবি।

শিল্পীর সান্নিধ্যে
‘বৌদি’ ছবিতে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ-ছাড়া বেশ কয়েকটি ছবিতে যেমন দাবি, অহংকার, মায়া মমতা, গীত সংগীতে কাজ করার সুযোগও হয়েছিল আমার।

পুনশ্চ
দীর্ঘপথ পরিক্রমায় চলচ্চিত্র, নাটক, যাত্রাপালা, দূরদর্শন ধারাবাহিকে সফল অভিনেতা ও সফল সংগঠক ছিলেন। জীবনপুরের পথিকের পথ চলা শেষ হয়েছে ১৯৯৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। চোখের সামনে তিনি নেই ঠিকই কিন্তু দর্শকের মনের মণিকোঠায় তাঁর অবস্থান চিরদিনের জন্য।

Latest article