তীব্র গরমে নাজেহাল মানুষজন। অনেকেই কষ্ট সহ্য করতে পারছেন না। কেউ কেউ বেরিয়ে পড়ছেন। ব্যাগপত্তর গুছিয়ে চলে যাচ্ছেন এমন কোনও জায়গায়, যেখানে নেই গরমের চোখরাঙানি। দু’-চারদিনের জন্য শুধুই আরাম। এই ক্ষেত্রে আদর্শ জায়গা হতে পারে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চল। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে আছে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বেড়ানোর জায়গা। কিছু জায়গা সম্পর্কে বহু মানুষ জানেন, কিছু জায়গা এখনও থেকে গিয়েছে অল্প পরিচিত। তেমনই একটি জায়গা অহলধারা (Ahaldara)। নামটি ভারি সুন্দর, তাই না? জায়গাটাও আশ্চর্য রকমের সুন্দর। চোখ ফেরানো যায় না। দার্জিলিং জেলার কার্শিয়াংয়ের ছোট্ট জনপদ। সেল্পু পাহাড়ে অবস্থিত একটি পাহাড়ি চূড়া। অহলধারা ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ৩৬০ ডিগ্রিতে এলাকাটি দেখতে দারুণ লাগে। একদিকে পাইনের বন, অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়। সমতলে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে তিস্তা। দূর থেকে দেখলে একরকম, নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালে আর একরকম। অপরূপ সুন্দর দৃশ্য। এই দৃশ্য মনের ক্লান্তি দূর করে দিতে পারে। এটা মুঠোফোনের যুগ। চাইলেই ছবি তুলে নেওয়া যায়। তবে অকারণ সময় নষ্ট না করাই ভাল। মুঠোফোন পকেটে বা ব্যাগে রেখে দু’চোখ ভরে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করলে প্রাণে উঠবে খুশির তুফান। মুহূর্তটা থেকে যাবে আজীবনের সঙ্গী হয়ে।
আশেপাশে আছে চা-বাগান। স্থানীয় মহিলারা মেতে থাকেন পাতা তোলার কাজে। সন্ধের আগে ছুটি। তারপর দলবেঁধে ফিরে যান যে যার নিজের ঘরে। সারাদিন পরিশ্রম, তবু তাঁদের মুখে লেগে থাকে নির্মল হাসি। চায়ের পাশাপাশি এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে সিঙ্কোনা চাষ হয়। বহু মানুষ জড়িয়ে এই চাষের সঙ্গে। পাহাড়ের ঢালে ফোটে নানা রঙের ফুল। বুনোফুলের সৌন্দর্যও চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ভোর হতেই জনপদ মুখরিত হয়ে ওঠে পাখির কলতানে। ঘুম থেকে উঠে চায়ে চুমুক দিয়ে পায়ে হেঁটে একটু বেড়িয়ে আসা যায়। তবে অচেনা পাহাড়ি অঞ্চলে একা একা না যাওয়াই ভাল।
অহলধারায় (Ahaldara) লুকোচুরি খেলে মেঘ-রোদ্দুর। ভাসমান মেঘ মাঝেমধ্যেই ভিজিয়ে দিয়ে যায় পাহাড়ের ঢেউ খেলানো শরীর। অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে রয়েছে নির্জন এলাকা জুড়ে। লেগে রয়েছে আশ্চর্য মায়া। সেইভাবে গরমের আঁচ পাওয়া যায় না। রাতের আকাশে ফুটে ওঠে তারাদল। তাকালেই চোখের আরাম। উপরি পাওনা বিশুদ্ধ বাতাস। রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে ভেসে বেড়ায় অচেনা গন্ধ। সেই গন্ধ নাকে এলে অন্যরকমের অনুভূতি হয়। অহলধারা থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখতে দারুণ লাগে। আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অনন্য রূপ উপভোগ করা যায়। কাছেপিঠে আছে বেশকিছু বেড়ানোর জায়গা।
আরও পড়ুন- মহিষাদলে আজ মুখ্যমন্ত্রীর সভায় জনপ্লাবন ঘটাতে তৃণমূলের চ্যালেঞ্জ
ঘুরে আসা যায় সিটং থেকে। ৪০০০ ফুট উচ্চতার রিয়াং নদীর ধারে একটি শান্ত পাহাড়ি লেপচা গ্রাম সিটং। প্রতিটা বাড়ির বাগানে হয় কমলালেবুর চাষ। দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত কমলালেবুর সিংহভাগই উৎপন্ন হয় সিটংয়ে। গ্রামটি চারিদিকে খোলা। তাই এখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা খুব ভালভাবে দেখা যায়। রিয়াং নদীর উপর যোগীঘাট পেরিয়ে আরও ৩১ কিলোমিটার দূরে ৩৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত মংপু। এটা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি-বিজড়িত জায়গা। রবীন্দ্রনাথ প্রথম আসেন সিঙ্কোনা কারখানার কোয়ার্টারে, ১৯৩৮ সালে ২১ মে। তিনি চারবার এসেছেন স্নেহধন্যা লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামীর কোয়ার্টারে। শেষবার এসেছিলেন ১৯৪০ সালের ২১ এপ্রিল। এই সবুজ প্রকৃতির মাঝে বসে তিনি সৃষ্টি করেছেন বহু উল্লেখযোগ্য রচনা। তার মধ্যে অন্যতম ‘জন্মদিনে’, ‘নবজাতক’, ‘সানাই’ ইত্যাদি। রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে এই বাড়ির নাম রবীন্দ্রভবন। অপূর্ব পরিবেশ। অনেকটা জায়গা নিয়ে এই বাড়ি। সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো। এখানে আছে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-বিজড়িত একটি মিউজিয়াম। সারাক্ষণ চলে রবীন্দ্রসঙ্গীত। সব কিছু দেখতে দেখতে, গান শুনতে শুনতে কখন যে সময় পেরিয়ে যাবে টের পাওয়া যাবে না। সারা বছর বহু মানুষ আসেন। ঘুরে দেখেন বাড়িটি। গ্রামটি সিঙ্কোনা বাগানের জন্যও বিখ্যাত। ঘোরাঘুরির শেষে আবার ফেরা যায় অহলধারায়। নাহলে পা বাড়ানো যায় অন্য কোনও গন্তব্যে। গরমের দিনে শীতের এলাকায় ঘুরতে মন্দ লাগবে না। ভাবনা-চিন্তা দূরে সরিয়ে অহলধারায় (Ahaldara) ঘুরে আসুন।
কীভাবে যাবেন?
হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি রেল স্টেশন। উড়োজাহাজে গেলে নামতে হবে বাগডোগরা বিমানবন্দরে। দুটি জায়গা থেকেই সরাসরি চারচাকা গাড়ি পাওয়া যায়। সেবক থেকে কালীঝোরা ছুঁয়ে যেতে হয় অহলধারা ভিউ পয়েন্টে৷ লাটপাঞ্চেরে নেমে কিছুটা খাড়া পথ হেঁটেও পৌঁছানো যায়।
কোথায় থাকবেন?
অহলধারায় আছে একাধিক হোমস্টে। তাই পর্যটকদের কোনওরকম অসুবিধা হবে না। মাথাপিছু এখানকার হোমস্টেতে খরচ আনুমানিক ১৫০০ টাকা। দম্পতিরা বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন। তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়।