‘আকাশে কী গোপন বাণী/ বাতাসে করে কানাকানি’, রবি ঠাকুরের মতো আমিও যেন ওই নিসর্গের মেঘের আড়ালে কান পেতে শোনার চেষ্টা করছি, অসীম ব্রহ্মাণ্ডের রোমাঞ্চের ভাণ্ডার কী বিশাল! কী অদ্ভুত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য! কি-ই বা তার রঙের বাহার! এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ইহজগতের সকল সৃষ্টি ও সৌরজগতের সকল কৃষ্টির সন্ধান, সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ ও তার ভবিষ্যৎ দৃষ্টান্তের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বড়ই ব্যস্ত। তাঁদের সেই নিবিড় কর্মযজ্ঞের রসদ হিসেবে ওই মহাকাশে (Space) ঘটে চলেছে বিচিত্র সব ঘটনা।
উটা-র আকাশে সূর্যগ্রহণ
সূর্যগ্রহণ। এ আবার নতুন কী! হুম নতুনই বটে। এ-হল পশ্চিম আমেরিকার পার্বত্য পশ্চিম উপক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত চতুর্দিক স্থল দ্বারা বেষ্টিত উটা প্রদেশের আকাশ জুড়ে বৈচিত্র্যময় বৃত্তাকার সূর্যগ্রহণ, যা শুধু সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা নয়, নিসর্গবিদদের মধ্যে শুরু হয়েছে জোর কসরত, আগামীর পূর্ণ সূর্যগ্রহণের অনুমানিক দিনকাল নির্ধারণের তাগিদে।
গত ১ নভেম্বর আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসা কর্তৃক প্রকাশিত ছবিটি উটা-র অদ্ভুত সূর্যগ্রহণের। ছবিটি তুলেছেন পূর্ব-মধ্য উত্তর আমেরিকার গ্রেট লেক স্থিত বৈজ্ঞানিক চিত্রগ্রাহক মেরিবেথ কিজেনস্কি।
নভেম্বরের শুরুতে সূর্যের কিছু অংশ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, তবে খুব কম লোকই এ-বিষয়ে চিন্তিত ছিল, ক্ষিতিবিদরা ছাড়া। সৌরকেন্দ্র-সহ ওই অনুপস্থিত অংশটি ওই প্রদেশের কিছু অঞ্চলের দৃষ্টির আড়ালে চলে গিয়েছিল, সেটা শুধুমাত্র চাঁদের পিছনে চলে গিয়েছিল বলেই, যা মহাকাশ (Space) বিজ্ঞানের পরিভাষায় একটি বৃত্তাকার সূর্যগ্রহণ হিসাবে পরিচিত। চাঁদ আকাশে উদীয়মান সূর্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার সময় সংগ্রহ করা একটি গ্রহণের ক্রম হিসেবে এই সূর্যগ্রহণের চিত্রটি এখানে দেখানো হয়েছে। গত ১৪ অক্টোবর,২০২৩ এই সূর্যগ্রহণের শুভারম্ভ হয় উত্তর মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার আকাশ জুড়ে; যা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো এবং দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার নানা দেশে দেখা গিয়েছে। গ্রহণের এই ধারা গুয়েতেমালা, বেলিজ, হান্ডুরাস, নিকারাগুয়া, পানামা প্রভৃতি প্রদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে।
প্রদত্ত চিত্রে ফোরগ্রাউন্ড পাহাড়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উটা-র ফ্যাক্টরি বাট। সূর্য থেকে নির্গত রশ্মিগুলি তবে বাস্তব নয়— এগুলি ক্যামেরার যান্ত্রিক বিবর্তন বা অ্যাপারচার ডিফ্র্যাকশনের ফলে তৈরি হয়েছে, যা সানস্টার নামে পরিচিত। সানস্টার হল সূর্য থেকে আগত আলোক রশ্মির ক্যামেরার লেন্সে লাগানো ব্লেডের মাধ্যমে সুষমভাবে বিচ্ছুরিত একটি আলোকসজ্জা।
এখন চাঁদ বাস্তব, কিন্তু এই গোলাকৃতি আলোকসজ্জা বা ‘রিং-অফ-ফায়ার’ শুধুমাত্র গ্রহণের ছায়াচিত্রে দেখা যায়। এই গ্রহণক্রমটি যতটা অত্যাশ্চর্য, ঠিক ততটাই এর গুরুত্ব।
একজন জ্যোতির্ফটোগ্রাফারের দ্বারা গৃহীত এই সুন্দর ছবিটি বৈজ্ঞানিক অনুশীলন হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। কারণ? তিনি আশা করেন যে আগামী ৪ এপ্রিল, ২০২৪-এ উত্তর আমেরিকায় ঘটবে এমন পূর্ণ সূর্যগ্রহণের আরও ভাল ছবি তোলার জন্য এই অভিজ্ঞতাটি ব্যবহার করবেন, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণার রসদ হিসেবে গৃহীত হবে। পরিসংখ্যান বলছে আগামী বছরের এপ্রিলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডায় পূর্ণ সূর্যগ্রহণ পরিলক্ষিত হবে। এই গ্রহণ সম্ভাব্য শুরু হবে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের উপর; তবে উত্তর আমেরিকা উপমহাদেশে এই গ্রহণ প্রথম দেখা যাবে মেক্সিকোর প্যাসিফিক কোস্ট অঞ্চলে, ‘প্যাসিফিক ডেলাইট টাইম’ অনুসারে প্রায় সকাল ১১টা ৭ মিনিটে। এই গ্রহণ মেক্সিকোর ওকলাহোমা, আরকানসাস, মিসৌরি, ইলিনয়, কেন্টুকি, ইন্ডিয়ানা, ওহিও, পেনসিলভানিয়া ও মেইন এবং দক্ষিণ ওন্টারিওর কানাডার কুইবেক, নিউ বার্নসবিক, প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড ও কেপ ব্রেটন প্রদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাবে।
আরও পড়ুন- ২০২৪-এ আসছে দিন ওদের মুখের ওপর জবাব দিন
ছায়াপথের ফরনাক্স-জটলা
নাসা কর্তৃক জনসমক্ষে প্রকাশিত ২ নভেম্বরের মহাকাশ (Space) চিত্রটি ছায়াপথের ফরনাক্স-জটলার যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় দ্য ফরনাক্স ক্লাস্টার অব গ্যালাক্সিজ নামে পরিচিত। তিন ডিগ্রি প্রশস্ত চিত্রটি তুলেছেন অ্যাস্ট্রোবিন নামে একটি আন্তর্জালিক মহাকাশ-চিত্রশালার (Space) চিত্রগ্রাহক মার্শেলো রিভেরা লিগুয়েজ।
এই ব্রহ্মাণ্ডের দক্ষিণপ্রান্তের নক্ষত্রমণ্ডলের নামকরণ করা হয়েছে ফরনাক্স-জটলা; এই প্রান্তে এই জটলার বেশিরভাগ ছায়াপথ খুঁজে পাওয়া যায়। ফরনাক্স-জটলা হল ছায়াপথগুলির নিকটতম জটলাগুলির মধ্যে একটি। ১০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত ছায়াপথ-জটলার মধ্যে এটি দ্বিতীয় সমৃদ্ধ ছায়াপথ-জটলা; প্রায় ৬২ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই ফরনাক্স-জটলা। এটি আমাদের প্রতিবেশী এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির থেকে ২০ গুণ বেশি দূরত্বে এবং সুপরিচিত, অধিক জনবহুল এবং বিবেচনামূলকভাবে দীর্ঘতম ভার্গো ছায়াপথ-জটলা থেকে মাত্র ১০ শতাংশ দূরে অবস্থিত এই ফরনাক্স-জটলা।
প্রাথমিকভাবে ফরনাক্স-জটলাকে মহাকাশের কিছুটা দক্ষিণপ্রান্তে, প্রায় ৭৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত এরিডানুস গ্রুপ বা এরিডানুস ক্লাউডের অংশ হিসেবে ধরা হত। তবে ফরনাক্স-জটলা ফরনাক্স এবং এরিডানুস তারামণ্ডলের প্রায় ৫৮টি ছায়াপথ নিয়ে গঠিত।
৩ ডিগ্রি প্রশস্ত ফিল্ড-অফ-ভিউ নভঃবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে দেখেছেন ছবিটিতে প্রায় প্রতিটি হলুদ দাগই একটি উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ। ফরনাক্স-জটলার সবচেয়ে উজ্জ্বল ছায়াপথ হল এনজিসি ১৩১৬। এ ছাড়াও উপবৃত্তাকার ছায়াপথ এনজিসি ১৩৯৯ এবং এনজিসি ১৪০৪ হল নিচের কেন্দ্রের দিকে প্রভাবশালী এবং উজ্জ্বল-জটলার সদস্য। একটি স্ট্যান্ড আউট, বড় বাধাযুক্ত সর্পিল গ্যালাক্সি, এনজিসি ১৩৬৫ একটি বিশিষ্ট ফরনাক্স ক্লাস্টারের সদস্য হিসাবে উপরের ডানদিকে দৃশ্যমান।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাধারণ জ্ঞান ছাড়াও এই বিশেষ ছায়াপথ-জটলার নানাবিধ বৈজ্ঞানিক গুরুত্বের কথা আমাদের সামনে এসেছে, যা বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষ সকলকেই চমকে দিয়েছে। এই জটলার মধ্যে গরম ও বিরল ধরনের গ্যাস ও গ্যাসীয় পদার্থ বর্তমান, যার থেকে ক্রমাগত এক্স-রশ্মি নির্গত হয়। এই ফরনাক্স ক্লাস্টারের আমাদের সৌরজগতের সূর্যের সঙ্গে অনেক নিবিড় সাদৃশ্য রয়েছে যা এই জাতীয় ছায়াপথ-জটলার এইরকম বিচিত্র অভিব্যক্তির কারণ খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। এ ছাড়াও এর মধ্যস্থিত ছায়াপথগুলোর মধ্যে মহাকর্ষীয় প্রভাব বিদ্যমান, যা নাকি এইসব জটলার এইরূপ সুপার স্ট্রাকচারের মূল কারণ। এইসব নিয়েই চলছে জোর গবেষণা, দ্য ফরনাক্স ক্লাস্টার হয়ে উঠেছে অ্যাস্ট্রো ল্যাবরেটরির হট কেক।
সত্যিই ওই আকাশ বড়ই বিচিত্র, ওই আকাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন সাহিত্যিকের সৃজনীশক্তি বাড়িয়ে তোলে, তেমনি আবার তার বৈচিত্র্য বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার পারদটাও চড়চড় করে বাড়িয়ে দেয়। আমারও খুব বলতে ইচ্ছে করছে, শুনছ মহাকাশ (Space) তোমার বুকে কারা/এমন মিটিমিটি জ্বলে, নাম দিয়েছে সবাই ওদের তারা/ ওরা কি সব তোমার চোখের মণি? তোমার সঙ্গে ঘর বেঁধেছে, দিচ্ছে ডাকে সাড়া।