অসামান্যা অসীমা

সেই সময়ের মেয়েদের বিজ্ঞানচর্চা ছিল অলীক কল্পনা। বিজ্ঞান গবেষণা তো দূরস্থান, কেরিয়ার হিসেবে বিজ্ঞানকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি ছিল হাতে গোনা। সেই প্রতিকূল পরিবেশে ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষণায় এনেছিলেন নবজাগরণ। আবিষ্কার করেছিলেন দিগন্তকারী ওষুধ। তিনি ভারতের প্রথম মহিলা রসায়নবিদ ড. অসীমা চট্টোপাধ্যায়। জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

নবজাগরণের রূপকার
বাঙালির বিজ্ঞানচর্চায় নারী! উনিশ শতক আর বিশ শতকে এ ছিল যেন এক সোনার পাথরবাটি। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু আর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়— এই দুই বরেণ্য বৈজ্ঞানিকের হাত ধরে ঊনবিংশ শতকে বাঙালির বিজ্ঞান গবেষণার অগ্রগতি, সেই সূত্র ধরে একে একে বিজ্ঞানচর্চায় অবদান রেখেছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, পুলিনবিহারী সরকার প্রমুখ। কিন্তু কোথাও যেন অসম্পূর্ণ ছিল সেই ইতিহাস। সেই বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে একটা সময় বিজ্ঞানচর্চার অসম্পূর্ণ ইতিহাসকে পূর্ণ করলেন কতিপয় বাঙালি মহিলা বিজ্ঞানী। বাংলার বিজ্ঞানচর্চার নবজাগরণের অন্যতম রূপকার তাঁরা। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্যা প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্নেহধন্যা জৈবরসায়নবিদ ড. অসীমা চট্টোপাধ্যায় (Asima Chatterjee)। ভারতের প্রথম মহিলা রসায়নবিদের তকমাটা তাঁর ঝুলিতেই। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন তাঁর পথপ্রদর্শক বা ‘মেন্টর’।
আয়ুর্বেদশাস্ত্রে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সফল মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন ড. অসীমা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উদ্যোগেই প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের আলোকে আলোকিত হয়।

পেয়েছিলেন বরেণ্য গবেষকদের
এগিয়ে চলার পথটা খুব সহজ ছিলা না তাঁর। তবু এগিয়েছেন নিজের জেদ, গভীর অধ্যবসায়ের জোরে। গবেষণায় তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, চেষ্টা আর কৌতূহল দেখে তাঁর গবেষণা বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র নিজে। দীর্ঘ সময় ধরে পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁকে গবেষণাকার্যে সহায়তা করেছিলেন। একবার তাঁর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছিলেন— ‘‘বিজ্ঞান কলেজে সন্ধের পর যখন সব ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায় তখন যে একটা ঘরে দেখবে আলো জ্বলতে সেটা অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের ঘর। অসীমা চট্টোপাধ্যায় (Asima Chatterjee) মানেই তিনটে ডি— ডিভোশন, ডিউটি ও ডেডিকেশন।’’

রসায়নবিদ্যায় বিদুষী
আমাদের আশপাশে অযত্নে পড়ে থাকা গাছগাছড়ার গুণাবলি জানেন ক’জন মানুষ! সেইসব গাছ-গাছড়ার ঔষধি গুণ কাজে লাগিয়ে মানুষকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন বিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায়। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে মৃগী ছিল এক এমন অসুখ যা সারাতে তুকতাক, জলপড়া, ওঝাই ছিল একমাত্র পথ। সাধারণ মানুষকে এই অসুখের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন তিনি। ছাত্রী-জীবনের শুরু থেকেই রসায়নবিদ্যা অধ্যয়নের ইচ্ছে ছিল তাঁর। বেথুন স্কুল থেকে পাশ করার পরে ১৯৩৬ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে সেই স্বপ্নের পথচলা শুরু। ১৯৩৮ সালে সফল ও সার্থকভাবে রসায়নবিদ্যায় স্নাতক হন অসীমা, ১৯৪০ সালে স্নাতকোত্তর। ওই বছরেই লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে শুরু হয় রসায়ন বিভাগ। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯৪৪ সালে রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম রসায়নের মহিলা ডক্টরেট ডিগ্রিধারী হলেন অসীমা চট্টোপাধ্যায়— যার পোশাকি নাম তখন ছিল ‘ডক্টর অফ সায়েন্স’ বা ডিএসসি। এ-ছাড়া ১৯৪০ সালেও গবেষণা জীবনের প্রায় শুরুতেই তিনি পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগমায়া দেবী স্বর্ণপদক, ১৯৪২-এ নাগার্জুন পুরস্কার ও প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ উপাধি।

দিগন্তকারী আবিষ্কার
ভারতীয় উপমহাদেশে বেড়ে ওঠা অজস্র গাছগাছড়া যারা যত্ন পায় না তারাই ছিল অসীমার জগৎ। বিভিন্ন গাছ থেকে পাওয়া অ্যালকালয়েড বা উপক্ষার, কুমারিন, টারপিনয়েড— এইসব রাসায়নিক পদার্থের ভেষজগুণ ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়। শুষনি শাক, চিরতা, কুটকি গাছ থেকে মৃগী রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। নয়নতারা গাছ থেকে পাওয়া অ্যালকালয়েডস ব্যবহার করে ক্যানসার রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন যার নাম ভিঙ্কা অ্যালকালয়েড। যা কেমোথেরাপিতে আজও ব্যবহৃত হয়। একরকম অ্যালকালয়েডসের বিভিন্ন রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে গবেষণা করে দেখিয়েছিলেন এক ধরনের উপক্ষার থেকে পাওয়া যেতে পারে অনেক রোগের ওষুধ। ছাতিম গাছ থেকে পাওয়া উপক্ষার ব্যবহার করে ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরি করেছিলেন অসীমা চট্টোপাধ্যায় (Asima Chatterjee)।

আরও পড়ুন- নতুন দুই ধারাবাহিক

বিদেশে গবেষণা
১৯৪৫-এ বিয়ে হয় প্রখ্যাত রসায়নবিদ বরদানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। গবেষণাকার্যে অসীমার অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন স্বামী।১৯৪৭-৫০ এই তিন বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালটেক এবং সুইজারল্যান্ডের জুরিখে উচ্চতর গবেষণার জন্যে ছিলেন। ক্যালটেকে থাকার সময় তিনি দুবার নোবেল পুরস্কার জয়ী রসায়নবিদ লিনাস পলিং-এর সাহচর্য লাভ করেছিলেন। আমৃত্যু তাঁদের মধ্যে সেই ঘনিষ্ঠতা বজায় ছিল। জুরিখে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পল কারেরের সঙ্গেও কাজ করেছিলেন অসীমা।

দেশের সাফল্যেও শীর্ষে
১৯৫৪ সালে তিনি রাজাবাজার ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্সে রসায়ন বিভাগের সহ-অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এর পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদে যোগ দিয়েছিলেন। পরে সে বিভাগেই ‘খয়রা অধ্যাপক’ রূপে কাজ শুরু করেছিলেন। এরপর ১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ‘ভারতীয় বনৌষধি’ নামে ছ-খণ্ডের গবেষণাধর্মী বইও লিখেছিলেন। অসীমা চট্টোপাধ্যায় সত্যেশচন্দ্র পাকড়াশির সঙ্গে যৌথভাবে রচনা করেন ‘দ্য ট্রিটিজ অব ইন্ডিয়ান মেডিসিন্যাল প্ল্যান্টস’ শীর্ষক গ্রন্থ৷

সম্মাননা
১৯৬০ সালে ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সেস ইন ইন্ডিয়া’র ফেলো নির্বাচিত হন। ভারতে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মান শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার পান রসায়ন গবেষণায় তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য। পেয়েছেন পদ্মভূষণ’ সম্মান। ১৯৭৫-এ ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে প্রথম মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রায় ৪০০টিরও বেশি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর লেখা। বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকেও সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তাঁর কাজ। তাঁরই প্রচেষ্টায় সল্টলেকে গড়ে ওঠে আয়ুর্বেদ গবেষণা কেন্দ্র৷ দীর্ঘ কর্মবহুল জীবন-শেষে অসীমা চট্টোপাধ্যায় ২০০৬ সালের ২২ নভেম্বর পরলোকে পাড়ি দেন।

Latest article