সবুজ ঘন জঙ্গলে ঘেরা এক সুউচ্চ পাহাড়। প্রায় ১৪৮০ ফুট। দূরে কোথাও নয়, আমাদের রাজ্যেই। ঘরের কাছে, বাঁকুড়া জেলায়। নাম বিহারীনাথ পাহাড় (Biharinath in Bankura)। পর্যটকরা কেউ কেউ বলেন, পশ্চিমবঙ্গের আরাকু ভ্যালি।
বিহারীনাথ হল বাঁকুড়া জেলার উচ্চতম পাহাড় এবং অন্যতম গভীর বনাঞ্চল। ছোট নাগপুর মালভূমির অংশ। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। জঙ্গলে শোভা পায় নানা রকমের গাছ। কোনওটা ফলের, কোনওটা ফুলের। রংবেরঙের ফুল। আছে বাহারি গাছও। সবমিলিয়ে এই আদিম পাহাড় প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের হাতছানি দেয়।
বিশেষত বর্ষায়, বৃষ্টিধোয়া অঞ্চলটি সবুজে সবুজে আরও রঙিন হয়ে ওঠে। মুখরিত হয়ে ওঠে বর্ষণগীতে। ছোট-বড় বৃষ্টিফোঁটা পাতায় পাতায় জলতরঙ্গ বাজিয়ে যায়। পাহাড়ের গা-বেয়ে নেমে আসে জলধারা। ঝর্নার মতো। মনের মধ্যে আনন্দ সঞ্চার করে। মাটি থেকে উঠে আসে সোঁদা গন্ধ। প্রকৃতির বুকে লেখা হয় এক অসামান্য মহাকাব্য।
অন্য সময়েও দেখা যায় পাহাড়ের মন-মাতাল-করা রূপ। বসন্তে, শরতে। বিশেষত দুর্গা পুজোর সময়। নির্জন নিরিবিলি পাহাড় ও জঙ্গল যাঁরা ভালবাসেন, এই জায়গা তাঁদের দু-দণ্ড শান্তি দেবে।
নানারকম পশু দেখা যায় এই পাহাড়ে। যেমন, বন্য শূকর, গিরগিটি, শেয়াল, খরগোশ, বনরুই, হায়না, গিরগিটি ইত্যাদি। ডালে-ডালে উড়ে বেড়ায় নানা ধরনের পাখি। কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে আলোকালো পাহাড়ি অঞ্চল। সরু পথে বায়নোকুলার এবং ক্যামেরা ঝুলিয়ে আপনমনে ঘুরে বেড়ানো যায়। পুরাতাত্ত্বিক মহলেও এই পাহাড় ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এই এলাকায় কিছু প্যালিওলিথিক প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার হয়েছে।
সাধারণ পর্যটকদের পাশাপাশি ট্রেকারদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গা বিহারীনাথ। রক ক্লাইম্বার হিসাবে অনেকেই এখান থেকে যাত্রা শুরু করেন।
আরও পড়ুন:বঙ্গে নারীশক্তির জাগরণ, জননেত্রীই কান্ডারি
বিহারীনাথ মন্দির অবস্থিত এই পাহাড়ের ঠিক নিচেই। মন্দিরের আরাধ্য দেবতা শিব। দেবাদিদেব মহাদেব। দেবতার নামেই সম্ভবত পাহাড়ের নামকরণ। সারা বছর বহু মানুষ আসেন। পুজো দেন। মন্দিরে ভক্ত সমাগম সবথেকে বেশি দেখা যায় শিবরাত্রির দিন। বসে জমজমাট মেলা। পাশাপাশি শ্রাবণ মাসেও প্রচুর লোকসমাগম হয়। জ্বলে ধূপ-দীপ, বাজে ঘণ্টা। তৈরি হয় এক অন্যরকম পরিবেশ। মন্দিরের কাছেই আছে একটি পুকুর। এই পুকুরটিকে স্থানীয় মানুষজন অত্যন্ত পবিত্র বলেই মনে করেন। পাশাপাশি আছে একটি সুদৃশ্য জলাধার।
পাহাড়ের আশেপাশে আছে বেশ কয়েকটি আদিবাসী গ্রাম। বেড়াতে গিয়ে ঘুরে দেখা যায় অচেনা-অজানা ছোট-ছোট গ্রাম। পাওয়া যায় আদিবাসী সংস্কৃতির ছোঁয়া। প্রত্যেকটি গ্রাম পরিচ্ছন্ন। নিকোনো উঠোন। বাড়ির মাটির দেওয়ালে নানা রঙের আলপনা। সন্ধেবেলায় কোনও কোনও দিন বসে নাচগানের আসর। বেজে ওঠে ধামসা-মাদল। এই অঞ্চলের গ্রামবাসীরা অতিথিদের দেবতাজ্ঞানে পুজো করেন। আসরে অযাচিতভাবে গিয়ে পড়লে তাঁরা খুশিই হন। পেতে দেন খাটিয়া, মাদুর, এনে দেন জল-বাতাসা। নাচের তালে অনেকেই তাঁদের সঙ্গে কোমর দোলান।
বিহারীনাথ পাহাড়ের (Biharinath in Bankura) আশেপাশে আছে বেশ কয়েকটি বেড়ানোর জায়গা। যেমন শুশুনিয়া পাহাড়, গড়পঞ্চকোট, জয়চণ্ডী পাহাড়, পাঞ্চেত বাঁধ, মাইথন বাঁধ, কল্যাণেশ্বরী মন্দির। হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসা যায়। অনেকেই মেতে ওঠেন পিকনিকে। তবে পাহাড়ি এলাকায় যা কিছু ঘোরাঘুরি, সমস্তই দিনের আলোয়। সন্ধের পর একদম না। ঝমঝম ঝিরঝির বৃষ্টির মরশুমে দুই-তিনদিন বিহারীনাথ পাহাড় মন্দ লাগবে না।
কীভাবে যাবেন?
বিহারীনাথ পাহাড় বাঁকুড়া থেকে প্রায় ৫৭ কিলোমিটার এবং রানিগঞ্জ থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে। হাওড়া থেকে বাঁকুড়া ট্রেনে যাওয়া যায়। বাঁকুড়া থেকে বিহারীনাথ পাহাড়ে যেতে হয় গাড়ি ভাড়া করে৷ আসানসোল থেকে মধুকুণ্ড রেল স্টেশনে নেমেও গাড়ি করে বিহারীনাথ যাওয়া যায়। আবার রানিগঞ্জ স্টেশনে নেমেও বিহারীনাথ যাওয়া যায়, ভাড়া গাড়িতে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথে আদ্রাগামী ট্রেনে ছাতনা স্টেশনে নেমে বাসে যাওয়া যায়। আসানসোল, দুর্গাপুর, বর্ধমান, পানাগড় এবং রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ আছে বাঁকুড়া এবং বিহারীনাথের।
কোথায় থাকবেন?
বিহারীনাথ পাহাড়ের আশেপাশে আছে কিছু ছোট হোটেল, রিসর্ট। আগে থেকেই বুক করা যায়। আছে পঞ্চায়েত সমিতির ঘর। পাওয়া যায় স্বল্পমূল্যে। যাওয়ার আগে দেখে নেবেন পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ওয়েবসাইট। গাইড হিসেবে পাওয়া যায় স্থানীয় মানুষদের। যোগাযোগ করতে হয় হোটেল, রিসর্টের কর্মীদের সঙ্গে।