বঙ্গে নারীশক্তির জাগরণ, জননেত্রীই কান্ডারি

মা-মাটি-মানুষের সরকার রাজ্যের জনসাধারণের আশিস লাভ করেছে তৃতীয়বারের জন্য। এই কাল-পর্বে সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য আবিষ্ট একটি বিন্দুতেই। সেটি হল মহিলাদের সশক্তিকরণ। কেন? তারই উত্তর খুঁজলেন শিক্ষিকা মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়

Must read

২০২১ সালের ২রা মে। গোটা ভারতবর্ষের মানুষ রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত কাটিয়েছে এবং অবশেষে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, আপামর ভারতবাসীর এক বৃহৎ অংশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন একটি মাত্র খবরে। বাংলায় তৃতীয়বার সরকার করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee CM of WB)। আজ ভারতের যে প্রান্তেই যাওয়া যাক, এই নামটি সর্বজন পরিচিত। হিমালয়ের মতো যার উচ্চতা। কেন্দ্রে বসে থাকা দেশের সর্ববৃহৎ দল তাদের অর্থ, পেশিশক্তি, কৌশল, পরিকাঠামো সবকিছুকে চূড়ান্ত কাজে লাগিয়েও তাঁর পায়ে নত হতে হয়েছে। সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক নন এমন ব্যক্তিও সেদিন দুই হাত তুলে নমস্কার জানিয়েছেন এই অসামান্যাকে।

আর আজ এই ২০২২-এর মধ্যভাগে তিনিই একমাত্র দাঁড়িয়ে আছেন শত ছলনার সামনে অকুতোভয়ে। তাঁকে নিয়ে অহংকারের অন্যতম কারণ তিনি নারী। এই মুহূর্তে এ-দেশের রাজ্যগুলিতে একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী (Mamata Banerjee CM of WB)। এমনিতেই ভারতের রাজনৈতিক পরিসরে ওপর তলায় মহিলাদের স্থান সংকুচিত। মোদি সরকার তিন তালাক তুলে দিয়ে মহিলাদের বিরাট উপকার করার আস্ফালন করলেও লাগাতার এত বছর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও সংসদে মহিলার সংরক্ষণ বিল নিয়ে একটিও উচ্চবাচ্য করেননি। প্রসঙ্গত মনে করতে হবে ১৯৯৮ সালের ১১ ডিসেম্বর লোকসভার জনৈক সদস্য মহিলা সংরক্ষণ বিলের বিরোধিতা করতে গিয়ে ওয়েলে নেমে পড়লে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে সরিয়ে দেন।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে মেয়েদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিতে। নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তর থাকলেও সাধারণত মেয়েদের অবস্থান এবং তাঁদের কল্যাণ কোনও কিছু নিয়েই সরকারি অফিসে আগে কারও উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার ক্ষেত্রে স্কুলছুট হওয়া, বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মাতৃত্ব ইত্যাদি স্বাভাবিক বিষয় ছিল। শিক্ষার অধিকার আইন লাগু হওয়ায় কিছুটা চাপ এলেও তা কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। সার্বজনীন নারী-শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়ে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সবুজ সাথী মেয়েদের ঘর এবং বিদ্যালয়ের দূরত্ব কমিয়েছে, তাকে দিয়েছে চলার স্বাধীনতা। আর রয়েছে যুগান্তকারী কন্যাশ্রী প্রকল্প। বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এমন কার্যকরী প্রকল্প গোটা দেশে কোথাও নেই। সবচেয়ে বড় কথা, শুধু গালভরা ঘোষণা নয়, পদে পদে কার্যকরী হয়ে চলেছে এই প্রকল্প। যে-দেশে কন্যা দায়, সেখানে তিনি কন্যাকে দিলেন ‘শ্রী’। আজ যে-কোনও স্কুলে কন্যাশ্রী ক্লাব, সেখানে যুক্ত উজ্জ্বল ঝকঝকে মেয়েরা দেশের নির্ণায়ক ভূমিকায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তাই আন্তর্জাতিক সম্মান এসেছে বাংলার ঘরে।‌ স্কুলে যাঁরা যুক্ত আছেন তাঁরা দেখেছেন এই প্রকল্পের কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকস্তরে ছাত্রী-সংখ্যা বেড়েছে, উচ্চশিক্ষায় তার টিকে থাকাকে আরও নিশ্চিত করেছে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড। অনেক মেয়ের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। যারা এই স্বপ্ন দেখার কথাও কখনও ভাবেনি তারাই এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই ক্রেডিট কার্ডের জোরে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পেশায় ঢোকার প্রশিক্ষণ নিতে পারছে।

আরও পড়ুন: মহান মানুষেরা বিভেদ করেন না: পাহাড়ে বাংলা ভাগের বিরোধিতায় বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

তবে মমতা ব্যানার্জির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হল লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প। বিষয়টি আপাতভাবে ছোট মনে হলেও এর ব্যাপ্তি বিশাল। এই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প চালু হওয়ার পরই প্রথম দেখা গেল বহু পরিবার তাদের মেয়েদের তফসিলি জাতি বা জনজাতির শংসাপত্র তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছে। এতকাল ধরে মেয়েদের এই পরিচিতিকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। তার উপর যে-সমস্ত পরিবারে পুরুষ নেই, সেখানে একাধিক মহিলা এই প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার কারণে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে। সাধারণ পরিবারের কাছে খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্প যেখানে মহিলারা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন— সব দিক দিয়েই সমাজে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা করে চলেছে।
মেয়েদের জন্য ব্যতিক্রমী ভাবনা কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বরাবরই ভেবেছেন। রেল দপ্তরে থাকাকালীন তিনি মহিলাদের জন্য স্পেশ্যাল ট্রেন চালু করেছিলেন কেবল বাংলাতে নয় অন্যান্য রাজ্যেও। এই ভাবনাটি খুব অন্যরকম— এর ফলে যে সমস্ত মহিলা প্রতিদিন আপন কর্মস্থলে যান তাঁরা নিরাপদে সসম্মানে সেখানে পৌঁছতে পারেন।
আসলে মেয়েদের কাছে মমতা ব্যানার্জি এক প্রেরণার নাম। যেখান থেকে লড়তে লড়তে তিনি উঠে এসেছেন তা যে কোনও মেয়েকে ভিতর থেকে শক্তি জোগাবে। মমতা ব্যানার্জির উত্থান কোনও পারিবারিক রাজ্যপাট থেকে নয়, পথে নেমে সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করে তিনি এগিয়ে এসেছেন। এই মুহূর্তে ভারতের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী যাঁর দিকে গোটা দেশ তাকিয়ে আছে। প্রচুর মেয়েকে তিনি লোকসভায় পাঠিয়েছেন যাঁরা তাঁরই মতো প্রতিবাদী, যুক্তিনিষ্ঠ ও সরব। ২০১৬ সালে তৈরি করা ‘মা মাটি মানুষ’— এই স্লোগান আসলে সমাজে নারীশক্তিকেই প্রাধান্য দেয়। কিছুকাল আগে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বাংলায় ৭৬.৫% মহিলা যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯-এর মধ্যে, তাঁদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে যা তাঁরা নিজেরাই চালান। রয়েছেন ৭০০০ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং কয়েক লক্ষ আশাকর্মী। এঁরা সবাই দিদির সৈনিক।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একই সঙ্গে বাংলা এবং ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ধারক। রবীন্দ্র-নজরুল ঐতিহ্যের পরম্পরাকে তিনি ধরে রেখেছেন উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সেই ভারতীয়ত্বে যার ভিত্তিতে তৈরি এদেশের সংবিধান। তাই এ-দেশের গণতান্ত্রিক মানুষ আজ কেন্দ্রের বিভেদকামী বিদ্বেষমূলক রাজনীতির বিপ্রতীপে তাঁকেই ভরসা করেন। স্বাধীনতার স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা একমাত্র তিনিই— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Latest article