বিজেপির বিপুল ঢক্কানিনাদই সার হল ব্রিগেডে গীতাপাঠের (Bhagavad Gita) অনুষ্ঠানের একটি ফ্লপ শো-এর মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানের ট্যাগলাইন ছিল— ‘লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ’। এক লাখ তো দূর, মেরেকেটে হাজার বিশেক লোকও আসেনি এই অনুষ্ঠানে। আর বিজেপি-পোষিত মিডিয়া বিশেষ অ্যাঙ্গল থেকে ছবি তুলে সারাদিন প্রচারের চেষ্টা চালাল না জানি কত লক্ষ লক্ষ লোক ভিড় করেছিল এই অনুষ্ঠানে। আরও একবার বোঝা গেল ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গীতা রয়েছে বাঙালি হিন্দুর হৃদয়ে, কিন্তু বাস্তবে বাঙালি গীতাকে এইভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ঘোর বিরোধী!
কিন্তু মিডিয়া বাইট দিতে গিয়েই ছড়িয়ে লাট করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। তিনি বলেছেন— ‘যাঁরা বলছেন, বিবেকানন্দ বলেছিলেন গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেললে স্বর্গের বেশি কাছাকাছি পৌঁছনো যায়, তাঁরা সব বামপন্থী প্রোডাক্ট।’ তাই নাকি? বিবেকানন্দ নিয়ে এহেন উক্তি আরও একবার প্রমাণ করল, আরএসএস নামক ফ্যাসিস্ত সংগঠনটি বাঙালি মনীষীদের কতখানি অপছন্দ করে। নইলে স্বামীজি সম্পর্কে এরকম মন্তব্য রাজ্য বিজেপি সভাপতি করতেন না। এই উক্তি বাঙালি মনীষার ধারাবাহিক ইতিহাস সম্পর্কে ওঁর অজ্ঞতা ও মূর্খতার পরিচায়ক।
স্বামীজি কোন প্রেক্ষিতে এই কথাগুলি বলেছিলেন, একবার মনে করা যাক। লেখাটির নাম ‘ভারতীয় জীবনে বেদান্তের কার্যকারিতা’। ১৮৯৭ সালে বিদেশ থেকে ফেরার পর স্বামীজি দেশের বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। দক্ষিণ ভারতের কুম্ভকনমের একটি সংবর্ধনা সভায় এই বক্তৃতা দেন তিনি। পরে বক্তৃতাটি প্রবন্ধের আকারে সঙ্কলিত হয় স্বামীজির ‘লেকচার্স ফ্রম কলম্বো টু আলমোড়া’ বইয়ে। বক্তৃতায় স্বামীজি বলছেন— ‘হে আমার যুবক বন্ধুগণ, তোমরা সবল হও— তোমাদের নিকট ইহাই আমার বক্তব্য। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে। আমাকে অতি সাহসপূর্বক এ-কথাগুলি বলিতে হইতেছে, কিন্তু না বলিলেই নয়… তোমাদের বলি, তোমাদের শরীর একটু শক্ত হইলে তোমরা গীতা (Bhagavad Gita) আরও ভাল বুঝিবে। তোমাদের রক্ত একটু তাজা হইলে তোমরা শ্রীকৃষ্ণের মহতী প্রতিভা ও মহান বীর্য ভালো করিয়া বুঝিতে পারিবে… অনন্ত শক্তি, অনন্ত বীর্য, অনন্ত শুদ্ধত্ব ও অনন্ত পূর্ণতার তত্ত্ব অবগত হওয়া।’
আরও পড়ুন- মোদি-সেলফি পয়েন্টের খরচ প্রকাশ করায় বদলির কোপ
যখন স্বামীজি এই কথাগুলি বলছেন, তখন পরাধীন ভারতবর্ষ। দেশের হৃতবীর্য যুবসম্প্রদায়কে উজ্জীবিত করার জন্যই গীতাদর্শনের সারমর্ম এক অন্য মাত্রায় নিয়ে এসে ব্যাখ্যা করছেন তিনি। স্বদেশি আন্দোলনের যুগ আরম্ভ হয়নি তখনও। পাড়ায় পাড়ায় আখড়া তৈরি হচ্ছে। ব্যায়াম, লাঠিখেলা, শরীরচর্চার যুগ শুরু হবে এইসময়। ঠিক সেই প্রেক্ষিতে স্বামীজির এই কথাগুলি যুবসম্প্রদায়কে শারীরিক ও মানসিকভাবে বলযুক্ত করে তোলার উদ্দেশ্যেই বলা। অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা ঠিক এই লক্ষ্য সামনে রেখেই গীতাকে আদর্শ মেনেছিলেন। আর সেই আদর্শের সুর বেঁধে দিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ। ঠিক এই প্রসঙ্গেই তাঁর এই লেখার অব্যবহিত আগের বাক্যগুলোও একবার স্মরণ করা দরকার— ‘আমরা শত শত শতাব্দী যাবৎ এই লইয়া বিবাদ করিতেছি, তিলক ধারণ এইভাবে করিতে হইবে কি ওই ভাবে। কোনও মানুষের দৃষ্টিতে আমার খাওয়া নষ্ট হইবে কিনা, এই ধরনের গুরুতর সমস্যার উপর বড় বড় বই লিখিতেছি। যে-জাতির মস্তিষ্কের সমূদয় শক্তি এইরূপ অপূর্ব সুন্দর সুন্দর সমস্যার গবেষণায় নিযুক্ত, সে-জাতির নিকট হইতে বড় রকমের কিছু আশা করা যায় না, এরূপ আচরণে আমাদের লজ্জাও হয় না।’
ওয়াকিবহাল মহল জানেন, এই কথাগুলো আসলে হিন্দু জাতির কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদের বিরুদ্ধে বিবেকানন্দের স্বল্পজীবনব্যাপী লড়াইয়ের অভিমুখ থেকেই রচিত। সঙ্ঘ পরিবার, যাদের তাত্ত্বিক নেতা সাভারকার ও মাধব গোলওয়ালকর ‘এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষা, এক নেতা, এক গেরুয়া পতাকা, এক সংস্কৃতি, এক খাদ্যাভ্যাস’-এর ফ্যাসিবাদী তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন তাঁদের ‘হিন্দুত্ব : হু ইজ আ হিন্দু?’ এবং ‘বান্চ অফ থটস’, ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনস’ ও অন্যান্য লেখায়, তাঁরা আসলে ভারতের বহুযুগ ধরে চলতে থাকা বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, ভাষাগত ও জাতিগত বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতাকে ধ্বংস করে একপাথুরে অভিন্ন সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চায়। তারা চায় দেশের ‘ইউনিয়ন অফ স্টেটস’-এর চরিত্রকে অস্বীকার করে চরম কেন্দ্রীভূত, একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে এবং সেই উদ্দেশ্য পূরণ করতে তারা যেকোনও ধরনের কৌশল ও বলপ্রয়োগেও পেছপা নয়। অর্থাৎ, সঙ্ঘের ফ্যাসিবাদী ভাবধারার সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের উদার ও ইনক্লুসিভ হিন্দুধর্মের চূড়ান্ত পার্থক্য আছে। জুডাইজম ও জিয়নিস্ট মতবাদ যেরকম এক নয়, সেরকমই সমন্বয়ী উদার হিন্দুধর্ম এবং সঙ্ঘের রাজনৈতিক হিন্দুত্বও এক নয়। দুয়ের ভিতর আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে।
কোনওভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলার মানুষের হার-না-মানা লড়াইকে পর্যুদস্ত করতে না পেরে সঙ্ঘ পরিবার এইবার চাইছে উগ্র পলিটিক্যাল হিন্দুত্বের লাইনে বাংলার হিন্দু ভোট সংহত করতে। সেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই ব্রিগেডে গীতাপাঠের মতো উদ্ভট আয়োজন তাদের। কিন্তু বাংলার মানুষ গীতাকে (Bhagavad Gita) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা মানবেন না কখনও।