‘মাথায় চেরন দিবি নে। চুলে খোঁপা দিয়ে থাকবি। তেল দিবিনে মাথায়। ঘরে লেপন দিবিনে। পর পুরুষের সঙ্গে কথা কওয়া বারণ। সবই তো মেনে ছিলাম। তাও স্বামীডারে বাঘে ধরে নিয়ে গেল। আর এখন আমারে রাক্ষুসি বানিয়ে শাশুড়ি তাড়িয়ে দিল।’
সাতক্ষীরার সুন্দরবন উপকূলের গ্রামের বাঘবিধবা শরবানু খাতুনের করুণ আর্তি ছিল এটাই। বাঘে খেয়েছিল তাঁর স্বামীকে।
শুধু শরবানু খাতুন নন সুন্দরবন উপকূলের গ্রামগুলোর বিধবাপল্লির প্রতিটা বাঘবিধবার এমনই করুণ জীবনচিত্র। এইসব বাঘবিধবা তথা সুন্দরবনের জেলে, বাওয়ালি, মৌয়ালদের কষ্ট, দুর্দশা, জীবনসংগ্রাম সিনেমার বিষয়বস্তু হিসেবে সবসময়ই খুব জোরদার। তাই চলচ্চিত্র পরিচালকদের খুব পছন্দের পটভূমি এই সুন্দরবন। তাঁরা তাঁদের কল্পনার বাস্তব রূপদান করতে অনেক সময়ই বেছে নিয়েছেন সুন্দরবনকে। তাই এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের আদিম জীবন, তাঁদের লোকগাথা, দেব-দেবীরা মাঝেমধ্যে উঠে আসে ছবির পর্দায়। সামনের সপ্তাহেই মুক্তি পাচ্ছে পরিচালক রাজদীপ ঘোষের ছবি ‘বনবিবি’ (Bonbibi)। এখানেও বিষয় সেই সুন্দরবন। সেখানকার প্রচলিত সংস্কার লৌকিক দেবদেবী যেমন বনবিবি, দক্ষিণরায়ের লৌকিকগাথা এবং বাঘবিধবাদের জীবনযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে এই ছবি।
যার ট্রেলার দেখে একটা সময় মনে কৌতূহল জেগেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ট্রেলার শেয়ার করেই কয়েকদিন আগেই ক্যাপশনে দেওয়া হয়েছিল ‘জঙ্গলে প্রবেশের পূর্বে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, এখানে ভয়ঙ্কর শিকারি শুধু জলে এবং ডাঙায় নয়, থাকতে পারে আপনার সাথেও’। লেখাটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ছবির ভাবনা।
সুন্দরবনের মানুষেরা বনবিবির (Bonbibi) পুজো করেন। সেখানে থাকা নির্বিশেষ মানুষই বিশ্বাস করেন ভক্তিভরে পুজো করলে খুশি হবেন দেবী এবং তাঁরা থাকবেন সুরক্ষিত। কিন্তু বনবিবি কি পারবেন ক্ষমতাবান অন্ধকার জগতের মানুষদের থেকে তাঁদের রক্ষা করতে? রাণা সরকার নিবেদিত এই ছবি সেই উত্তরই খুঁজবে। যার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেশম। সে একজন বাঘবিধবা। তিনবছর আগে তার স্বামীকে বাঘে নিয়ে যায়। তারপর পেটের দায় সুন্দরবন এলাকাতে গাইডের কাজ করে রেশম। এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের সুন্দরবন ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ঘুরে দেখানোই তাঁর পেশা। বাকি সময়টা রেশম গ্রামের শিশুদের শিক্ষিত ও সাহসী করে তোলার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এই ছবি এক নারীর লড়াইয়ের গল্প। সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে তাঁর জয়ী হওয়ার গল্প। যুগে যুগে মেয়েদের উপর অন্যায় নিয়মের জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দিয়েছে আমাদের সমাজ, সেই চাপিয়ে দেওয়া নানা অন্যায় নিয়মের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়বে রেশম। বাঘবিধবাদের দলে নাম লিখিয়েও কীভাবে সমাজের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে ফের ভালবাসার স্বপ্ন দেখে রেশম পাশাপাশি অন্য নারীদেরও উত্তরণের পথ দেখায়, এই ছবিতে সেটাই দেখবে দর্শক।
আরও পড়ুন- ক্ষমতা থাকলে দেখান করে তারপর জ্ঞান দিন ঝুলি ভরে
ছবিতে রেশমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী পার্নো মিত্র। বহুদিন পরে পার্নোকে দেখতে পাওয়া যাবে বড়পর্দায়। এই ছবির অপর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন মুম্বইয়ের স্বনামধন্য অভিনেতা দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য। এখানে তাঁর চরিত্রের নাম ‘জাহাঙ্গির’। এক দুর্দান্ত খারাপ লোক, খুনি। এহেন জাহাঙ্গির বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ফিরেছিল তাই এলাকার লোক তাকে ডাকে ‘খোঁড়া বাদশাহ’ নামে। এই জাহাঙ্গিরের বিরুদ্ধেই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নামে রেশম, প্রতিবাদে সরব হয়।
‘বনবিবি’ (Bonbibi) নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত পার্নো। অনেকেই ভেবেছেন এটা পার্নোর কামব্যাক, কিন্তু তা নয়। সেই ভুল ভাঙালেন অভিনেত্রী নিজেই। এই প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, করোনাকালে পুরো ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ ছিল। কোনও কাজ হয়নি। আমার বেশ কিছু ছবির রিলিজ পিছিয়ে যায়। জমে থাকা সেই ছবি এখন একে একে মুক্তি পাচ্ছে। ‘বনবিবি’ তারই একটা। আমরা সকলে প্রচুর পরিশ্রম করেছিলাম এই ছবির জন্য। সুন্দরবন অসাধারণ জায়গা। দিন পনেরোর শিডিউল ছিল। ১৭, ১৮ ঘণ্টা শ্যুটিং হয়। দু-বছর আগে শ্যুটিং সারা হয়েছিল। ছবিটা শেষ পর্যন্ত মুক্তি পাচ্ছে বলে আমি খুশি।
এই ছবিতে তাঁর চরিত্র প্রসঙ্গে পার্নো জানান— এই ছবির গল্প ও চিত্রনাট্য অসাধারণ। শুনেই খুব ভাল লেগে যায়। সুন্দরবনের প্রেক্ষাপটে বনবিবি লোকগাথাকে যেভাবে এই ছবির চিত্রনাট্যে বাঁধা হয়েছে তা শুনে চমকে উঠেছিলাম। রেশম চরিত্রটির যেভাবে উত্তরণ ঘটেছে এই ছবিতে তা যেন কোথাও নারীবাদের জয়গান গেয়েছে। তা ছাড়া চিত্রনাট্য পড়েই বুঝেছিলাম রেশমের সঙ্গে বেশ কিছু ব্যাপারে আমারও যথেষ্ট মিল রয়েছে। বাস্তবের আমি আর সুন্দরবনের রেশম দুজনেই নারীবাদে বিশ্বাসী।
‘বনবিবি’তে (Bonbibi) পার্নো ও দিব্যেন্দু ছাড়াও আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছে সোহিনী সরকার ও রূপাঞ্জনা মিত্র। পার্নোর বিপরীতে রয়েছেন অভিনেতা আর্য দাশগুপ্ত। স্পেশাল পুলিশ অফিসার হিসেবে দেখতে পাওয়া যাবে রণজয় বিষ্ণুকে, এছাড়া রয়েছেন মিশকা হালিম, ভাস্কর, সুলগ্নার মতো একগুচ্ছ নতুন মুখ। ছবির কাহিনি এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন রোহিত সৌম্য। সংলাপ অন্নপূর্ণা বসু এবং রোহিত সৌম্য। প্রযোজনায় রাণা সরকার এবং সায়নদীপ ধর। ক্যামেরায় সুপ্রিয় দত্ত। ‘বনবিবি’র মিউজিকে রয়েছে বিশেষ চমক। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে সৌম্যদীপ শিকদার ও সপ্তক সানাই দাস। বনবিবি যাত্রাপালায় যে গান ব্যবহার করা হত সেই গানের ঝলক থাকবে এখানে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে বনবিবি ছবির একটি গান। ইমন চক্রবর্তীর গাওয়া এই লোকগানটিতে সুন্দরভাবে উঠে এসেছে সুন্দরবনের মানুষের জীবনধারণের পাঁচালি। এ ছাড়াও ছবিতে গান গেয়েছেন সোমলতা আচার্য চৌধুরী এবং সাহানা বাজপেয়ী প্রমুখ।
গত ডিসেম্বরে ২৯তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় ‘বনবিবি’। চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটা দেখতে দর্শকদের ঢল নামে। সমালোচকেরাও এই ছবির ভূয়সী প্রশংসা করেন। ইতিমধ্যে সুন্দরবনেও মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। এই প্রথম কোনও ছবির পটভূমিকা যে অঞ্চলে, সেখানে দেখানো হল। সমাজমাধ্যমেও ছবিটি নিয়ে কলাকুশলীরা অনেক শুভেচ্ছাবার্তা পান। লেখক অমিতাভ ঘোষের লেখা ‘দ্য হাংরি টাইড’ এই ছবির অনুপ্রেরণা বলে জানিয়েছেন পরিচালক রাজদীপ ঘোষ। আগামী ৮ মার্চ ‘বনবিবি’ মুক্তি পাচ্ছে রাজ্য জুড়ে।