এমন দহন দিনে মন যদি চায় শহুরে কোলাহল মুক্ত একটু নরম শীতলতা মোড়া কুয়াশাঘেরা সবুজ পাহাড়ের গন্ধমাখা এক অখণ্ড নীরবতা ভরা দুটো দিন, তাহলে চিমনি হতে পারে তার সঠিক নির্বাচন। এখানে মেঘ গাভীর মতো না চরলেও বনানী বিজনে রোদ কুয়াশার লুকোচুরি খেলা চলে সারাদিন। চিমনি বড়ই শান্ত তাই বড়ই শান্তি। পাইন ছায়ার ঘোমটা মুখে টেনে একটা চকচকে পিচরাস্তা শীতঘুম দেওয়া কালো পাইথনের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে। একটা-দুটো গাড়ি গেলে চায়ের দোকান বা মোমোর স্টলটা একটু চমকে ওঠে, ইতিউতি চায় কাচের গুলির মতো চোখ তুলে কোনও দেবশিশু। ঘন সবুজ নিরালা এই স্বপ্নপুরী বেশিরভাগ সময় ঢেকে থাকে কুয়াশায়। রঙিন চোর্তেনগুলো হাওয়ায় ওড়ে প্রজাপতির মতো। আর কোনও এক রোদ ঝলমল সৌভাগ্যদিনে সাদা পাহাড়চূড়ায় রোদের ঝলকে চলে রঙের হোলিখেলা।
কার্শিয়াং থেকে সামান্য দূরে এই রূপকথার রাজ্য চিমনি (North Bengal- Chimney)। কোলাহল আর দূষণমুক্ত একটুকরো শান্তির আরেক নাম চিমনি। ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের দার্জিলিং যাওয়ার পথের একটু বিরতির জন্য নিরিবিলিতে বানানো এক বাংলো ও তার সঙ্গে একটু উষ্ণতার খোঁজে একটি চিমনি। যার থেকে এই জনপদের নাম চিমনি। কালের প্রভাবে বাংলোটি আর নেই। শুধু আছে নামের সম্মানে চব্বিশ ফুট উঁচু সেই চিমনি। কার্শিয়াং থেকে চকচকে পুরনো মিলিটারি রাস্তা ধরে আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় চিমনি। চিমনিকে ঘিরে আজ ছোট জনপদ, চিমনি হেরিটেজ গার্ডেন। দু’দিনের ছোট্ট ঘোরার পরিকল্পনায় থাকবে অফুরান আনন্দ আর অপার শান্তি। মন জুড়ে ভাললাগার রেশ থাকবে অনেক বসন্ত জুড়ে। এ ভ্রমণ কিন্তু বিলাসিতা ও রাজকীয় ব্যবস্থাপনায় ভরা নয়, সামান্য আয়োজন কিন্তু অসামান্য তার অবদান।
আসল কথায় আসা যাক। চিমনি উত্তরবঙ্গের অতি বিখ্যাত পাহাড়ি শহর কার্শিয়াং থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে একটি শান্ত ছোট জনপদ। কার্শিয়াং রেল স্টেশন থেকে দার্জিলিং যাওয়ার রাস্তায় ডানদিকে বাঘোরা রোড ধরে চলে যাও চিমনি। নিজের গাড়ি নিয়ে না গেলে, কার্শিয়াং থেকে গাড়ি ভাড়া করে চিমনি যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় দেখি না। সবুজের মেখলা আর কুয়াশার ওড়না পরে নিশ্চিন্তে ঘুমোয় চিমনি। গাড়ি থামবে লোয়ার চিমনিতে। নিতান্তই হালে গজিয়ে ওঠা ক’টি পরিছন্ন ছিমছাম হোম-স্টে। তাদের আন্তরিকতায় আছে সাবেকিয়ানা। জীবন যাপনের প্রাথমিক স্বাচ্ছন্দ্যটুকু অবশ্যই পাবেন এখানে, অতিরিক্ত কিছু আশা করে দুঃখ পাবেন না যেন। যদিও প্রয়োজন মানুষের সামান্যই তবুও তার তরে আয়োজন একটু বেশিই হয়ে যায় যেটার আরেক নাম বিলাসিতা।
পৌঁছে তো গেলাম চিমনি (North Bengal- Chimney)। এখন কী করবেন এখানে? ফোন না ঘেঁটে পায়ে হেঁটে ঘুরবেন, আরাম করে গরম গরম মোমো খাবেন আর নিরালায় অনেকটা সময় নিজের সঙ্গে কাটাবেন। হেঁটে উপরে যান, চিমনি হেরিটেজ পার্ক। লাল চিমনির সামনে রকমারি পোজে ছবি তোলা যায়। থোকা থোকা রডোডেনড্রন, ম্যাগনেলিয়া দেখে আনন্দে মাতো, পাইনের বনে হারিয়ে যাও, পাখিদের শিস শোনো, দূরে সূর্যাস্তের সময় আকাশে পাহাড়ে আবির খেলা দেখ। মনে হয় একটা দিনে মন পোষাবে না। ভিউ পয়েন্ট থেকে শিলিগুড়ির সমতলে বালাসন, তিস্তা মহানন্দার জড়াজড়ি দেখতে পাবেন। দূরে সান্দাকফু, আর কত কত নাম করা জনপদের ঘরবাড়ি ঝুলনের খেলনা সাজানোর মতো দেখাবে। পাহাড়ে বৃষ্টি এলে খুব প্রেম প্রেম লাগে, রোদ উঠলে মনে হয় পুজোবাড়ি। বৃষ্টি পড়লে উত্তম নয়তো রোদ উঠলে কাঞ্চনজঙ্ঘা। অবশ্য তার দেখা পাওয়া অনেক ভাগ্যের।
পাঁচ কিলোমিটার দূরে আর একটা ছবিগ্রাম বাঘোরা। তোমার হাত ধরে সবুজের মাঝের সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব, সত্যি বলছি হেঁটে যাব। কখনও মনে হবে এই বাস্তব আসলে গত জন্মের কোনও স্বপ্ন আবার কখনও মনে হবে এই স্বপ্ন হয়তো আগামী ছুটির বাস্তব। বাঘোরার রাস্তায় বাঘ ঘুরত কি না জানা নেই, কার্শিয়াংয়ের ডাওহিলের রাতের রাস্তায় আদৌ ভূত আছে কি না জানার সাহসও নেই। আছে শুধু প্রকৃতিকে দেখার চোখ আর অনুভব করার মতো মন। হিমালয় এক আজন্ম প্রেমের নাম। যার টান শুধু যুগ নয়, পেরিয়ে যায় যুগান্তরও। বাঙালির হিমালয় প্রেম শুরু দার্জিলিং দিয়ে হলেও আজ দার্জিলিং অতি ব্যবহারে ক্লিশে, লোকের ভিড়ে জন অরণ্য, বাণিজ্যে সবুজ গেছে ঢেকে। পাহাড়ের নির্জনতা, ঘন পাইন বনের ছায়া মাখা পথের রোমান্টিকতা, কুয়াশার রহস্যময়তা এখন চিমনির সম্পদ। আসুন, প্রাণ ভরে অনুভব করুন হিমালয়ের মৌনমুখরতা।
কত কিছু কথা বাকি থেকে যায় বলা। চিমনি যাবেন কখন সেটাই তো বলা হল না। বসন্তে রডোডেনড্রনে চোখের আরাম, গরমে নেইদহনে শান্তি, বর্ষার ধারায় হৃদয়ে ময়ূর নাচতে, শরতে শহরের লাউডস্পিকার ভাইরাসের আক্রমণে পালিয়ে বাঁচতে আর শহরের প্রায় নেই শীতে একটু নরম শীতের খোঁজে যেতেই পারেন চিমনি।