রাজার শহর কোচবিহার

উত্তরবঙ্গের কোচবিহার। ঐতিহ্যবাহী এই জনপদে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য রাজ-নিদর্শন। দেশ-বিদেশের পর্যটকেদের আকৃষ্ট করে। সম্প্রতি ঐতিহাসিক শহরটি ঘুরে এসে লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

ঐতিহ্যবাহী জনপদ কোচবিহার (Cooch Behar)। অতীতে অন্তর্গত ছিল বৃহত্তর কামরূপ রাজ্যের। কোচ বংশ এখানে প্রায় ৫০০ বছর রাজত্ব করেছে। ১৭৭২ সালে একটি চুক্তির ফলে কোচবিহার পরিণত হয় ব্রিটিশদের করদ রাজ্যে। স্বাধীনতার পর অন্তর্ভুক্ত হয় ভারতের। বর্তমানে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা। এর জেলা শহর কোচবিহার। পরিচিত রাজার শহর নামে। শহরটি অদেখা থেকে গেলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ। সর্বত্র চোখে পড়ে পরিকল্পনার ছাপ। পরিচ্ছন্ন চওড়া রাস্তা। শোভা বাড়িয়েছে নানান রাজ-নিদর্শন। পাশাপাশি দেখা যায় মন্দির, ভবন, তোরণ, দিঘি, মাঠ, স্টেডিয়াম, অসংখ্য স্ট্যাচু ইত্যাদি। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে অর্জন করেছে বিশেষ সুনাম। প্রাচীন ইতিহাসের ছোঁয়া পেতে চাইলে ঘুরে দেখা যায় কোচবিহার। বেড়ানোর জন্য দু-তিন দিন যথেষ্ট। দর্শনীয় স্থান কী কী আছে?

কোচবিহার রাজবাড়ি
শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কোচবিহার (Cooch Behar) রাজবাড়ি। আকর্ষণীয় ভবনটি ‘ভিক্টর জুবিলি প্যালেস’ নামে পরিচিত। লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের আদলে তৈরি। স্থাপিত ১৮৮৭ সালে। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে। দোতলা ভবনটি আয়তনে প্রায় ৫১,৩০৯ বর্গফুট। প্রশস্ত রাজপথ রয়েছে সামনে। দু’পাশে চমৎকার বাগান। ভবনের সামনে দেখা মেলে দুটি কামানের। সিংহদুয়ারে রয়েছে কোচ রাজাদের রাজ প্রতীকের চিহ্ন। দরবার হল নির্মিত রেনেসাঁস শৈলীতে। প্রধান গম্বুজের নিচে রাজসভার কক্ষ। তার ঠিক সামনে মেঝেতে রয়েছে একটি অদ্ভুত নকশা। যার অর্থ সত্যের জয় হোক। গম্বুজের নিচে দেখতে পাওয়া যায় কোচ রাজা ও রানিদের মূর্তি, বেশ কিছু পুরনো ছবি। পাশের কক্ষে রয়েছে বৃহদাকার একটি হাতির মাথার কঙ্কাল এবং বেশকিছু শিকারের ছবি। হাতিয়ার কক্ষে সুসজ্জিত তীর, বর্শা, যুদ্ধের দামামা, ঢোল, তলোয়ার ইত্যাদি। আগ্নেয় অস্ত্র কক্ষে দেখা যায় নানা রকমের বন্দুক। বোঝা যায় শিকার এবং যুদ্ধবিদ্যায় রাজারা যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। খেলাধুলোর প্রতিও ছিল তাঁদের প্রবল আগ্রহ। নিদর্শন হিসেবে দোতলার একটি কক্ষে রয়েছে বিলিয়ার্ড বোর্ড। শাহি সিলমোহর, সোনা ও রুপোর পাত্র দিয়ে সাজানো রয়েছে একটি কক্ষ। দেবীকক্ষে রয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন দেবদেবীর মূর্তি। মূলত পাথরের। আরেকটি কক্ষে দেখা যায় কোচবিহারের ভাষালিপি, পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার, পানপাত্র, ব্যবহারিক দ্রব্যসামগ্রী ও আসবাবপত্রের নিদর্শন ইত্যাদি। সবমিলিয়ে রাজবাড়ি ভ্রমণ-অনুসন্ধিৎসু মনকে সমৃদ্ধ করবে। নিয়ে যাবে অতীত যুগে। মূল প্রবেশপথের সামনে আছে কাউন্টার। রাজবাড়ি দর্শনের জন্য ভারতীয়দের কাটতে হয় ২৫ টাকার টিকিট। বিদেশিদের খরচ ৩০০ টাকা।

মদনমোহন মন্দির
রাজবাড়ি থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত কোচবিহার মদনমোহন মন্দির। ১৮৮৯ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের হাতে ভিত্তি স্থাপিত। ১৮৯০ সালে রাজমাতা নিশিময়ী দেও আই দেবতী প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি চারকোণা। দুধসাদা রঙের। চত্বর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অপার শান্তি। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন ২০২০ সালে মন্দিরটিকে ঐতিহ্যশালী সম্পদরূপে ঘোষণা করে। দেবতাদের মধ্যে রয়েছে প্রভু মদনমোহন, মা কালী, মা তারা এবং মা ভবানী। মন্দিরকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী রাসযাত্রা উৎসব। এই উৎসব কেবলমাত্র উত্তরবঙ্গেই নয়, সমগ্র দেশে এবং দেশের বাইরেও পরিচিত। রাসমেলা ময়দানে বসে জমজমাট মেলা। মন্দিরে ছিল বংশীধারী অষ্টধাতুর বিগ্রহ। একটা সময় চুরি হয়ে যায়। পরবর্তীকালে নতুনভাবে একটি অষ্টধাতুর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে সেই মূর্তিটিই পূজিত হয়ে আসছে। ভক্তরা পুজো দেন। অনেকেই মন্দিরের বাইরে বিতরণ করেন খাদ্যসামগ্রী, প্রসাদ। মন্দিরের বিপরীতে রয়েছে একটি পুকুর। আশপাশে কয়েকটি দোকান। মদনমোহন মন্দির শহরের অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান।

আরও পড়ুন: চিনে মায়ের নামে নালিশ জানাতে সাইকেলে ১৩০ কিমি পাড়ি খুদের

বাণেশ্বর শিবমন্দির
রাজ আমলের মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম বাণেশ্বর শিবমন্দির। অবস্থান কোচবিহার শহরে থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে। মন্দিরটি খুব জাগ্রত, মনে করেন বহু মানুষ। দেবাদিদেব মহাদেব পূজিত হন। মন্দিরের প্রধান দালান থেকে ১০ ফুট নিচে গর্ভগৃহে রয়েছে শিবলিঙ্গ। পাশাপাশি রয়েছে একটি গৌরীপাট। বহু মানুষ পুজো দেন। প্রধান মন্দিরের ডানদিকে দেখা যায় সিমেন্টের তৈরি একটি ষাঁড়। এ ছাড়াও একটি শেডে চোখে পড়ে শিব ও অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। অন্য শেডে কালীমূর্তি-সহ আরও কিছু মূর্তি। সকাল ৮টায় খুলে দেওয়া হয় মন্দিরপ্রাঙ্গণ। বন্ধ করা হয় রাত ৮টায়। শিবচতুর্দশীর সময় সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে। মূল মন্দিরের ঠিক পাশেই রয়েছে একটি বড় পুকুর। সেখানে বেশকিছু কচ্ছপ ভেসে বেড়ায়। কচ্ছপগুলো ‘মোহন’ নামে পরিচিত। সাধারণ দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে।

তোর্সা নদী
কোচবিহার শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত তোর্সা নদী। বিভিন্ন ঋতুতে বদলে যায় রূপ। ভরা বর্ষায় দুকূল ছাপিয়ে যায়। বসন্তে, গ্রীষ্মে, শীতে অনেকটাই শান্ত। জলের দিকে তাকিয়ে সময় কাটানো যায়। নৌকা ভাসে। চরে অনেকেই পিকনিক করেন। নদীর তীরে আছে লোকদেবতা মাসান ঠাকুরের মূর্তি। অনেকেই বলেন অপদেবতা। কখনও আবার শিবের অনুষঙ্গ হিসেবে পূজিত। স্থানীয়রা খুব ভক্তি করেন। জেলার বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার ধারে মাসান ঠাকুর চোখে পড়ে।

কাছেই ডুয়ার্স
হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত কোচবিহার (Cooch Behar)। ডুয়ার্স অঞ্চল এখান থেকে খুবই কাছে। পাশের জেলা আলিপুরদুয়ার। গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে আসা যায় সেখানকার ডুয়ার্স জঙ্গলে। প্রকৃতি কবিতার মতো সুন্দর। শুধু সবুজ আর সবুজ। রাস্তার দুপাশে ঘন অরণ্যের পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায় সুসজ্জিত চা-বাগান। আছে কয়েকটি নদী। হাতছানি দেয় সুউচ্চ পাহাড়। কান পাতলেই শোনা যায় পাখির কিচিরমিচির, ঝিঁঝিঁর ডাক। আলোকালো জঙ্গলে আছে হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ, বানর-সহ নানারকমের বন্যপ্রাণী, সাপ। বজায় রাখতে হবে নিরাপদ দূরত্ব।

Latest article