দাবাড়ু

বাংলাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন দাবাড়ু গ্রান্ডমাস্টার সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়। ‘বিস্ময় বালক’, ‘খুদে প্রতিভা’ ইত্যাদি তকমা পেলেও লড়াইটা কিন্তু তার সহজ ছিল না। চরম বাধা পেরিয়ে তবেই এসেছিল সাফল্য। শূন্য থেকে শুরু করে তাঁর সেই আকাশছোঁয়ার ছকভাঙা গল্প নিয়ে সদ্য মুক্তি পেয়েছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা দাসের ছবি ‘দাবাড়ু’। পরিচালক পথিকৃৎ বসু। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

দাবা খেলার শুরু এই ভারতবর্ষেই। রানি মন্দোদরী নাকি প্রচলন করেছিলেন দাবার। রাবণ সারাক্ষণ যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতেন। স্বামীকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্তি দিতে তিনি দাবা খেলতেন স্বামীর সঙ্গে। যে যুদ্ধ বা লড়াই বন্ধের উদ্দেশ্যে এই খেলার শুরু সেই দাবা খেলে নিজেকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে কিন্তু অনেক লড়াই করতে হয়েছিল দাবাড়ু গ্র্যান্ডমাস্টার সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়কে।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে দেশের সপ্তম গ্র্যান্ডমাস্টার হন তিনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দাবায় চল্লিশটি সোনা জিতেছেন। ২০০৫ সালে পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার। ছ’বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। বিশ্বনাথন আনন্দকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে তাঁর টিমে সহকারী হিসেবে ছিলেন তিনি। কিন্তু সহজ ছিল না তাঁর লড়াই। এই বিস্ময় বালককে পেরতে হয়েছিল অর্থকষ্টের বাধা।
বাংলাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়া এই প্রতিভাবান দাবাড়ু সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে সদ্য মুক্তি পেয়েছে পরিচালক পথিকৃৎ বসুর ছবি ‘দাবাড়ু’ (Dabaru)।

ছবির প্রযোজক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা দাসের প্রোডাকশন হাউজ ‘উইনডোজ’। শিবু-নন্দিতার ছবি মানেই ভাল গল্প। তাঁরা যেমন সফল পরিচালক হিসেবে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তেমনই প্রযোজক হিসেবেও তাঁদের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তাঁদের প্রযোজনায় তেমনই একটি ছবি ‘দাবাড়ু’। ক্রিকেট, ফুটবলের বাইরে কোনও দাবাড়ুর (Dabaru) জীবন নিয়ে এর আগে এমন কোনও সিনেমা এ-দেশে হয়নি। যদিও এই ছবি কিন্তু সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়ের বায়োপিক নয়। তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবিটা তৈরি হয়েছে। এতে অনেক কাল্পনিক চরিত্রও রয়েছে। মূলত সূর্যশেখরের মা এবং দাদুর লড়াইটা খুব ডিটেলে দেখানো হয়েছে। এটা এক মায়ের নিঃশব্দ আত্মত্যাগের, একটি ছেলের স্বপ্নপূরণের গল্প।

ছবির পরিচালক পথিকৃৎ বসু এর আগে বেশ কয়েকটি ছবি পরিচালনা করেছেন। যার মধ্যে অন্যতম হল দেবের প্রযোজনায়, প্রসেনজিৎ অভিনীত ছবি ‘কাছের মানুষ’। দাবাড়ু প্রসঙ্গে পরিচালক জানালেন, শিবুদাই প্রথম আমাকে সূর্যশেখরের কথা বলেন। তারপর দাবা খেলা নিয়ে পড়াশুনো শুরু করি। রিসার্চ করতে গিয়ে মনে হয়েছিল দাবা হল খেলার ঊর্ধ্বের একটা বিষয়। ইদানীং আলঝাইমার্স রোগীদের স্মৃতিশক্তি ফেরাতে বা জুভেনাইল হোমে অপরাধীদের অপরাধ-প্রবণতা কমাতে দাবার সাহায্য নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সূর্যশেখরের সম্পর্কে যখন পড়লাম দেখলাম ওর গ্র্যান্ড মাস্টার হওয়ার জার্নিটা খুব ইন্টারেস্টিং। আমার মনে হয়েছিল এরকম একটা ছকভাঙা গল্প নিয়ে ছবি করা উচিত।

এই ছবির চরিত্র নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। কারণ কোনও একজন ব্যক্তিত্বের ওপর ভিত্তি করে যখন ছবি তৈরি হয় তখন একটা গোটা সময়কে ধরতে হয় এবং সেই সময়ের চরিত্রগুলোকেও নিঁখুতভাবে চিত্রায়িত করতে হয়। এই প্রসঙ্গে পরিচালক জানালেন, এটা আশি-নব্বইয়ের দশকের ছবি তাই আশি আর নব্বইয়ের দশকের যাঁরা তারকা তাঁদেরকেই ছবিতে রাখতে চেয়েছিলাম। চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, টিটোদা (অভিনেতা দীপঙ্কর দে), ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত— এঁরা তখন চুটিয়ে কাজ করছেন। এই কারণেই এঁদের কাস্টিং করেছি। সবচেয়ে কঠিন ছিল দাবাড়ুর চরিত্রাভিনেতাকে খুঁজে বের করা। দেড় বছরের লম্বা একটা জার্নি ছিল। স্কুলে স্কুলে গিয়েছি। তারপর বাছাই করেছি। এরপর তাদের গ্রুমিং শুরু হয়। ওয়ার্কশপ করানো হয়।

আরও পড়ুন- ইন্টারনেট বিভ্রাটের নিরিখে শীর্ষে ভারত

সিনেমায় সূর্যশেখরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সমদর্শী সরকার এবং অর্ঘ্য বসু রায়। ‘পোস্ত’ ছবির সুবাদে অর্ঘ্য আগেই পরিচিত। এছাড়া এই ছবিতে অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, দীপঙ্কর দে, চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, কৌশিক সেন, শঙ্কর চক্রবর্তী, খরাজ মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ বসুর মতো অভিনেতারা। ছবির চিত্রনাট্যকার অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সংলাপ লিখেছেন অর্পণ গুপ্ত। ক্যামেরায় মধুরা পালিত এবং সম্পাদনায় মহম্মদ কালাম। ছবির সঙ্গীত পরিচালক বনি চক্রবর্তী এবং প্রসেন। রূপম ইসলামের গাওয়া ছবির টাইটেল ট্র্যাক ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এই সিনেমা দাবার মধ্যে দিয়ে জীবনের, স্বপ্নপূরণের কথা পৌঁছে দেবে দর্শকের দরবারে।

প্রযোজক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা দাস

আমরা একটা সময় ভেবেছিলাম উইডোজের ব্যানারে স্পোর্টস রিলেটেড কিছু সিনেমা করব। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে দাবাড়ু (Dabaru), ওয়েট লিফটিং বা তিরন্দাজিতে নাম করেছেন এমন অনেকেই রয়েছেন। তাঁদের লড়াইয়ের কথা কেউ জানে না। তাঁদের নিয়ে কাজ করার প্ল্যান ছিল কিন্তু কিছুতেই হয়ে উঠছিল না। তখন সূর্যশেখরের সঙ্গে আমরা কথা বলি। এর মাঝখানে পথিকৃৎ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ও অন্য কিছু স্ক্রিপ্ট নিয়ে আমাদের কাছে এসেছিল। অনেকগুলো বিষয় নিয়ে কথা বলেছিল যেগুলো খুবই ভাল কিন্তু আমরা যে ধরনের সিনেমা করতে চাইছিলাম সেটা হচ্ছিল না। তবে পথিকৃতের উৎসাহ দেখে আমাদের খুব ভাল লাগে। তখন আমরা এই সাবজেক্টটার কথা ওকে বলি। তারপর ছবিটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করি। ছবিতে চিত্রনাট্য আর সংলাপ করেছেন যাঁরা তাঁরা দুজনেই নতুন। অরিত্র এবং অর্পণ। তাঁদের সঙ্গে নন্দিতাদি বসেন। কারণ প্রথমবার চিত্রনাট্য লিখেছে ওরা কাজেই অনেক কিছু বিষয় থাকে। নন্দিতাদি ওদের পুরো গাইড করে দেয়। যতটা সাপোর্ট আমাদের তরফে দেওয়া দরকার দিয়েছি। নতুনদের সুযোগ দেবার উদ্দেশ্য যাতে তারা প্ল্যাটফর্ম পায় এবং ইন্ডাস্ট্রিও নতুন প্রতিভার সন্ধান পায়। এ-দেশে ক্রিকেট নিয়ে ফুটবল নিয়ে অনেক ছবি হয়েছে কিন্তু দাবা নিয়ে হয়নি। পশ্চিমবঙ্গেই তেরোজন গ্র্যান্ড মাস্টার রয়েছে। অথচ দাবাই উপেক্ষিত! আর সূর্যশেখরের কথাটাই মাথায় এল তার কারণ ও আর আমি একই সময়ে বড় হয়েছি। ফলে ওর সম্পর্কে ডিটেলে দিদিকে বলে রাজি করাতে পেরেছিলাম কারণ দিদিকে কনভিন্স করানোটা খুব কঠিন। ছবিটা দর্শকদের ভাল লেগেছে এটাই প্রাপ্তি।

Latest article