শরৎকুমারী চৌধুরানী
‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় গোষ্ঠীর সদস্যা ছিলেন শরৎকুমারী চৌধুরানী। অন্যান্য রচনার পাশাপাশি লিখেছেন উপন্যাস। পেয়েছিলেন কবিগুরুর প্রশংসা। আজ তাঁর জন্মদিন।
রবীন্দ্রনাথের সমবয়সি
প্লট বলে দিতেন রবীন্দ্রনাথ। সেই প্লট ধরে গল্প লিখতেন লেখিকা। চার-পাঁচদিনের বেশি সময় নিতেন না কখনওই। লেখা শেষ হলে খাতা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে দাঁড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ মুচকি হেসে বলতেন, ‘‘কই, কী লিখেছ দেখি।’’
লেখা মনে দাগ কাটলে প্রশংসায় ভরিয়ে দিতেন রবীন্দ্রনাথ, ‘‘খাসা হয়েছে। ছাপা হবে।’’
খুশি হতেন লেখিকা। উৎসাহিত হয়ে আরও বেশি মনোনিবেশ করতেন সাহিত্যচর্চায়। কে এই লেখিকা? তিনি শরৎকুমারী চৌধুরানী। রবীন্দ্রনাথের সমবয়সি। দু’জনের জন্ম ১৮৬১ সালে। রবীন্দ্রনাথের ৭ মে, শরৎকুমারীর ১৫ জুলাই।
সম্পাদকীয় গোষ্ঠী
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের ব্যক্তিত্বদের জন্য ছিল অবারিত দ্বার। নিয়মিত বসত সাহিত্য ও আলোচনাসভা। তৎকালীন সময়ে এই বাড়ি থেকে প্রকাশিত হত কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা। সম্পাদনা করতেন ঠাকুরবাড়ির সদস্য-সদস্যারাই। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ছিল ‘ভারতী’। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম সংখ্যা থেকেই এই পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিয়মিত ছাপা হত তাঁর লেখা। পরে সামলেছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
‘ভারতী’র সম্পাদকীয় গোষ্ঠীতে উৎসাহী সভ্য ছিলেন আরও অনেকেই। তাঁদের একজন ছিলেন শরৎকুমারী। পত্রিকার কাজ দেখাশোনা করতেন এবং লিখতেন। মাতিয়ে রাখতেন আসর।
কবির ‘লাহোরিনী’
রবীন্দ্রনাথ শরৎকুমারীকে ডাকতেন ‘লাহোরিনী’ বলে। কেন? কারণ ব্যারাকপুরের চানকের মাতুলালয়ে জন্ম হলেও, দীর্ঘদিন শরৎকুমারী লাহোরে ছিলেন। তাই এমন নামকরণ। আসলে শরৎকুমারীর বাবা শশীভূষণ বসুর কর্মস্থল ছিল লাহোর। তিন বছর বয়সে শরৎকুমারী স্থানীয় বঙ্গবিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ছয় বছর বয়সে লাহোর ইউরোপিয়ান স্কুলে শিক্ষালাভ করেন। ছাত্রী হিসেবে ছিলেন মেধাবী। দশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় হাওড়া আন্দুলের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের অ্যাটর্নি অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে। দিনটি ছিল ১৮৭১ সালের ১২ মার্চ। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা ছিল। অক্ষয়চন্দ্র নিজেও লিখতেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই ‘উদাসিনী’, ‘ভারতগাথা’ এবং ‘সাগরসংগমে’। যদিও লেখক হিসেবে খুব বেশি পরিচিত পাননি। তবে রবীন্দ্রনাথকে তিনি লেখার ব্যাপারে দারুণ উৎসাহ দিতেন। শরৎকুমারীও নানাভাবে প্রেরণা পেয়েছেন স্বামীর কাছে।
পত্রপত্রিকায় লেখালিখি
শরৎকুমারীর লেখার হাত ছিল চমৎকার। সেই কারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিশেষ পছন্দ করতেন। দু’জনেই ছিলেন মাতৃভাষার পরম অনুরাগী। শরৎকুমারী বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন ‘ভারতী’, ‘সাধনা’, ‘ভাণ্ডার’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘ধ্রুব’, ‘সবুজপত্র’, ‘মানসী ও মর্মবাণী’, ‘বিশ্বভারতী’ ইত্যাদি পত্রিকায়। প্রতিটি পত্রিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ছিল ঠাকুরবাড়ির যোগ।
উপন্যাস ‘শুভবিবাহ’
তাঁর উপন্যাস ‘শুভবিবাহ’ সেইসময় উচ্চপ্রশংসিত হয়েছিল। এই উপন্যাস ছাড়া কোনও রচনাই শরৎকুমারীর জীবদ্দশায় পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি। ‘শুভবিবাহ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৬ সালে। রবীন্দ্রনাথ বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় বিস্তৃত সমালোচনায় লিখেছিলেন, ‘রোমান্টিক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আছে, কিন্তু বাস্তব চিত্রের অত্যন্ত অভাব, এজন্য এই গ্রন্থকে আমরা সাহিত্যের একটি বিশেষ লাভ বলিয়া গণ্য করিলাম।’
পরবর্তী সময়ে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সজনীকান্ত দাসের যৌথ সম্পাদনায় শরৎকুমারী চৌধুরানী রচনাবলী প্রকাশিত হয়। এই সম্পাদিত গ্রন্থ থেকে তাঁর রচনা সম্পর্কে অনেককিছু জানতে পারা যায়। ১৯২০ সালের ১১ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ডাঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় (Dr Kadambini Ganguly)
ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট (Dr Kadambini Ganguly)। তখনকার সময় চিকিৎসাশাস্ত্রে ছিল তাঁর (Dr Kadambini Ganguly) একাধিক বিদেশি ডিগ্রি। মানবসেবার পাশাপাশি অংশ নিয়েছিলেন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেও। তিনি হলেন ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক ডাঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় (Dr Kadambini Ganguly)। ১৮ জুলাই তাঁর (Dr Kadambini Ganguly) জন্মদিন।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের চিঠি
‘কে এই মিসেস গাঙ্গুলি (Dr Kadambini Ganguly), আমায় কিছু জানাতে পারো? সে নাকি এর মধ্যেই ফার্স্ট লাইসেন্সিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি পাশ করে ফেলেছে আর আগামী মার্চ মাসে ফাইনাল পরীক্ষা দেবে! এই তরুণী (Dr Kadambini Ganguly) বিয়ে করে ফেলেছে, ডাক্তার হবে ঠিক করার পরে! তার পর অন্তত একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে, যদি না দুটি জন্মে থাকে। কিন্তু ছুটি নিয়েছিল মাত্র ১৩ দিন, আর শুনছি নাকি একটাও লেকচার মিস করেনি!’
সাল ১৮৮৮। এই কথাগুলো ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্বয়ং তাঁর এক ভারতীয় বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন সুদূর বিলেতে বসে। নিজের কাজের জায়গায় বসেই ফ্লোরেন্স শুনছিলেন এক ভারতীয় বাঙালি তরুণীর (Dr Kadambini Ganguly) কাণ্ডকারখানার কথা। ভারত সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ নন তিনি। জানেন সেখানকার মেয়েদের কীভাবে জীবন কাটাতে হয়। তাই অবাক হয়ে তাঁর এক ভারতীয় বন্ধুকে সঙ্গে সঙ্গে চিঠি পাঠিয়ে এর সম্পর্কে জানতে চান। বাংলার তো বটেই, ভারতের ইতিহাসেও এই চিঠিটি একটি দলিল হয়ে থাকবে চিরকাল।
যে মেয়েটির কথা বলেছেন ফ্লোরেন্স তিনি আর কেউ নন, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এবং ব্রিটিশ ভারতের প্রথম বাঙালি নারী চিকিৎসক ডাঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় (Dr Kadambini Ganguly)।
কলকাতায় এলেন মাত্র চোদ্দো বছরে
কাদম্বিনীর (Dr Kadambini Ganguly) বাবা ব্রজকিশোর বসু ছিলেন ভাগলপুর স্কুলের শিক্ষক এবং সেখানকার নারীমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা। ভারতের প্রথম মহিলা সমিতি ব্রজকিশোরই তৈরি করেছিলেন। ফলে সেই নারীমুক্তি আর স্বাধীনতার স্বাদ শৈশবেই পেয়েছিলেন কন্যা কাদম্বিনী (Dr Kadambini Ganguly)। পড়াশুনোয় তাঁর ছিল ভীষণ আগ্রহ। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে বাবা তাঁকে কলকাতায় নিয়ে এলেন। ভর্তি করলেন মেয়েদের একটি বোর্ডিং স্কুলে, যার নাম ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’। ২২ নং বেনিয়াপুকুর লেনের এই বোর্ডিং স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম এবং বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। যিনি পরবর্তীতে কাদম্বিনীর জীবনসঙ্গী হন। এছাড়া ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, ভগবানচন্দ্র বসু, দুর্গামোহন দাস প্রমুখ সমাজসংস্কারক এবং নারীশিক্ষা আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিরা। ভাবতে অবাক লাগে এখানেই কাদম্বিনীর শিক্ষাজীবনের শুরু। আবাসিক এই স্কুলে পড়াশুনোর পাশাপাশি গান, সেলাই এবং নানা বিলিতি আদব-কায়দা রপ্ত করে বড় হতে লাগলেন কাদম্বিনী। মেয়েরা স্কুলের হিসাবপত্র রাখতে শিখত এবং তাদের রান্নাও শিখতে হত, পালা করে রান্নাঘরের ভার নিতে হত, নিয়মিত মেয়েদের বনভোজন ও ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হত। এই বহুমুখী শিক্ষা কিশোরী কাদম্বিনীর ব্যক্তিত্ব গঠন ও পরবর্তী জীবনে খুবই কাজে লেগেছিল।
প্রথম নারী
স্নাতকের একজন
শুধুমাত্র সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে নয়, ঊনবিংশ শতকে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের প্রথম দুই নারী স্নাতকের একজন। ব্রিটিশ-শাসিত দেশগুলো থেকে প্রথম যে দু’জন নারী গ্র্যাজুয়েট হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা হলেন কাদম্বিনী বসু (তখনও তিনি গাঙ্গুলি হননি) এবং চন্দ্রমুখী বসু। কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ১৮৮৩ সালে তাঁরা দু’জনে স্নাতক হন। কাদম্বিনী স্নাতক পাশ করার পর ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনিই ছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পেশাজীবী নারী-চিকিৎসক।
মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ছাত্রী
এরপরেই কাদম্বিনী ঠিক করেন তিনি এমবিবিএস পড়বেন। কিন্তু ১৮৭৫ সাল থেকে শুধুমাত্র মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজেই মেয়েদের ভর্তি নেওয়া শুরু হয়। কাদম্বিনী (Dr Kadambini Ganguly) হাল ছাড়লেন না। নানাধরনের বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে নিজের নাম নথিভুক্ত করলেন ১৮৮৪ সালে। এটাও ইতিহাস গড়ল। ইতিমধ্যে তাঁর বিয়ে হয়েছে সমাজসংস্কারক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির সঙ্গে। মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় সরকারের থেকে মাসে ২০ টাকা করে স্কলারশিপ পান। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসররা তাঁকে মেনে নিতে পারছিলেন না। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলেও প্র্যাক্টিক্যালে অকৃতকার্য হন কাদম্বিনী। কারণ ঈর্ষাকাতর, প্রাচীনপন্থী বিরুদ্ধবাদীরা প্রবল কলকাঠি নেড়ে তাঁর কাছ থেকে প্রথম বাঙালি মহিলা চিকিৎসকের আসন কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন। ১৮৮৬ সালে তাঁকে জিবিএমএস (গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ) উপাধি দেওয়া হয়। এরপর কিছুদিন তিনি লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে তিনশো টাকা মাইনেতে ডাক্তারি করেন। অদম্য এই মহীয়সীর অবিস্মরণীয় উত্থানে কোনও বাধাই টিকতে পারেনি। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে পাশ্চাত্য রীতিতে চিকিৎসা করার অনুমতি পান।
আরও পড়ুন- বাদল বাউল
সন্তান রেখেই বিদেশে পাড়ি
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে বিরুদ্ধবাদীদের যোগ্য জবাব দিতে আট সন্তানকে সেই যুগে বাড়িতে রেখে তিনি বিলেত গিয়েছিলেন ডাক্তারির ডিপ্লোমা নিতে। ১৮৯৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মিস প্যাশ নামে মহিলার সঙ্গিনী হয়ে জাহাজে একা বিদেশযাত্রা করেন। লন্ডন পৌঁছন ২৩ মার্চ। তার পরে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মাত্র তিন মাসে প্রার্থিত তিনটি ডিপ্লোমা সংগ্রহ করে দেশে ফেরেন। যদিও তার সেই যাওয়ার প্রস্তুতির সময়টা মোটেও মসৃণ ছিল না। ব্যঙ্গচিত্র এবং কার্টুনের মাধ্যমে কাদম্বিনীকে উপহাস করা হয়েছিল। তাঁকে একজন ‘পতিতামহিলা’এবং তাঁর স্বামীকে ‘স্ত্রৈণ’ বলে চিত্রিত করা হয়েছিল। দেশে ফিরে তিনি নিয়মিত ডাক্তারি প্র্যাকটিস করতেন। বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ ডেভিড কফ লিখেছেন, ‘কাদম্বিনী ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে স্বাধীন ব্রাহ্মনারী যিনি বাংলার অন্যান্য ব্রাহ্ম ও খ্রিস্টান নারীদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন।’ পরবর্তীকালে সক্রিয় রাজনীতিতেও যোগ দেন।
কাদম্বিনী দেবীর মৃত্যুর মাত্র তিন বছর আগে বিশিষ্ট লেখিকা লীলা মজুমদার ওঁর সামনাসামনি এসেছিলেন এবং মুগ্ধ হয়েছিলেন। ‘পাকদণ্ডী’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন সেই মুগ্ধতার কথা— ‘তাঁর জীবনটাই এক আশ্চর্যের ব্যাপার। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তার অনেক আগেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। বয়সে জ্যাঠাইমার চাইতে সামান্য বড় ছিলেন, দেখে মনে হত অনেক ছোট। মস্ত দশাশই চেহারা, ফুটফুট করত গায়ের রং, সাদা থান পরতেন এবং এত বয়সেও রূপ চাপা পড়ত না, তবে কেমন একটু কড়া ধরনের ভাব। আমরা দূর থেকে দেখতাম।’
শেষের মুহূর্ত
সালটা ১৯২৩। অক্টোবরের ৩ তারিখ। গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের বাড়ি থেকে ফিটন গাড়িতে চেপে বেরিয়েছিলেন তিনি। হাসপাতালে একটা জটিল অপারেশনের কারণে অনেক সকালেই বেরতে হয়েছিল তাঁকে। কয়েক ঘণ্টায় তা শেষ করে দুপুরে যখন ফিরলেন, তখন তিনি বেশ ক্লান্ত। পুত্রবধূ সরলাকে খাবার বাড়তে বলে স্নান করতে গেলেন। খাবারের থালা সাজিয়ে নিচের তলায় সরলা অনেকক্ষণ বসে আছেন। শাশুড়ি আসছেন না দেখে দোতলায় তাঁর শোয়ার ঘরে গিয়ে দেখেন, বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন কাদম্বিনী। হার্ট অ্যাটাক! কয়েক মুহূর্তেই নিস্পন্দ হয়ে গেলেন। শেষ হল ব্যতিক্রমী এক অধ্যায়।
রাতবিরেতে রোগী দেখতে গিয়েছেন ফিটনে চেপে, প্রাইভেট চেম্বার খুলে কাগজে তার বিজ্ঞাপন দিয়েছেন এবং নিয়মিত অস্ত্রোপচার করেছেন। মৃত্যুর পরে তাঁর ব্যাগে পাওয়া গিয়েছিল শেষ ভিজ়িটের ৫০ টাকা। ইতিহাস সৃষ্টিকারী চিকিৎসকের সম্মানে সেই টাকা খরচ করা হয়েছিল তাঁর শেষকৃত্যে।
কমলা দাশগুপ্ত
চিঠি লিখেছিলেন গান্ধীজিকে। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। হয়েছিলেন কারাবন্দি। পরবর্তী সময়ে মন দিয়ে লেখালিখি এবং পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন কমলা দাশগুপ্ত। ১৯ জুলাই তাঁর মৃত্যুদিন।
অগ্নিযুগের সূর্যকন্যা
হাতে লাঠি তুলে নিলেন বীরাঙ্গনা। বুকে দাউ দাউ আগুন। যেভাবেই হোক, বেরোতে হবে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে। তাড়াতে হবে ইংরেজদের। স্বাধীন করতে হবে সোনার দেশকে। দীনেশ মজুমদারের কাছে শুরু করলেন লাঠিখেলা শেখা। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে। যুগান্তর দলের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে তাঁর। গভীর অধ্যবসায়ের ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই হয়ে ওঠেন লাঠিখেলায় পারদর্শী। তিনি অগ্নিযুগের সূর্যকন্যা কমলা দাশগুপ্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ‘স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার নারী’ গ্রন্থের লেখিকা।
মেধাবী ছাত্রী
জন্ম ১৯০৭ সালের ১১ মার্চ। ঢাকার বিক্রমপুরে। এক বৈদ্য পরিবারে। বাবা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। মা চারুলতা দেবী। কমলা ছিলেন মেধাবী ছাত্রী। ১৯২৪ সালে ঢাকা ব্রাহ্মবালিকা শিক্ষালয়ে ভর্তি হন। দু’বছর মাসে ১৩ টাকা করে বৃত্তি পান। স্কুল পাশ করে কলকাতায় বেথুন কলেজে ভর্তি হন। ১৯২৮ সালে ওই কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেন ইতিহাসে এমএ।
গান্ধীজিকে চিঠি
কলেজে পড়ার সময়ে তাঁর মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয়। প্রভাবিত হন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন দেখে। তিনি গান্ধীজিকে চিঠি লিখে জানান, ‘আমি দেশের জন্য কাজ করতে চাই।’
বেশ কিছুদিন পর উত্তর আসে গান্ধীজির, ‘বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে চলে এসো।’ তবে কমলা পেলেন না মা-বাবার অনুমতি। চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন পড়াশোনা।
অসতর্ক হলেই বিপদ
১৯২৯ সালে যুগান্তর দলের নেতা রসিকলাল দাসের প্রেরণায় অহিংসবাদ ছেড়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে পা বাড়ান কমলা। যোগ দেন যুগান্তর দলে। তখন তিনি থাকতেন বান্ধবীর বাড়িতে। ১৯৩০ সালে দলের নির্দেশে সেই বাড়ি ত্যাগ করেন। নেন গড়পার রোডের এক মহিলা হোস্টেলে ম্যানেজারের চাকরি। সেখানে তাঁর কাজ ছিল বিপ্লবীদের জন্য বোমা ও অস্ত্র লুকিয়ে রাখা। বিপ্লবী রসিকলাল একদিন রাতে এক ধামা বোমা পাঠালেন লুকিয়ে রাখার জন্য। উপরে ফল দিয়ে ঢাকা ছিল। কমলা সেই বোমাগুলো বিভিন্ন সুটকেসে লুকিয়ে রাখেন। ভাঁড়ার ঘরের চাবি থাকত তার কাছেই। একটু অসতর্ক হলেই ঘটে যেতে পারত বিপদ। রসিকলালের দেওয়া সাংকেতিক চিহ্ন নিয়ে আসা লোকজনদের হাতে তিনি সেই বোমাগুলো সুটকেসে ভরে তুলে দিতেন। কখনও রসিকলালের নির্দেশে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিতেন বোমা। এইভাবেই সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক। হঠাৎ ঘটে যায় একটি ঘটনা। ১৯৩০ সালে দীনেশ মজুমদার-সহ কয়েকজন বিপ্লবী ব্রিটিশ পুলিশ চার্লস টেগার্টেক হত্যার জন্য বোমা নিক্ষেপ করেন ডালহৌসি স্কোয়ারে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান টেগার্ট। ১৬ সেপ্টেম্বর বোমা যড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হন কমলা। প্রমাণের অভাবে ২১ দিন হাজতবাসের পর ছাড়া পান।
আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন
হাল ছাড়েননি কমলা। আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯৩২ এবং ১৯৩৩ সালে পুলিশবাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে। দ্বিতীয়বার গ্রেফতার করা হয় প্রমাণ-সহ। প্রথমে প্রেসিডেন্সি জেলে, পরে মেদিনীপুরের হিজলি জেলে তিনি বেশ কিছুদিন থাকেন। রাজবন্দি হিসেবে। অবশেষে মুক্তি পান ১৯৩৬ সালে। মুক্তির পর বেশ কিছু বছর গৃহবন্দি হয়ে দিন কাটান তিনি।
লেখালিখি এবং সম্পাদনা
একটা সময় তাঁর মনের মধ্যে নতুন ভাবনার জন্ম হয়। নিজের লেখনীর মাধ্যমে মানুষের মনে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে চান। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। তিনি শুরু করেন লেখালিখি। প্রকাশিত হয় তাঁর কয়েকটি বই। বইগুলোর মধ্যে অন্যতম দেশ ভাগের পরে লেখা আত্মজীবনী ‘রক্তের অক্ষরে’। যা ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয়। ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী’ তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। ১৯৩৮ সালে কমলা নেন মহিলাদের পত্রিকা ‘মন্দিরা’ সম্পাদনার ভার। কয়েক বছর কলকাতার আদর্শ হিন্দি হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ২০০০ সালের ১৯ জুলাই চলে যান না-ফেরার দেশে।
অরুণা আসফ আলি
ভেঙেছিলেন জাতপাতের বেড়া। সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন বিয়াল্লিশের আন্দোলনে। হয়েছিলেন কারাবন্দি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দেগেছিলেন কলম। ১৬ জুলাই তাঁর জন্মদিন।
মুক্তি সংগ্রামের পুরোধা
জীবিত কন্যাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিল একটি শিক্ষিত বাঙালি পরিবার। ঘটনাটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়, স্বাধীনতার বহু আগের। একটি ১৯ বছরের কন্যার অপরাধ ছিল, তিনি ভালবেসে বিয়ে করেছেন ২৩ বছরের বড় একজন মুসলিম আইনজীবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীকে। নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন সেই কন্যা। পরবর্তী সময়ে তাঁকে সারা দেশ চিনেছে অরুণা আসফ আলি নামে। তিনি ছিলেন মুক্তি সংগ্রামের পুরোধা। বিশেষ করে বিয়াল্লিশের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন।
ব্রাহ্ম পরিবার
বরিশালের এক বর্ধিষ্ণু ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যা তিনি। জন্ম ১৯০৯ সালের ১৬ জুলাই। তখনকার পাঞ্জাব প্রদেশের কালকা নামক শিবালিক পর্বতের পাদদেশের এক ছোট শহরে। বাবা ছিলেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। মা অম্বালিকা দেবী ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের নেতা ও ব্রহ্মসংগীত রচয়িতা ত্রৈলোক্যনাথ সান্যালের কন্যা। অরুণার কাকা নগেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট মেয়ে মীরার স্বামী। আরেক কাকা ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘বম্বে টকিজ’-এর চলচ্চিত্র পরিচালক। লাহোরে অরুণার লেখাপড়া শুরু হয়। পরে স্নাতক হন নৈনিতালের অল সেইন্ট কলেজ থেকে। তারপর কলকাতার গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেইসময় এলাহাবাদে অরুণার সঙ্গে পরিচয় হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বয়সে ২৩ বছরের বড় আসফ আলির। কিছুদিনের মধ্যেই নিবিড় ঘনিষ্ঠতা, হৃদয় বিনিময়। জাতপাতের বেড়া ভেঙে ১৯২৮ সালে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সরোজিনী নাইডু, সি রাজাগোপাল আচারিয়া, মৌলানা আবুল কালাম প্রমুখ।
গান্ধীজির হস্তক্ষেপ
অরুণা সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন বিয়ের পরই। স্বামীর উৎসাহে। ৯ অগাস্ট বোম্বাই গোয়ালিয়া টেংক ময়দানে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে এনে তার জায়গায় তেরঙ্গা পতাকা উড়িয়ে সকলের মধ্যে উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলেন। লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের সময় তিনি প্রথম বারের জন্য কারাবন্দি হন। ১৯৩১ সালে গান্ধী- আরউইন চুক্তি অনুযায়ী সবাই ছাড়া পেয়ে যান। কিন্তু অরুণাকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ছাড়া হয়নি। অন্যান্য মহিলা জেলবন্দিরা তখন তাঁর মুক্তির দাবিতে জেল থেকে বেরতে অস্বীকার করেন। ওঠে ঝড়। গান্ধীজির হস্তক্ষেপে শেষমেশ অরুণা ছাড়া পান। তবে কয়েক মাসের মধ্যে আবার তাঁকে আটক করে তিহাড় জেলে বন্দি রাখা হয়। জেলে রাজনৈতিক বন্দিদের দুঃসহ অবস্থা দেখে মন কেঁদে ওঠে অরুণার। শুরু করেন আমরণ অনশন। অবস্থা বেগতিক দেখে দশদিন পর জেল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় তাঁর দাবি মেনে নিতে। তবে অরুণাকে বদলি করা হয় আম্বালা কারাগারে। সেখানে তাঁকে রাখা হয় নির্জন সেলে। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যান। মনোনিবেশ করেন পড়াশোনা ও লেখালেখিতে।
পত্রিকা সম্পাদনা
একটা সময় যৌথভাবে শুরু করেন মাসিক ‘ইনকিলাব’ পত্রিকা সম্পাদনা। এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অসংখ্য লেখা। ১৯৪৪ সালে তিনি লেখেন ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম সহিংস হবে, নাকি অহিংস— এ নিয়ে বিতর্কের সময় এটা না। আমি চাই, ক্রান্তিকালের এই সন্ধিক্ষণে দেশের সব মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুক।’
হাসিমুখে আত্মসমর্পণ
আগুন ঝরানো এই লেখা পড়ে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে ব্রিটিশ শাসক। অরুণার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, তাঁকে গ্রেফতারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৬ সালের ২৬ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার তাঁর গ্রেফতারি পরোয়ানা রদ করলে, অরুণা আত্মসমর্পণ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাজ করেছেন সাধারণ মানুষের জন্য।
পুরস্কার ও সম্মাননা
শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দাবিতে এই স্পষ্টবাদী নারীর অবদান চিরস্মরণীয়। ১৯৫৮ সালে তিনি দিল্লির প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হন। লেখেন স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর একটি বই। নাম ‘ওয়ার্ড অব ফ্রিডম’। দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন অরুণা। ১৯৯১ সালে তিনি পান জওহরলাল নেহরু পুরস্কার। পরের বছর, ১৯৯২ সালে পান ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মান। পেয়েছেন ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারতরত্ন’। ওই উপলক্ষে ভারত সরকার একটি ডাকটিকিটও প্রকাশ করে। ১৯৯৬ সালের ২৯ জুলাই মৃত্যু তাঁর। বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা আজও বিনম্র চিত্তে স্মরণ করা হয়।
অমিতা সেন
রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা তিনি। ছিলেন সেই যুগের দক্ষ মঞ্চ-নৃত্যশিল্পী এবং সংগীতশিল্পীও। যখন মেয়েরা ঘরের বাইরে বেরনোর কথা ভাবতে পারতেন না তখন শিখেছিলেন মার্শাল আর্ট। তিনি হলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মা শান্তিনিকেতনের আশ্রম-কন্যা অমিতা সেন। ১৭ জুলাই তাঁর জন্মদিন।
বাবলুর মা অমিতা
‘‘শান্তি-নিকেতনের গুরুপল্লীর খড়ের চালের ঘর। আমার বাবলু জন্ম নিল। ওর ছোটবেলাকার কথাই শুধু মনে পড়ছে। ওর জন্মের পর গুরুদেব তখন বলেছিলেন ‘ছেলের একটা অসাধারণ নাম দিলাম। দেখবি ও একদিন অসাধারণ হয়ে উঠবে। তবে দেখিস নামের শেষের ‘য’ ফলাটা ঠিক দিবি কিন্তু।” বাংলা সাহিত্যের তেজোদ্দীপ্ত মধ্যগগনের আলোকিত রবি কত আগে বুঝতে পারলেন কোনও এক সময় রেফ-এর সঙ্গে ‘য ফলা’ নাও থাকতে পারে। অমর্ত্য সেনের ডাক নাম বাবলু। মা বরাবর ছেলেকে এই নামেই সম্বোধন করেছেন। আর যিনি সেই রত্নগর্ভা, তিনি হলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মা, আশ্রমকন্যা অমিতা সেন।
রবি ঠাকুরের শ্রাবণী
শান্তিনিকেতন মানেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরুর গুণমুগ্ধ শিষ্য ক্ষিতিমোহন সেনের প্রিয়তমা কন্যা হলেন অমিতা সেন। শ্রাবণ মাসে জন্মেছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম রাখেন শ্রাবণী। অমিতার জন্ম ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বর্তমানের বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে। পিতা আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন এবং মা কিরণবালা দেবীর কন্যা অমিতার পৈতৃক ভিটে ছিল অধুনা বাংলাদেশের বিক্রমপুর, বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার সোনারং গ্রামে।
আশ্রম অধ্যক্ষ ক্ষিতিমোহন
রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয় ক্ষিতিমোহন সেন সংস্কৃতে এমএ পরীক্ষায় অসম্ভব ভাল ফলের জন্য পেয়েছিলেন শাস্ত্রী উপাধি। তখন তিনি চাম্বারাজ এস্টেটের শিক্ষাসচিব। রবীন্দ্রনাথই ক্ষিতিমোহন সেনকে শান্তিনিকেতনে ডেকে এনে আশ্রমের অধ্যক্ষের দায়িত্ব তুলে দিলেন। রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী হিসেবে ১৯২৪ সালে চিন সফরও করেছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে বিশ্বভারতীর উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্বে ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। অমিতা সেনের যখন জন্ম তখন ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের অধ্যক্ষ। সে-যুগের আর পাঁচজন আশ্রমকন্যার মতো অমিতার ছোটবেলাও কেটেছে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যেই৷ কবির কাছেই শিখেছেন নাচ-গান-অভিনয়৷ পেয়েছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকুণ্ঠ স্নেহ এবং ভালবাসা।
রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্রী
রবীন্দ্রনাথের ‘নটীর পূজা’ নাটকে প্রথম অভিনয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল শ্রাবণীর। ‘নটীর পূজা’ নাটকে ‘মল্লিকা’ চরিত্রে তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ-ছাড়া ‘শাপমোচন’ নাটকে তিনি রানির চরিত্রে প্রথম অভিনয়ে করেন। শান্তিনিকেতনে ঋতুভিত্তিক সব উৎসব আয়োজনে অমিতা সেন ছিলেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঋতুনাট্যে তাঁর উপস্থিতি ছিল অগ্রগণ্য। অভিনয় তো বটেই, সংগীতেও শ্রাবণী ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তাঁর সংগীতগুরু ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দু’জনের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন অমিতা। অভিনয় ও সংগীতের পাশাপাশি জাপানি মার্শাল আর্ট জুজুৎসুও শিখেছিলেন অমিতা সেন। শান্তিনিকেতনের জুজুৎসুর প্রশিক্ষক ছিলেন তাগাকাকির। তাগাকাকির সুনাম তখন শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। কলকাতা থেকে অনেকে কেবল জুজুৎসু শেখার জন্য তাগাকাকির কাছে আসতেন। অমিতা সেনের উৎসাহ, মেধা, দ্রুত শিখে ফেলার গুণে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রশিক্ষক তাগাকাকিও।
আমৃত্যু ছিলেন শান্তিনিকেতনে
শান্তিনিকেতনে যাঁরা পরিচিতি লাভ করেছেন, অমিতা সেন তাঁদের মধ্যে অন্যতমা। শান্তিনিকেতনে তখন তিনজন অমিতা। বড় অমিতা ছিলেন অধ্যাপক অজিত চক্রবর্তীর কন্যা, পরে যিনি দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র অজিন ঠাকুরকে বিয়ে করে অমিতা ঠাকুর হন। দ্বিতীয় অমিতা কিরণবালা ও ক্ষিতিমোহন সেনের কনিষ্ঠা কন্যা। আগাগোড়া শান্তিনিকেতনেই মানুষ হয়েছেন তিনি। নিজে ‘আশ্রমকন্যা’ নামে পরিচিত হতেই ভালবেসেছেন। তৃতীয় অমিতা সেন হলেন খুকু। যদিও খুকু পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে ছিলেন না। তবে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের মা অমিতা সেন শান্তিনিকেতনেই লেখাপড়া করেন। আমৃত্যু সেখানেই থেকে ছিলেন এবং আশ্রমের নানা দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অমিতা সেন খুব ভাল নাচতেন। এ-প্রসঙ্গে তাঁকে নিয়ে অধ্যাপক যশোধরা বাগচী লিখেছেন, ‘আমরা যখন বড়ো হয়ে উঠছি, তখন শুনতাম, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে সেই সময় দুই ‘অমিতা সেনে’র রমরমা— একজন নাচে ও একজন গানে। নাচতেন কিরণবালা ও ক্ষিতিমোহন সেনের ছোট কন্যা— আমার অমিতাপিসি। আমার ছোটকাকা রামানন্দ সেনগুপ্তর ক্যামেরায় তাঁর কিছু অংশ তোলা ছিল বলে শুনেছি, নিজে কখনও দেখিনি। কিন্তু অনেক পরে প্রায় প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়ে অমিতাপিসির সজীব লেখাগুলির মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি।’
বিয়ের পরে
২০ বছর বয়সে অমিতার বিয়ে হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশুতোষ সেনের সঙ্গে। আশুতোষ সেনের একান্ত চেষ্টাতেই মৃত্তিকাবিজ্ঞানের বিভাগ গড়ে উঠেছিল। বিয়ের এক বছরের মাথায় পুত্র অমর্ত্য সেনের জন্ম। আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন পড়াতেন। এরপর ঢাকাতেই ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন অমিতা সেন। দেশভাগের পর স্বামী-সহ ভারতে চলে আসেন অমিতা। স্বামীর সঙ্গে চাকরিসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলেও শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি কখনও। আশুতোষ সেনের কাজের সুবাদে প্রথমে দিল্লি এবং পরবর্তীতে ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন তিনি।
আশুতোষ সেন যখন কলকাতায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান তখন শান্তিনিকেতনেই থাকতেন সদ্যবিবাহিতা অমিতা সেন। ‘শান্তিনিকেতনে আশ্রমকন্যা’ বইয়ে তখনকার একটি স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। অমিতা সেন স্বামীকে নিয়ে দেখা করতে গেছেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাদ করে নতুন জামাতাকে বললেন, ‘আমার আশ্রমে ওরা একটু অন্যভাবে মানুষ হয়েছে। তুমি ওর মন বুঝতে চেষ্টা কোরো।’ ক্ষিতিমোহন-কন্যার ছোটবেলা কেটেছে গুরুপল্লিতে। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে বড় হওয়া আশ্রমকন্যাদের জন্য তাঁর মত ছিল, সংসারজীবনে মেয়েরা যাবে তো বটেই, কিন্তু শিক্ষা তার নিজের জগৎ তৈরি করবে। প্রত্যেকটি ছাত্রীর প্রবণতা আলাদা। নিজের সত্তার মূল ক্ষেত্রটিকে তাঁরা যেন চিনে নিতে পারেন।
দক্ষ মঞ্চ নৃত্যশিল্পী
বিশের দশকের মধ্যভাগ থেকেই মেয়েদের নাচের শিক্ষা দিতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৫ সাল থেকেই নবকুমার সিংহ শান্তিনিকেতনে দীর্ঘদিন নাচ শিখিয়েছেন। কিন্তু সেই সময়ে ছাত্রীরা একটু আড়ালে নাচ শিখতেন। ছাত্ররা শিখতেন প্রকাশ্যে। অমিতা সেন, গৌরী বসু নন্দলালের মেয়ে, নন্দিতা ঠাকুর, যমুনা সেন প্রমুখ ছিলেন প্রথমদিকের ছাত্রী। অমিতা সেন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ উদ্ভাবিত ‘আধুনিক’ ধারার দক্ষ মঞ্চ-নৃত্যশিল্পী। যখন ভাল পরিবারের নারীরা মঞ্চে আসতেন না তখন বহু নৃত্যনাট্যে অমিতা সেন প্রধান নারী চরিত্রে মঞ্চে হাজির হয়েছেন। নৃত্যকলার গুণমুগ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ শতকের প্রথমার্ধেই শান্তিনিকেতনের নারীরা যেভাবে বিভিন্ন বিষয়ে এগিয়ে এসেছিলেন ভাবলে অবাক হতে হয়। নেপথ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ।
শান্তিনিকেতন থেকে অমিতা সেনের সম্পাদনাতেই একটি পত্রিকা বের হয় যার নাম ছিল ‘শ্রেয়সী’। অমিতা সেন নিজেকে সর্বত্র আশ্রমকন্যা বলে পরিচয় দিতেন। তাঁর লেখা কিছু বইয়ের মধ্যে ‘শান্তিনিকেতনের আশ্রমকন্যা’, ‘আনন্দ সর্বকাজে’, ‘শিরীষ বকুল আমের মুকুল’, ‘চলে যায় দিন’ বইগুলি যথেষ্ট গুরুত্ববহন করে।
জীবনের শেষনিঃশ্বাস অবধি শান্তিনিকেতনেই কাটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণী। ২০০৫ সালে ২২ অগাস্ট সেখানেই প্রয়াণ ঘটে অমিতা সেনের।