বছরের দুটো সময় জ্বর-সর্দি-কাশির বাড়-বাড়ন্ত হয়— শীতের শুরু এবং শীতের শেষ। আবার কোভিড ১৯ সংক্রমণের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম। কাশিকে অনেকেই হেলাফেলা করেন কিন্তু এই উপসর্গ মোটেও অবহেলার নয়। ইদানীং জ্বর (Fever) এবং সঙ্গে কাশি খুব হচ্ছে। যে কাশি সারছে তো না-ই, অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকেও কাজ হচ্ছে না। জ্বর কমে গেলেও গেড়ে বসে যাচ্ছে প্রবলভাবে। এটা এক অর্থে সিজনাল সমস্যাও। যদিও সব কাশি সবসময় সিজনাল হয় না। কিছু ক্ষেত্রে কাশি সহজেই সেরে যায়। কিন্তু ভাইরাল ইনফেকশনের পর ক্রমাগত শুষ্ক কাশি খুব বিরক্তিকর। জ্বরের পর শুষ্ক এবং কফযুক্ত দু’ধরনের কাশিও দেখা যায়।
কেন হয়
কাশি হল মানবদেহে প্রতিরক্ষামূলক শারীরিক প্রক্রিয়া যা শ্বাসনালিগুলিকে বিরক্তিকর বা বাধা সৃষ্টিকারী পদার্থ থেকে পরিষ্কার রাখতে কাজ করে। এর ফলে মানুষ কার্যকরীভাবে শ্বাস নিতে পারে। এই ধরনের কাশি সবসময় শ্লেষ্মা বা কফ তৈরি করে না।
তবে পোস্ট-ভাইরাল কাশি আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টকে বা উপরের শ্বাসনালিকে সংক্রমিত করে এবং জ্বরের (Fever) পরে তিন থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়।
দিন ও রাতের তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে এখন ভাইরাসজনিত জ্বর হচ্ছে। বাতাসে আর্দ্রতা কমে শুষ্কতার কারণে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু শ্বাসনালি ও ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। এই জ্বর হাঁচি এবং কাশির মাধ্যমেই একজন থেকে আরেকজনে ছড়াচ্ছে। আর কাশি থেকে যাচ্ছে বহুদিন। তাই তিন দিনের বেশি জ্বর থাকলে অবহেলা করা উচিত নয়। পরীক্ষা করানো উচিত। যেহেতু এখন আবার নতুন করে করোনা হচ্ছে সঙ্গে ডেঙ্গুও পুরোপুরি যায়নি। বিশেষ করে যেসব শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি ও ক্রনিক রোগের কোনও রোগী রয়েছে, তাদের এ-বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া উচিত। রোগীকে বেশি করে জল খাওয়াতে হবে এবং পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। যাঁদের শ্বাসতন্ত্রের রোগ আছে, হার্ট বা কিডনির রোগে ভুগছেন তাঁদের ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়া প্রতিষেধক টিকা নিতে হবে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে না কোনওমতেই।
কারণ কী
প্রাথমিক এই সময় ভাইরাল সংক্রমণের ফলে কাশি হচ্ছে। ভাইরাল ইনফেকশনে অন্য উপসর্গ কিছুদিন পরে চলে গেলেও কিন্তু কাশি কয়েক সপ্তাহ এমনকী কয়েক মাসের জন্য থাকতে পারে। ভাইরাসের কারণে শ্বাসনালি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে এটা হয়।
পোস্টনাসাল ড্রিপের ক্ষেত্রে নাকে উৎপাদিত তরল ফোঁটায় ফোঁটায় গলায় নিঃসরিত হয়ে প্রতিনিয়ত আলজিভ ও ভোকাল কর্ড বা স্বরযন্ত্রকে কাশতে বাধ্য করে। ভাইরাস সংক্রমণ, ব্যাকটেরিয়াল সাইনুসাইটিস, অ্যালার্জি ও অনবরত হাঁচির কারণে পোস্টনাসাল ড্রিপ হতে পারে।
কোনও কিছুতে কাশি নিরাময় না হলে ও পরীক্ষায় কিছু না পাওয়া গেলে লক্ষ্য করুন কোনও ওষুধের জন্য এটি হচ্ছে কি না। যেমন উচ্চরক্তচাপ ও হৃদ্রোগের জন্য নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের কারণে দীর্ঘস্থায়ী কাশি হতে পারে। যদি এ ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
কফ ভেরিয়েন্ট অ্যাজমায় শুষ্ক কাশিই একমাত্র উপসর্গ। সাধারণত এ ধরনের কাশি রাতে বেড়ে যায়। ধুলোবালি, ফুলের রেণু, এসির ঠান্ডা ইত্যাদি কারণে কাশির প্রকোপ বেড়ে গেলে সেটি সাধারণত অ্যালার্জির সমস্যা। অ্যাজমা হয়েছে সন্দেহে চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি ব্রিদিং টেস্ট নিতে পারেন। প্রয়োজনে তিনি ইনহেলার ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন।
যক্ষ্মা এবং ল্যারিঞ্জাইটিস হলে শুকনো কাশি অন্যতম লক্ষণ হয়ে ওঠে।
পাকস্থলীতে নিঃসরিত অ্যাসিড খাদ্যনালির দিকে চলে আসার সমস্যাকে বলে জিইআরডি (গ্যাস্ট্রোইসোফাজিয়েল রিফ্লাক্স ডিজিজ)। এই সমস্যা থেকে কাশি-সহ বুকে জ্বালাপোড়া, মুখে টক স্বাদ অনুভত হয়। মশলাদার খাবার, ভাজা খাবার, ক্যাফেইন, চকোলেট, অ্যালকোহল ইত্যাদি খেলে জিইআরডি উদ্দীপ্ত হয়ে থাকে। শারীরিক স্থূলতা, ধূমপান, বেশি খাবার খাওয়ার কারণে পাকস্থলীর অ্যাসিড খাদ্যনালিতে উঠে আসতে পারে।
আরও পড়ুন-দিল্লি, হরিয়ানার ৫ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা আপের
কাশি কমানোর ঘরোয়া উপায়
সিজনাল চেঞ্জজনিত কারণে কাশি হলে ঘরোয়া টোটকা খুব কাজে আসে অনেকসময়। তবে বাড়াবাড়ি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
যাঁদের কাশি বা সর্দি আছে তাঁদের সবসময় উষ্ণ এবং হাইড্রেটেড থাকা খুব জরুরি। গরম জল এবং লবণ দিয়ে গার্গেল করুন। এটি এক ঘণ্টা অন্তর দিনে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় বার করুন। উষ্ণ জলের নুন ওয়াশিং মেশিনের মতো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে। শব্দ করে গার্গল করতে হবে।
আদা হল কাশির সবচেয়ে কার্যকরী প্রথম ঘরোয়া প্রতিকার। এতে রয়েছে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য। এটি ইমিউনিটি বাড়াতে এবং শ্বাসযন্ত্রের ট্র্যাক্টে জমে থাকা শ্লেষ্মা থেকে মুক্তি দিতেও সহায়তা করে। এমন প্রমাণ রয়েছে যে আদা শ্বাসনালিগুলির মসৃণ পেশিগুলিকে শিথিল করে কাশির প্রতিফলন রোধ করে।
কাঁচা মধু কাশি নিরাময়ের প্রাচীনতম ঘরোয়া প্রতিকার। এটি কাশিজনিত গলাব্যথা এবং জ্বালাভাব কমায়। মধুতে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সম্ভাব্য ছোটখাটো ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাল সংক্রমণকে রোধ করতে পারে। এক গ্লাস গরম জলে ২ চা-চামচ মধু যোগ করে সারাদিনে একবার খেতে পারেন। এ-ছাড়াও চায়ে চিনির বিকল্প হিসাবে মধু ব্যবহার করতে পারেন।
হলুদ একটি দুর্দান্ত অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এজেন্ট যা আপনার শরীরকে যে কোনও সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়। এতে কারকিউমিন থাকে যা কাশি এবং হাঁপানির অন্যান্য উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে। হলুদ আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টের সংক্রমণ রোধ করতে, ব্রঙ্কাইটিস এবং টনসিলের চিকিৎসার জন্যও উপকারী। চায়ে আধ চা-চামচ হলুদ দিতে পারেন। আরও কার্যকরী ফল পেতে ওর মধ্যে ২-৩টে গোলমরিচের বীজ দিয়ে দিন।
পুদিনা পাতায় মেন্থল থাকে যা গলার স্নায়ুকে অসাড় করতে সাহায্য করে এটা কাশির পুনরাবৃত্তি কমায়। লিকার চায়ে পাঁচটা পুদিনা পাতা দিয়ে ফুটিয়ে একটু ঢাকা দিয়ে রাখুন। এরপর ওটা ছেঁকে খান।
গরম জলে কয়েক ফোঁটা ইউক্যালিপটাস তেল দিয়ে দিন এবং ভেপার নিন দিনে তিন থেকে চারবার তাহলে কাশি অনেক কমবে। শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতার চিকিৎসায় ইউক্যালিপটাস তেল কার্যকরী।
গবেষণায় প্রমাণিত হিউমিডিফায়ার থাকলে তা কাশির পাশাপাশি গলার ব্যথাকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে।
থাইম এমন এক ভেষজ যাতে রয়েছে অ্যান্টিস্পাসমোডিক যৌগ যা পেশি শিথিল করতে সহায়তা করে। থাইম-চা নিয়মিত খেলে কাশিও কমে যায়।