সবুজ রসায়ন

সত্যি, রসায়নকে তো সবুজই হতে হয়! তা সে সম্পর্কে হোক বা বিজ্ঞানে। সবুজ মানেই যা চিরন্তন, জীবনের ও যৌবনের প্রতীক। তাই আজকের আলোচ্য ‘সবুজ রসায়ন’ বা গ্রিন কেমিস্ট্রি। দীর্ঘ সুস্থ জীবনের অন্যতম উপায়। গ্রিন কেমিস্ট্রির ইতিহাস ও নানা অজানা কথা বললেন বোস ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিজ্ঞান-প্রচারক মানস চক্রবর্তী। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

অঙ্কুরোদ্গম
এই মুহূর্তে সবচেয়ে চর্চিত বিষয়টি হল গ্রিন কেমিস্ট্রি বা সবুজ রসায়ন (Green chemistry)। রসায়ন মানে তো আমরা সবাই বুঝি কেমিস্ট্রি। অর্থাৎ কোনও কেমিক্যাল তৈরি করতে গেলে বিক্রিয়া ঘটাতে হয়, সেটাই কেমিস্ট্রি। জীবজগতে আমরা যা দেখি, শুনি, খাই বা পরি সবকিছুই কোনও না কোনও একাধিক কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ কেমিক্যালস বা কেমিস্ট্রি বাদ দিয়ে জীবনে কিছু হয় না। পঞ্চাশের দশকের আগে পর্যন্ত সাধারণ মানুষের একটা ধারণা ছিল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির সবকিছুই খুব ভাল। কিন্তু ১৯৫০-এর সময় পৃথিবী জুড়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার কারণে সবুজ রসায়নের অঙ্কুরোদ্গম হয়।

রাসেল কার্সন

প্রেক্ষাপট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একটি কেমিক্যাল বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল সেটা হল ডিডিটি। এটা একটি কীটনাশক। সেই সময় সৈনিকরা মাঠে-ঘাটে যুদ্ধ করতে গিয়ে টাইফাস, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হত, মৃত্যুও ঘটত। তখন এই ডিডিটি তারা মাঠেঘাটে স্প্রে করতে শুরু করে। এর ফলে তাদের রোগমুক্তি ঘটে এবং মৃত্যুর হারও কমে যায়। এত পপুলার হল কীটনাশকটি যে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো ডিডিটি তৈরি করতে শুরু করল। কিন্তু যুদ্ধ তো শেষ হয়ে গেল। তখন এই টন-টন ডিডিটি কি ফেলে দেবে? শুরু হল ইনসেক্টিসাইড হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে এর ব্যবহার। ভালই চলছিল, কিন্তু রাসেল কার্সন নামে এক মহিলা মার্কিন বায়োলজিস্ট লক্ষ্য করলেন বসন্তকালে তাঁর বাগানে অনেক ধরনের পাখির ডাক শোনা যেত। হঠাৎই সেই ডাক আর নেই। এবং তিনি আবিষ্কার করলেন ডিডিটি যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের ফলে তার ক্ষতিকর প্রভাবে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে উনি একটি বই লিখলেন যার নাম ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। রাতরাতি হইচই পড়ে যায় এবং প্রতিটা এডিশন মিলিয়ন কপি বিক্রি হয় বইটির। তৎকালীন মার্কিন প্রসিডেন্ট জন এফ কেনেডির নজরে এল বিষয়টা এবং তখন তাঁরই তৈরি করা একটি সাব-কমিটি রাসেলকে ডেকে পাঠান। তখন সেনেটে গিয়ে লেখিকা প্রমাণ করলেন যে তাঁর বইয়ের তথ্য সম্পূর্ণ সত্য। উনি বললেন ডিডিটির যথেচ্ছ ব্যবহার ক্ষতি করছে জীব-জগতের। এই সময় থেকেই মানুষ বুঝতে শিখল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি অপরিহার্য হলেও সবকিছু তার ভাল নয়।

কিছু স্মরণীয় ক্ষতি
এই ধারণা আরও দৃঢ় হল পঞ্চাশের দশকে পৃথিবী জুড়ে কয়েকটি স্মরণীয় দুর্ঘটনা দিয়ে। যেমন, জার্মানির একটি নামী ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা ১৯৬০ সালে একটা ওষুধ বের করে যা সন্তানসম্ভবা মহিলাদের মর্নিং-সিকনেস রোধ করবে। সেই ওষুধ জার্মানি-সহ ইউরোপের বহু জায়গার মহিলারা ব্যবহার করলেন। কিন্তু হল অপূরণীয় ক্ষতি। এর প্রায় ৮-১০ মাস পরে জার্মানি-সহ গোটা ইউরোপে প্রায় ১০ হাজার বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিল। সঙ্গে সঙ্গে সেই ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওষুধটির কেমিক্যাল মিক্সচারেই ছিল গলদ। এ ছাড়া শার্নোবিল নিউক্লিয়ার ডিজাজস্টার, ভারতে ভোপাল গ্যাস লিক-সহ ঘটেছিল আরও দুর্ঘটনা।

সবুজ রসায়ন (Green chemistry) কী
ইতিমধ্যে রাসেলের প্রমাণিত তথ্যের উপর ১৯৭০ সালে মার্কিন সরকার তৈরি করল এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (EPA)। এই এজেন্সি তৈরি করল বিভিন্ন আইন, যাতে যে কোনও রকম কেমিক্যাল নিয়ে যে কোনও ইন্ডাস্ট্রি কাজ করলে তাদের ওই আইন মেনে চলতে হবে। একশোটার বেশি আইন তৈরি হল। যার মধ্যে অন্যতম হল গ্রিন ওয়াটার অ্যাক্ট, সেফ ড্রিঙ্কিং অ্যাক্ট, টক্সিন সাবস্ট্যান্সেস কন্ট্রোল অ্যাক্ট, পলিউশন প্রিভেনশন অ্যাক্ট ইত্যাদি। এই সময় সিদ্ধান্ত হল, কেমিস্ট্রি তো থাকবে কিন্তু এমন ভাবে তার ব্যবহার করতে হবে যাতে পরিবেশের কোনও ক্ষতি না হয়। পরিবেশ বলতে বোঝায় মাটি, জল, বায়ু এবং সম্পূর্ণ জীবজগৎ। অর্থাৎ এমন প্রোডাক্ট তৈরি করবে যা পরিবেশের ক্ষতি করবে না বা কম ক্ষতি করবে— সেটার নাম হল গ্রিন কেমিস্ট্রি বা সবুজ রসায়ন।

আরও পড়ুন-এক লহমায় মৃত্যুপুরী তুরস্ক–সিরিয়া, প্রবল ভূমিকম্পে নিহত ২৫০০–র বেশি, সাহায্য পাঠাচ্ছে ভারত

তখনও সবুজ রসায়ন (Green chemistry) কথাটা আসেনি। ১৯৮৭ সালে ইউনাইটেড নেশন একটি কমিশন গঠন করল যার নাম ব্লান্ট লাইন কমিশন। এই কমিশন একটি টার্ম চালু করল যার নাম ‘সাস্টেনেবল কেমিক্যাল ডেভেলপমেন্ট’ অর্থাৎ কেমিস্ট্রিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এমনভাবে, যার থেকে বর্তমান প্রজন্ম সুবিধা পাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বঞ্চিত হবে না। এর চার বছর বাদে ১৯৯১ সালে আই ইউ প্যাক (international union of theroam applied chemistry) সংস্থা একটি কমিশন গড়ল, যার চেয়ারম্যান ফল্টই এনেস্টাস গ্রিন কেমিস্ট্রি টার্মটা প্রথম ব্যবহার করলেন। এতে বলা হল— নতুন কোনও কেমিক্যাল বা কেমিক্যাল প্রোডাক্ট তৈরিতে কোনও ক্ষতিকারক পদার্থ, বিস্ফোরক, দাহ্য পদার্থ, করোসিভ, টক্সিক— এই ধরনের উপাদানগুলো ব্যবহার করা যাবে না। এমন রসায়নই হল সবুজ রসায়ন।

সবুজ রসায়নের নীতি
অল্টি অ্যানাস্টাস এবং ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটসের জে সি ওয়ার্নার দুজনে মিলে একটি বই লিখলেন যাতে বারোটি নীতি ছিল। সেগুলো মেনে চললেই বলা যাবে সবুজ রসায়নের নিয়ম মেনে চলেছি। যার মোদ্দা বক্তব্য ছিল, এমন প্রোডাক্ট তৈরি হবে যাতে কোনও বর্জ্য উৎপন্ন হবে না অর্থাৎ ক্রিয়েট নো ওয়েস্ট।
দ্বিতীয়ত হল, গোটা পদ্ধতিতে কোনও ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার হবে না বা তৈরিও হবে না। তৃতীয়ত, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে যে কোনও কিছুতে এনার্জি লাগে, যা আসে ফসিল ফুয়েল অর্থাৎ গ্যাস, কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি থেকে। এই ফসিল ফুয়েলগুলো যাতে শেষ হয়ে না যায়, তা বাঁচাতে অল্টারনেটিভ সোর্স অফ এনার্জি আবিষ্কার করতে হবে। চতুর্থত, কেমিক্যাল প্রোডাক্ট তৈরিতে দ্রাবক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে এমন কিছু, যা বাতাসে মিশে কোনও ক্ষতি করবে না ইত্যাদি।

সবুজ রসায়নের অবদান
এত কাণ্ডের পর সবুজ রসায়ন কী দিল মানবজাতিকে? আইবুপ্রুফেন অ্যানালজেসিকের সবুজ রসায়নের নীতি মেনে শিল্প উৎপাদন একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই ওষুধটি পেয়েছে গ্রিন কেমিস্ট্রি অ্যাওয়ার্ড। আজকের ভিনিগার, ভিটামিন ডি-থ্রি এখন সবুজ রসায়নের নিয়ম মেনে তেরি হয়। প্লাস্টিক বায়োডিগ্রেডেবল নয়। মাটিতে মেশে এমন বেশ কিছু রাবার তৈরি হচ্ছে, যা বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক অর্থাৎ মাটিতে ফেলে দিলে আপনা থেকেই ধংস হয়ে যাবে। এখন বেশ কিছু কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে যা গ্রিন কেমিস্ট্রির অবদানে পরোক্ষভাবে জীবজগতের ক্ষতি করে না। সবুজ রসায়ন বিপ্লব ঘটিয়েছে পৃথিবী জুড়েই।

Latest article