নববর্ষ বললেই আমার হালখাতার কথা মাথায় ঘোরে। তার অনেকটাই স্মৃতিতাড়িত। নদীর তীরে এক শহরে বাড়ি আমার। ভূগোল বইয়ে সেই নদীর নাম হুগলি-নদী হতে পারে, কিন্তু আমরা নদীটাকে গঙ্গাই বলি। আর সে-বলায় খুব একটা ভুলও নেই। আসলে তো সেটা গঙ্গা-নদীরই প্রধান স্রোত। সেইজন্যে আমরা গঙ্গাচান করতে যাই। গঙ্গার ঘাটে বসে বিকেলে আড্ডা মারি।
শিশুকাল থেকে এই প্রৌঢ়বেলা অবধি দেখে আসছি, পয়লা বৈশাখের কাকভোর থেকে সব বয়সের নারী এবং পুরুষ আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা ধরে গঙ্গাস্নানে চলেছেন। সব বয়সের… কিন্তু সব শ্রেণির নন। যাঁরা স্নানে যেতেন এবং আজও যাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে নিম্নমধ্যবিত্তের সংখ্যাই বেশি। পুজোআচ্ছা, ব্রতটতর মতন প্রথাগুলো ওঁদের মধ্যেই বেঁচে থাকে। বেঁচে আছে।
সকালে গঙ্গাস্নান দিয়ে যার শুরু সেটাই গড়িয়ে যায় সন্ধেবেলার হালখাতার অনুষ্ঠানে। আমাদের মফসসল শহরে এই প্রথা এখনও দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। তার চেহারাতেও তেমন কিছু বদল ঘটেনি।
হালখাতা ছোট-ব্যবসায়ীদের আচরণীয় অনুষ্ঠান। এর মধ্যে একটা পুজোআচ্ছার অংশ থাকে, তবে সেটা ঘটে যায় বেশ নীরবেই। প্রতিদিন যে রানিং-ঠাকুরমশাই ফুলস্পিডে দোকানে ঢুকে কুলুঙ্গির গণেশ এবং লক্ষ্মীর মূর্তিতে ফুল-চন্দনের ছিটে দিয়ে যান, তিনিই সেদিন একটু বেশি সময় ধরে পুজো করেন। দোকানে নতুন লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তি আসে। লালশালুতে বাঁধানো নতুন জাবেদা-খাতায় টাকা দিয়ে সিঁদুরের ছাপ পড়ে। এই কাজটা বহু ব্যবসায়ী কালীঘাটে কিংবা দক্ষিণেশ্বরে গিয়েও করিয়ে আনেন— মানে ওই খাতাপুজোর কাজটা।
বরং সন্ধেবেলায় খদ্দের-লক্ষ্মীদের আপ্যায়নের কাজটাই তুলনামূলকভাবে বেশি সময় এবং গুরুত্ব পায়।
ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে পাড়ার কয়েরকটা বাঁধা দোকানে হালখাতা করতে যেতাম। ‘বাঁধা দোকান’ মানে ধরুন সম্বচ্ছর আমাদের যৌথ পরিবারের মুদিখানার জিনিস যেখান থেকে কেনা হত সেই গোষ্ঠ সাহার দোকান। কিংবা ভূপতি স্যাঁকরার দোকান— যেখান থেকে আমার কাকা আর পিসিদের বিয়ের গয়না গড়ানো হয়েছিল। কিংবা স্বদেশি বস্ত্রালয়ের মতন কাপড়ের দোকানগুলো— যেরকম দোকান থেকে আমাদের শহরের বাসিন্দারা সদ্যোজাতের অয়েলক্লথ আর বেবি-বালিশও কিনে থাকেন আবার অশৌচের কোরা কাপড় ইত্যাদিও। এককথায় জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মফসসলি মানুষের যৎসামান্য চাহিদা যারা মিটিয়ে আসছে সেইরকম দোকানগুলোর সঙ্গেই ছিল বাবার হালখাতার সম্পর্ক।
তখনও দেখতাম, দোকানিরা সেই পয়লা বোশেখের সন্ধ্যায় ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে, খুব গুরুত্বপূর্ণ মুখে বসে আছেন। দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র একজন কর্মচারী অভ্যাগতদের হাতে একটা করে সরু রোল করা ক্যালেন্ডার আর একটা ছোট মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিচ্ছে। এখনও তাই দেখি।
পরিবর্তন বলতে কিছু-কিছু জুয়েলারির দোকানের সামনেটায় আজকাল একটা ছাউনি বেঁধে প্লাস্টিকের চেয়ার সাজিয়ে দেওয়া হয়। একটা কী দুটো পেডেস্টাল পাখা ঘোরে আর ক্যালেন্ডার এবং মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফেরার আগে ওই ছাউনির তলায় বসে হাসি-হাসি মুখে এক বোতল কোল্ডড্রিঙ্কস পান করা যায়।
তা বাদে বাকি সব এক। এমনকী বাংলা ক্যালেন্ডারের ভেতরের ছবিতেও সেই রাধাকৃষ্ণ অথবা মা-কালীর পায়ের কাছে সারদা মা আর রামকৃষ্ণ কিংবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ছবি। মিষ্টির প্যাকেট খুললে আজও আদি এবং অকৃত্রিম একটি চিত্রকূট, দুটি সন্দেশ— তার একটি চৌকো এবং অন্যটি তিনকোনা— আর অবধারিত নিমকি একটি।
ভাল লাগে। খুবই ভাল লাগে এই একটি সন্ধ্যার বদল বিহীন চরিত্র। অনেক পরিবর্তনের ভিড়ে যখন নিজের অতীতটাকে প্রায় হারিয়ে ফেলতে বসেছি, তখন এরকমই এক-দুটো জিনিসের মধ্যে দিয়ে সেই অতীতকে যেন আবার ছুঁতে পারি।
আরও পড়ুন-হালখাতার উৎসমুখ…
আমাদের শহরের ধার ঘেঁষে বয়ে-চলা নদীর মতন, নদীর ওপাড়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের দীর্ঘ, সুঠাম অবয়বটির মতন এবং বৈশাখের সন্ধ্যার বেলফুলের গন্ধের মতন হালখাতার সন্ধেটাও আমার কাছে এক দূরের জানলা। তার মধ্যে দিয়ে মুখ বাড়ালে আমি আজও দেখতে পাই অধুনালুপ্ত গৌরী সিনেমা-হলের টিকিট কাউন্টার। তাঁতের শাড়ির খসখস শব্দ তুলে এইমাত্র যে-মহিলাটি হাতে ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে গয়নার দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন, তাঁর মুখে যেন আমার উত্তম-মুগ্ধ ছোটপিসির মুখ বসানো আর তাঁর শাড়ির রঙটা ঠিক গৌরী-হলের বারো আনার টিকিটের মতন স্বচ্ছ গোলাপি।
তবে, ইদানীং হালখাতার এই সুখের ছবির আড়ালে একটা প্রচ্ছন্ন আশঙ্কার ছবিও দেখতে পাই। তার কারণটাও কিছুটা বুঝতে পারি। সেটা বলতে গেলে আগে বাজার অর্থনীতির কয়েকটা সহজ কথা স্মরণে আনতে হবে।
কে না জানে, আমাদের এই বঙ্গে একটা ছোট দোকানের ভাগ্য চিরদিনই খুব অনির্দিষ্ট; ইংরেজিতে বললে আরও ভাল করে বোঝা যাবে— বড্ড ‘ভোলাটাইল’।ব্যবসার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেবার মতন শত্রু অনেক। সবচেয়ে বড় শত্রুর নাম ‘ক্রেডিট-সেল’, বাংলায় যাকে বলে ধারে বিক্রি। চাকরি-সূত্রে আমাকে ছোট-বড় নানান ব্যবসার হিসেবের খাতা দেখতে হয়। সেই সুযোগেই দেখেছি, শুধু বাজার থেকে বকেয়া টাকা আদায় করতে না পেরে কত নতুন ব্যবসা উঠে গেছে।
হালখাতার (Pahela Boisakh) মূল উদ্দেশ্য, এই সারা বছরের ধার-বাকির কিছুটা আদায় করা। এই দিনে দোকানির প্রচ্ছন্ন বক্তব্যটা থাকে এইরকম— হে আমার বাকির খরিদ্দার। পুণ্যদিনে আমার দোকানে আসুন। চা-তামাক সেবা করুন। মিষ্টি খান। কিন্তু তারপর বাড়ি ফেরার আগে সারা-বছর দোকানে যত বাকি রেখেছেন, তার কিছুটা অন্তত মিটিয়ে দিয়ে যান। সেই হিসেবে হালখাতাকে একটা আত্মরক্ষাকারী অনুষ্ঠানও বলা যায়।
অবশ্য এটাও মনে হয়েছে যে, এই অনুষ্ঠানের মধ্যে একটা ধন্যবাদ-জ্ঞাপনের দিক রয়েছে। বিক্রেতার পক্ষ থেকে ক্রেতাকে ধন্যবাদ। বছরের প্রথম দিনটিতে (Pahela Boisakh) স্বীকার করে নেওয়া যে, হে ক্রেতা, তুমিই আমার অন্নদাতা। বছরভোর তোমার মতন অজস্র ছোটখাটো খরিদ্দারের অসংখ্য ছোটখাটো খরিদ্দারির মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছে আমার পুঁজি, আমার লাভ।
আমার আশঙ্কাটা অন্য জায়গায়। দেখতে পাচ্ছি, চিরকালীন ক্রেডিট সেলের অভিশাপের সঙ্গে, এই পণ্যসভ্যতার যুগে, নতুন কিছু বিপদ যুক্ত হয়েছে। যেমন, দ্রুত পরিবর্তনশীল পণ্যসামগ্রীর বিপদ।
ধরুন, আজ একজন একটা পণ্যের দোকান দিল। পাঁচবছর বাদে সেই পণ্যটাই হয়ে গেল ব্যাকডেটেড। বাতিলই হয়ে গেল সেটা। ফলে সেই ব্যাবসা লাটে উঠল। যেভাবে লাটে উঠেছে ঘড়ি সারানোর দোকান, টেলিফোন বুথ, প্যাডেল-প্রেসের ছাপাখানা আর টেলরিং-শপ। নতুন টেকনোলজির ঢেউ বড্ড ঘন ঘন আছড়ে পড়ছে ইদানীং। সেই ঢেউয়ের সঙ্গে তাল রাখা কি ছোট ব্যবসায়ীদের সাধ্য? তা ছাড়াও আছে কর্পোরেট দুনিয়ার আগ্রাসন। ভাবুন, এখন তো শপিং-মলের শীতল পরিবেশে দাঁড়িয়েই মাসকাবারি মুদির বাজার করা যায়। সেই মালের দাম ডেবিট/ক্রেডিট কার্ডে মেটানো যায় এবং সেখানেই শেষ নয়… সেই মালের বোঝা শপিং-মল থেকে আপনার বাড়িতে বিনা-পয়সায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসারও ব্যবস্থা করে তারা। শুধু তাই বা কেন? অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে কোথাও যেতেই হয় না। ফোনে অর্ডার করলেন, বাড়িতে মাল পৌঁছে গেল।
বাড়িতে বসে কেনাকাটা করার এই নতুন সিস্টেমে অভ্যস্ত হতে মফসসলি মধ্যবিত্ত খরিদ্দারদের যেটুকু সময় লাগত, কোভিডের কারণে সেই সময়টুকুও লাগেনি। গত আড়াই-বছরে আমরা দিব্যি বাড়িতে বসে অনলাইনে খরিদ্দারি করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
এই সবই আমার আশঙ্কার কারণ। ভাবি, ছোট-দোকানদারদের দোকানগুলোয় কি খরিদ্দারের যাতায়াত কমছে? আরও কি কমবে আগামী দিনে? দশবছর আগে গোলদারি দোকানের মালিক গোষ্ঠ সাহার ছেলের কপাল যতটা মসৃণ দেখেছিলাম, আজ তার নাতির কপাল কি ততটাই মসৃণ দেখছি? নাকি সেখানে উদ্বেগের অনেকগুলো বাড়তি ভাঁজ ফুটে উঠেছে?
হয়তো এসব আমার নিজেরই দুশ্চিন্তার প্রক্ষেপণ। আশা করি আমার অজানা কোনও অর্থনৈতিক শক-অ্যাবজর্বার এই ছোট দোকানিদের ঘিরে রাখবে। বাইরের সমস্ত শক থেকে বাঁচিয়ে রাখবে তাদের।
পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যায় হাতে কয়েকটি পাকানো বাংলা ক্যালেন্ডার আর কাঁধের ঝোলায় দু-তিনটে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফিরতে-ফিরতে আমি মনে মনে বলি, তাই যেন হয় হে গণেশঠাকুর। তাই যেন হয় মা লক্ষ্মী। স্বদেশি বস্ত্রালয়ের নোনা-লাগা ঘরটার জায়গায় যেন রাতারাতি শপিং-মল গজিয়ে না ওঠে, সেটা তোমরা দেখো। অনেকগুলো মানুষের ভাত-ভিত্তি জড়িয়ে আছে ওই দোকানটার সঙ্গে।