বেশ কিছু টালবাহানা ছিল শুরুতে। তাই এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে বড়পর্দায় ফেলুদা ফিরছে খবরটা যত উত্তেজনা দিয়েছিল সংশয়ে রেখেছিল ততটাই। কারণ নতুন ফেলুদা কে হবে? কেই বা হবে জটায়ু এ নিয়ে দ্বিমতে পরিচালক ও প্রযোজকের বিচ্ছেদ, প্রায় রাতারাতি নতুন প্রযোজকের দায়িত্ব নেওয়া, এসব কিছু দেখে ফেলুদা-ফ্যানেরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত জট কেটে ঠিক সময়ে, নির্দিষ্ট লোকেশনে শ্যুটিং শুরু হলেও সংশয় যেন কাটেনি। বাঙালির মননে ফেলুদা এতটাই স্পর্শকাতর বিষয়। যতক্ষণ না পর্দায় দেখেছে তারা নিশ্চিন্ত হয়নি কেমন দেখবে তারা তাদের প্রিয় গোয়েন্দাকে। আর শেষ অবধি স্বস্তির শ্বাস। ছয় বছর বাদে বড়দিনে সপরিবার ফেলুদার ছবি, ‘হত্যাপুরী’ (Hatyapuri) দেখতে গিয়ে বাঙালির মনের তৃপ্তি স্পষ্ট। প্রমাণ, মাল্টিপ্লেক্স থেকে সিনেমা হল, সর্বত্র লম্বা লাইন। মাউথ পাবলিসিটিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া বার্তা, খোলা মনে, উদার চোখে নতুনকে যাঁরা মেনে নিতে জানেন, তাঁদের জন্য এ ছবি ‘ট্রিট’। সুতরাং বাকিরাও হল্মুখী। ফলে যাঁরা দ্রুততার সঙ্গে একমত হয়ে ভেঞ্চারটি শুরু করেছিলেন তাঁদের হাসি ক্রমশ চওড়া। সিদ্ধান্তে ভুল ছিল না তবে!
সত্যজিৎ রায়ের ‘হত্যাপুরী’ (Hatyapuri) ফেলুদা ফ্যানেদের পড়া থাকবে স্বাভাবিক। ১৯৭৯ সালে লিখিত গল্পটি কাহিনিকার ভেবেছিলেন প্রতিবেশী রাজ্য পুরীকে কেন্দ্র করে। সে সময় রাজ্যে লোডশেডিং ছিল। গরমে ওষ্ঠাগত ও বিরক্ত ফেলুদা স্রেফ বেড়ানোর জন্যই পুরী বেড়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু গোয়েন্দাদের বেড়ানো কবে আর নির্ঝঞ্ঝাট, নিরুপদ্রব হয়। ফেলুদা, তোপসে, লালমোহনবাবু ওরফে জটায়ুরও হয়নি। পুরী পৌঁছে সেখানে দ্বাদশ শতকের ‘অষ্টাদশসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’ এবং ‘কল্পসূত্র’ দুটি পুঁথিকে কেন্দ্র করে ত্রয়ীর রহস্যে জড়িয়ে পড়া এবং সেই সংক্রান্ত ঘটনা পরম্পরা গোয়েন্দা কাহিনির যাবতীয় মাল-মশলা সহ উপস্থাপিত হয়েছে যেমন বইয়ের পাতায় তেমনই পর্দাতেও। পুরী নিবাসী পুঁথি সংগ্রাহক দুর্গাগতি সেনকে নিয়েই কাহিনি শুরু। তাঁরই সংগ্রহে ছিল দুর্মূল্য পুঁথি দুটি। আচমকা সেগুলি গায়েব হয়ে যায়। একই সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়ে যান দুর্গাগতিবাবুর সেক্রেটারি নিশীথ বসু। জমে ওঠে রহস্য। কাহিনিতে আছে আরও অনেক চরিত্র। জ্যোতিষী লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য, পর্বতারোহী বিলাস মজুমদার, সোনায় মোড়া ধনী ব্যবসায়ী হিংগোরানি প্রমুখ। কাহিনিতে তাদের কী ভূমিকা তা বলে দিয়ে সিনেমা হলে যাওয়া মাটি করা এ প্রতিবেদনের কাজ নয়। যাঁদের বইটি পড়া তাঁরা জানেন কিন্তু তাঁরাও হলে গিয়ে যখন দেখতে বসবেন তখন নিশ্চিতভাবে উপভোগ করবেন নতুন করে। আর যাঁরা প্রথমবার দেখবেন তাঁদের জন্য তো দুর্দান্ত দুটি ঘণ্টা অপেক্ষা করে আছে।
আরও পড়ুন: চুরিতে শীর্ষে যোগীরাজ্য
যাঁরা ইতিমধ্যে ‘হত্যাপুরী’ (Hatyapuri) দেখেছেন, তাঁরা লাখটাকার প্রশ্নটির উত্তর পেয়ে গেছেন, অর্থাৎ ফেলুদা হিসেবে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তকে কতটা মানিয়েছে। কারণ এই প্রথম কোনও প্রবাসী বাঙালি এই আইকনিক চরিত্রটিতে অভিনয় করলেন। সত্যজিৎ রায়-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জুটির সমীকরণ-বোঝাপড়া যে আর হবে না তা বাঙালি মেনে নিয়েছে। সন্দীপ রায়ের নিজস্ব পছন্দের ফেলুদা হলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। নিজের ম্যানারিজম দিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন তিনি ফেলুদাকে। পরবর্তীকালে আবির চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে পরীক্ষায় নামলেও তা জমেনি তেমন। তাই একটা দুরুদুরু ছিলই। বিশেষত ওটিটি’র দৌলতে আরও কিছু ফেলুদাকে দর্শক ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছেন। কিন্তু ইন্দ্রনীল পরীক্ষায় সসম্মানে পাশ করে গেছেন। তাঁর ধারালো চেহারা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এমনিতেই সম্পদ। ফেলুদাতে যেগুলি আরও মাজাঘষা করে সুন্দর কাজে লাগিয়েছেন। যেমন ফেলুদার নিজস্ব ম্যানারিজম, সিগারেট ধরানো, চাউনি, মুচকি হাসি, হাঁটার ধরন সব ভালই আয়ত্ত করেছেন ইন্দ্রনীল। শুধু কিছু সময় কথায় অনভ্যাসের বাংলা ধরা পড়বে এটুকুই। তোপসের ভূমিকায় আয়ুষ দাস মন্দ নয়, ইনোসেন্সে উতরে গেছেন তবে আরও চৌকশ কাউকে পেলে বোধহয় ভাল হত। যদিও কাহিনিতে তোপসের খুব বড় কিছু ভূমিকা ছিলই না। আর সন্তোষ দত্ত, বিভু ভট্টাচার্য’র পর জটায়ুর ভূমিকায় অভিজিৎ গুহ নিজস্বতা দিয়ে ভালই করেছেন। মোটের ওপর ত্রয়ীকে নিয়ে দর্শক খুশি। বাকি ভূমিকাগুলিতে পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, ভরত কল, সাহেব চট্টোপাধ্যায়, দেবনাথ চট্টোপাধ্যায় এঁরা সকলেই চরিত্র অনুযায়ী যথাযথ।
‘হত্যাপুরী’ ভাল লাগার আর এক কারণ উপস্থাপনা। পরিচালক খুব নিটোলভাবে ছবিটি হাজির করেছেন। সেই সঙ্গে ভীষণ চেনা জায়গা হলেও পুরীকে পর্দায় দেখতে দারুণ লাগছে। হোটেলের ব্যালকনি থেকে সমুদ্রের দৃশ্য, ছবির ক্লাইম্যাক্স সবই সিনেমাটোগ্রাফির দৌলতে দুর্দান্ত দেখিয়েছে। সব মিলিয়ে পুরীতে ‘হত্যাপুরী’ জমজমাট।