ইন্টারনেট অব থিংস (Internet of things) কী
সারাদিনের ঘোড়দৌড়-ব্যস্ততার পর ক্লান্ত শরীরে মাঝরাতে নিদ্রা যাওয়ার পর ওই অ্যালার্ম-ই কাজে আসে সকাল সকাল ঘুম ভাঙানোর জন্য; অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠেই বিছানায় শুয়ে-শুয়েই সুইচ টিপে ওটা বন্ধ করে দিতেই আপনা-আপনি বাথরুমের গিজারটি চালু হয়ে যায়; বাথরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে স্মার্ট আয়নাটি আজকের আবহাওয়ার খবর জানান দেয়, সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলে দেয় মাথার উপর জলট্যাঙ্কে আর কতটা জল আছে; স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট বানাব বলে কিছু রান্নার টুকিটাকি নিতে যেই না রেফ্রিজারেটর খুলেছি অমনি কী কী মুদিখানার জিনিসপত্রের কম পড়েছে ও কী কী আনতে হবে তার একটা লম্বা ফর্দ ধরিয়ে দিল; এ কী রে বাবা! বাজার যাব বলে বেরিয়েছি, সদর দরজার বাইরে পা রাখতেই বাড়ির ভিতরের সমস্ত লাইট, ফ্যান, গিজার, এসি, টিভি, আলমারি, দরজা, জানালা, এমনকী সদর দরজাটিও আপনা থেকেই তালা বন্ধ হয়ে গেল; যাক বাবা নিশ্চিন্ত হলাম! গাড়ি চড়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ গাড়ি সাবধান করে দিল সামনে রাস্তায় খুবই জ্যাম রয়েছে তাই অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হবে; ভাবছি এই পথে একবার অফিস হয়ে যাব, ভাবতে ভাবতেই গাড়ি থেকেই অফিসে অগ্রিম মেসেজ চলে গেল। যাক এখন অনেকটা স্বস্তি অনুভব করছি। আসলে এসবই আধুনিকতম বিজ্ঞানের কেরামতি। যে কোনও জড় বা ইনার্ট এবং ভৌতিক বা ফিজিক্যাল বস্তু বা যন্ত্রে অন্তর্জালের উন্নত সংযোগ বা ইন্টারনেটের কানেক্টিভিটি এই ধরনের স্মার্ট প্রযুক্তির জন্ম দিয়েছে। এই বিশেষ ধরনের সংযোগ-পরিষেবা বিজ্ঞানের নাম ইন্টারনেট অব থিংস।
এনেছে বিপ্লব
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু বা যন্ত্র ও অন্যান্য যে কোনও কাজে দরকারি যন্ত্রসমূহে ইন্টারনেটের স্মার্ট সংযোগ ও প্রয়োগ মানুষের জীবনে বিপ্লব এনে দিয়েছে। বর্তমানে আবার এই ইন্টারনেট অব থিংস আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আওতায় এক অভিনব ও যুগান্তকারী রূপে নিজেকে মেলে ধরেছে। প্রাথমিকভাবে ইন্টারনেট অব থিংস (Internet of things) দুই বা তার বেশি সংখ্যক বস্তু বা যন্ত্রকে একটি নির্দিষ্ট নির্দেশাবলির উপর ভিত্তি করে কাজ করত, কিন্তু এখন সেইসব স্মার্ট যন্ত্র এখন তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনমাফিক সিদ্ধান্ত নিতেও সক্ষম হয়ে উঠেছে।
সুন্দর সংযোগস্থাপন
ইন্টারনেট অব থিংস (Internet of things) ঘর ও বাহির, গ্রাম ও শহর, পাওয়ার গ্রিড ও গাড়ি, বৈদ্যুতিক ও শৈল্পিক সরঞ্জাম, বাহন ও পরিচালনা এবং চিকিৎসা ও চাষবাস— সবক্ষেত্রেই আন্তর্জালের সহায়তায় সংযোগ ও মিথষ্ক্রিয়া সচল রাখে। এই পুরো প্রযুক্তিটিকে কম্পিউটার ও এমনকী স্মার্টফোনের সাহায্যে দূর থেকে পুরোপুরিভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আধুনিকতম সভ্যতায় সর্বত্রই এর বিরাট প্রয়োগ।
সর্বক্ষেত্রেই উন্নয়ন
স্মার্ট নগরীর পুরসভার আঁস্তাকুড়গুলো আপনা থেকেই দফতরে খবর পাঠিয়ে দেয় কখন সেগুলো খালি করতে হবে আবার কখন সেগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় স্থাপন করতে হবে। নির্দিষ্ট জায়গায় লাগানো সেন্সর ঠিক জানান দিয়ে দেয় আজ আকাশ মেঘলা থাকবে কি না, বৃষ্টি হবে কি না, তাপমাত্রা কি খুব বেড়ে যাবে, নাকি জাঁকিয়ে শীত পড়বে, জল ও বায়ুদূষণের মাত্রা কি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে! ওই গভীর অরণ্যে বসবাসরত আদিবাসীদের জীবনে কোনও দুর্যোগ নেমে আসেনি তো, ওদের বাসস্থান সুরক্ষিত আছে, ওই জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারেরা সব ঠিকঠাক চলাফেরা করছে তো, সবই ঘরে বসেই নজরদারি ও তদানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে এই ইন্টারনেট অব থিংসের উদারতায়। ওই প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে ঠিকঠাক বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে তো, কোনও জায়গায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি তো, সোলার প্যানেলগুলো সব কাজ করছে, বলে দিচ্ছে ইন্টারনেট অব থিংস! কারখানার সমস্ত শ্রমিক নির্দিষ্ট নির্দেশাবলি অনুসরণ করে কাজ করছে তো, উৎপাদনের গতি সমান আছে তো, কোথাও কোনও রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি তো, প্যাকেজিং সব সুন্দরভাবে হয়েছে, মালের জোগান সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে; এ সবই নিশ্চিত করে ইন্টারনেট অব থিংস! অফিসের কার্যনির্বাহী থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবা, মাটির গুণাগুণ বিচার থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস— সবকিছুতেই সাহায্য করছে এই প্রযুক্তি। কোন মাটিতে কোন সার প্রয়োগ করতে হবে, কোন বীজ বপন করলে ফলন বেশি হবে, সবেতেই ইন্টারনেট অব থিংস। বদলে দিয়েছে শিক্ষা গ্রহণ ও প্রদানের মাধ্যম। সবক্ষেত্রেই উন্নয়ন আজ উত্তমাশা!
আরও পড়ুন: কাল গিয়েছে ন্যাড়া পোড়া, আজ আমাদের দোল
ব্যবহারিক প্রয়োগ
মজার বিষয়, ১৯৯৯ সালে বিজ্ঞানী কেভিন অ্যাস্টন প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল কোম্পানিতে কর্মরত অবস্থায় ইন্টারনেট অব থিংসের (Internet of things) নামকরণ করলেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় অনেক আগেই। ১৯৮২ সালে কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র তাঁদের বিভাগীয় ভেন্ডিং মেশিনকে লোকাল নেটওয়ার্কের সাহায্যে মূল কম্পিউটার-এর সঙ্গে জুড়ে দেয় ঠান্ডা কোক-এর ডেলিভারির নজরদারি করার জন্য, তখন থেকেই যন্ত্রের সঙ্গে ইন্টারনেটের সংযোগ শুরু হয়ে যায়। এরপর ১৯৮৯ সালে সার্নে কর্মরত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী টিম বার্নার্স লি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আবিষ্কার করলেন এই প্রযুক্তির প্রয়োগ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৯০ সালে জন রমকি নামে একজন ইন্টারনেট অব থিংসের প্রয়োগে একটি টোস্টার আবিষ্কৃত করেন এবং ১৯৯১ সাল নাগাদ তিনি ওই টোস্টারের সঙ্গে ক্রেন সিস্টেম জুড়ে দিয়ে পুরো যন্ত্রটিকে স্বয়ংক্রিয় করে ফেলেন। এটিই প্রথম ইন্টারনেট অব থিংসের প্রয়োগিক যন্ত্র। এরপর ১৯৯৩ সালে ‘দ্য ট্রোজান রুম কফি পট’ নামে পৃথিবীর প্রথম ওয়েব ক্যাম প্রোটোটাইপ বানানো হয়েছিল যা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগানো হয়েছিল, কফিপটে কতটা কফি বেঁচে আছে দেখার জন্য! ১৯৯৮ সালে মার্ক ওইজার একটি সংযুক্ত জলের ঝরনা তৈরি করেন এবং ১৯৯৯ সালে বিজ্ঞানী কেভিন অ্যাস্টন রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন ট্যাগ ও ইন্টারনেট এরকে একত্রে জুড়ে দেন এবং ইন্টারনেট অব থিংসের নামকরণ করেন। ২০০৫ সালে জুন মাসে প্রথম স্মার্ট ঘর ‘নাবাজটগ’ তৈরি করা হয়। এরপর ২০০৮-’০৯ সালে একটি সমীক্ষায় দেখা যায় গোটা বিশ্বে ইন্টারনেট অব থিংসের প্রয়োগিক যন্ত্রের সংখ্যা গোটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি; তাই ওই বর্ষকে বলা হয় ইন্টারনেট অব থিংসের জন্মবর্ষ! ২০১৪ সালে তৈরি হয় প্রথম স্মার্ট শহর ‘টেস্টবেড’ ; ২০১৮ সালে এই প্রযুক্তি চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রবেশ করে এবং ২০২০ সালে করোনা অতিমারি কালে যুগান্তকারী সাহায্য করেছে এই বিজ্ঞান। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এই বিজ্ঞান আবার বিশেষ নামে পরিচিত ‘ইন্টারনেট অব মেডিক্যাল থিংস’। মনে করা হয় এই ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির ২০২৬ সালের মধ্যে বাজারমূল্য দাঁড়াবে প্রায় ১৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কোনও সন্দেহই নেই এই উন্নততর প্রযুক্তি-কালে ইন্টারনেট অব থিংস (Internet of things) আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ছত্রছায়ায় মহীরুহ রূপ ধারণ করেছে। এই বিজ্ঞান আমাদের ভবিষ্যৎকে এক নতুন আঙ্গিকে সাজাতে শেখাচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে বর্তমানে গোটা বিশ্বের মধ্যে এই ইন্টারনেট অব থিংসের প্রয়োগিক যন্ত্রের সংখ্যা প্রায় ২১.৫ বিলিয়ন যা সারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি! এ বিজ্ঞান সত্যিই বিস্ময়কর!