কেন কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে ছবি করার কথা ভাবলেন?
কবি জীবনানন্দ দাশকে আমার এখনও খুব সাম্প্রতিক বলে মনে হয় এবং একশো বছর পরেও উনি সাম্প্রতিক থাকবেন। সেই ছোটবেলায় ওঁর লেখার প্রতি আচ্ছন্নতার শুরু। আজকের পরিস্থিতিতে জীবনানন্দ দাশকে (Jibanananda Das) বাঙালির আবার ইতিহাসের পাতা থেকে খুঁড়ে বের করার দরকার আছে বলেই আমি মনে করি। এটাই ছবিটার (Jhora Palok) বানানোর তাগিদ।
এই ছবি কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
এই ছবিটা করতে চ্যালেঞ্জ যেটা ছিল সেটা হল— জীবনানন্দ দাশ এমনই একজন কবি যাঁর সম্পর্কে খুব কম জানা যায়। কারণ তিনি একজন নির্লিপ্ত কবি, নির্জনতম কবি, সুদূরের কবি— এই তকমাগুলো তাঁর গায়ে এঁটেছিল সাহিত্যসমাজই। কিন্তু এত নিশ্চুপ, নির্লিপ্ত একজন কবির বৈবাহিক জীবনও খুব জটিল ছিল। এক মধ্যবিত্ত শিল্পীর ক্রাইসিসকে পুঁজি করে তিনি একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লেখেন যার নাম ‘মাল্যবান’। যেখানে কবি নিজে তাঁর জীবনকে বিশ্লেষণ করেছেন। ছবিটা করতে গিয়ে এই উপন্যাসটি বিশেষভাবে সহয়তা করেছে।
আরও পড়ুন: বায়োপিক রকেট্রি দ্য নাম্বি এফেক্ট
গল্পের প্রেক্ষাপট কীভাবে ধরা হয়েছে?
১৮৯৯ থেকে ১৯৫৪ এই সময়সীমায় কবি জীবনে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন। ভয়ঙ্কর একটা সময় কবি দেখছেন এবং এই যুদ্ধের যে প্রভাব তা কবি অনুভব করছেন। সেই সময়কার কোনও কবি-সাহিত্যিক তাঁর মতো করে অনুভব করছেন না। তখন পাশাপাশি সারা পৃথিবীতে একটা লিটেরারি মুভমেন্টও শুরু হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে পৃথিবী জুড়ে যে রক্তের উল্লাস, অত্যাচার, মানুষের ভোগান্তি— এই সব কিছুর প্রতিফলন সাহিত্যে তখনও পর্যন্ত নেই বিশেষ করে ভারতীয় সাহিত্যে। কিন্তু জীবনানন্দর লেখনীতে সেই সামাজিক প্রেক্ষাপট সবসময় ছিল। কবির অবস্থান এবং সাংসারিক টানাপোড়েন, পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব— সবটাই এই ছবির উপজীব্য হয়ে উঠেছে। বাংলা ছবিতে গল্প বলার যে চলনটা রয়েছে এই ছবিতে সেটা নেই ফলে দর্শক কতটা নেবে এটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু সুখের বিষয় খুব ভাল রেসপন্স পেয়েছি।
জীবনানন্দের চরিত্রে কেন ব্রাত্য বসু?
চিত্রনাট্য লেখার সময়ই ওঁকে ভেবেই কাজটা এগিয়েছি। কারণ প্রথমত কবি জীবনানন্দের সঙ্গে ব্রাত্য বসুর চেহারার অত্যন্ত মিল। তার চেয়েও বড় হল আমার মতো একজন নগণ্য অডিও ভিসুয়াল কর্মীর কাছে ব্রাত্য বসু একটি প্রতিষ্ঠান। ব্রাত্য বসু হলেন জীবনানন্দজীবী। আমি ব্যক্তিগত ভাবে চেয়েছিলাম জীবনানন্দের চরিত্র চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে ব্রাত্যদার এই প্রাজ্ঞতা, তাঁর জীবনবোধ, শিল্পবোধ, কাব্যবোধ তাঁর মনন, পঠন-পাঠন এই সবকিছুর ছায়া যেন থাকে। এই ছবির প্রযোজক হলেন পবন কানোরিয়া। ব্রাত্যদাকে নিয়ে করতে চাইছি শুনেই এককথায় ছবিটা করতে রাজি হয়ে যান।
ছবির সঙ্গে জড়িয়ে অন্যান্য যাঁরা রয়েছেন?
প্রথমেই বলব জয়া এহসানের কথা। তিনি ছাড়াও এই ছবি অসম্পূর্ণ ছিল । জীবনানন্দর স্ত্রী লাবণ্য দাশের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। তিনি কবির জীবনে মায়ের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী। বিদুষী, সুন্দরী, অভিজাত পরিবারের মেয়ে এই লাবণ্য। বিয়ের পর থেকে জীবনানন্দ জীবনের বেশিরভাগ সময় কর্মহীন ছিলেন। তথাকথিত এলিট ক্লাস তাঁকে নিতে পারেনি। এমন একটা মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান করা সহজ নয়, অসুখী দাম্পত্য, প্রচণ্ড দারিদ্র্য তবু লাবণ্যপ্রভা বোঝেন তাঁর স্বামী একজন জিনিয়াস। একদিকে লাবণ্য তাঁকে পীড়ন করে আবার কবিই তাঁর অনুপ্রেরণাও। তাঁদের সম্পর্কের এই যে বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিকস্তর সেটা জয়া দারুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। লাবণ্যপ্রভা বাংলাদেশি ফলে সেই বাংলাদেশি ফ্লেভারটা আমি এই চরিত্রে চেয়েছিলাম। ব্রাত্য বসু এবং জয়ার এহসানের এই জটিল অথচ সুন্দর রসায়ন ছাড়া ‘ঝরাপালক’ (Jhora Palok) এই জায়গায় পৌঁছত না। অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। সজনীকান্ত দাশের চরিত্রে অভিনয় করেছেন যিনি এই ছবির অ্যান্টাগনিস্ট। আর রয়েছেন স্বয়ং প্রযোজক পবন কানোরিয়া, রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত এবং আরও অনেকেই।
এই ছবিতে তাঁর কবিতার কিছু লাইনকে গানের মতো করে ব্যবহার করা হয়েছে। সেই তিনটে গান এবং আবৃত্তি করেছেন সাত্যকি। রয়েছে একটা গোটা টিম যারা ছাড়া সম্ভব ছিল না এই ছবি করা।