বসন্তে রঙিন হয়ে উঠেছে পুরুলিয়া। নানা রঙের ফুল। আবির লেগেছে আকাশের গালে। ফুটছে পলাশ, ফুটছে শিমুল। এককথায় রূপের পসরা সাজিয়ে বসেছে প্রকৃতি। আছে পাহাড়, আছে জঙ্গল। এই সময় বহু মানুষ পুরুলিয়ায় বেড়াতে যান। ঘুরে দেখেন পছন্দের জায়গাগুলোতে। কিছু জায়গা প্রচলিত, কিছু অপ্রচলিত। খুব বেশি মানুষ জানেন না, তেমনই একটি জায়গা পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম জিতুজুড়ি। কংসাবতীর তীরে অবস্থিত। নদী এখানে আশ্চর্য রকমের শান্ত। ধীরস্থির ভাবে বয়ে চলেছে। তবে ভরা বর্ষায় অন্য চেহারা।
নদীতীরে ঘন সবুজ জঙ্গল। তার গা ঘেঁষে রয়েছে হাতিপাথর ব্যাক প্যাকার্স ক্যাম্প। সারাদিন পাখিদের কলতানে মুখরিত হয়ে থাকে এলাকা। এটুকু বাদ দিলে বেশ নির্জন, নিরিবিলি।
কাছে দূরে রয়েছে ছোট ছোট পাহাড়-টিলা। আলোয় একরকম, অন্ধকারে গা ছমছম। জঙ্গলের পাশে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় অনেকেই তাঁবুতে রাত্রিযাপন করেন। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। গভীর রাতে কান পাতলে শোনা যায় পশুদের পদধ্বনি এবং ডাক। কিছু নিরীহ, কিছু হিংস্র।
সবমিলিয়ে বাংলার অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের নতুন ডেস্টিনেশন জিতুজুড়ি (Jitujuri Village – Purulia)। এখানেই অবস্থিত মানবাজারের হাতিপাথর। ঘন সবুজ জঙ্গল ঘেরা হাতিপাথর যেন শিল্পীর আঁকা ছবি। একেবারে স্বপ্নের জগৎ। পুরুলিয়ার মানবাজারে এসে জিতুজুড়ি হয়ে হাতিপাথর যাওয়া যায়। আবার সোজা পুরুলিয়া শহর থেকে জিতুজুড়ি প্রায় ৪৪ কিলোমিটার। সেখান থেকে হাতিপাথর আড়াই কিলোমিটারের মধ্যে।
এখানে এলে পরিচয় ঘটে স্থানীয় লোকশিল্পের সঙ্গে। অল্প দিনেই সাড়া জাগিয়েছে ‘মাটির সৃষ্টি’ প্রকল্প। মানবাজার এক নম্বর পঞ্চায়েত সমিতি এবং জিতুজুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের উদ্যোগে সম্প্রতি এই পর্যটন কেন্দ্রের দরজা খুলেছে। সবুজ মাটিতে যেন নেমে এসেছে একটুকরো স্বর্গ। এখানে পর্যটকদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে চড়ুইভাতির আনন্দ। খাওয়া দাওয়া হয় শালপাতার থালা বাটিতে। আছে স্বনির্ভর গোষ্ঠী। তাঁদের আন্তরিক আপ্যায়নে উইকএন্ডের ছুটিতে দূষণহীন সবুজ অরণ্যের বুকে হারিয়ে যাওয়াই যায়। দারুণভাবেই সেজে উঠেছে হাতিপাথর পার্ক।
ছোটদের বিনোদনের জন্য রয়েছে নানান খেলার সরঞ্জাম। ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও মেতে উঠতে পারেন। পার্কে রয়েছে হরেক রকমের পাখি, টার্কি। আলাদাভাবে চোখ টানবে। সেই সঙ্গে মন মাতিয়ে দেবে স্থানীয় লোকশিল্পী দ্বারা পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছৌ, ঝুমুর, বাউল ইত্যাদি পর্যটকদের মন ভরিয়ে দেবে।
সামনেই পুঞ্চা। কমবেশি ৩০ মিনিটের দূরত্ব। সেখানে আছে জৈনদের মন্দির। বহু মানুষ মন্দিরটি দেখার জন্য যান। এছাড়াও ঘুরে দেখা যায় পুরুলিয়ার দোলাডাঙা। পুরুলিয়ার ঠিক উত্তরে, দোলাডাঙা একটি ছোট শহর। যেখানে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। শহরটি একটি পুরনো দুর্গের ধ্বংসাবশেষের পাশেই, যা ষোড়শ শতকের বলে মনে করা হয়। দুর্গটি একসময় কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হত এবং বলা হয় এখানে অনেক বিখ্যাত বন্দিকে রাখা হয়েছিল। আজ, দুর্গটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিন্তু এখনও পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় জায়গা।
কাছেপিঠে আছে আরও কয়েকটি বেড়ানোর জায়গা। পুরুলিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত গাজাবুরু পাহাড়। এখানে অনেক ছোট ছোট মন্দির ও উপাসনালয় রয়েছে। এটি পুরুলিয়ায় আসা তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।
আরও পড়ুন:আমেরিকার সঙ্গে নিউ–স্টার্ট চুক্তি বাতিল করলেন রুশ প্রেসিডেন্ট
পুরুলিয়ায় গেলে অবশ্যই দেখবেন মুরগুমা। এই ছোট গ্রামে জৈন মন্দির এবং রামকৃষ্ণ মিশন সহ অনেক দেখার মতো মন্দির রয়েছে। গ্রামটি ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের জন্যও সুপরিচিত। পুরুলিয়ায় উল্লেখযোগ্য স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম আড়শা। যা তার অনন্য স্থাপত্যের জন্য সুপরিচিত। এখানে আছে ভূজিয়া দুর্গ। দেখার মতো জায়গা।
কাশীপুরের শিকারের স্থান হিসাবে বিখ্যাত রাকাব বন। ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পুরুলিয়ার ধন লুট করার আগে রাকাব বন ১৬ ক্রোশের বন হিসাবে বিখ্যাত ছিল। এখানেই মহারাজাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় এবং দুর্গটি জেলার সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাহসী সাক্ষী হয়ে আছে।
পুরুলিয়ার একটি ছোট গ্রাম বড়ন্তি। একটি নিরিবিলি এবং মনোমুগ্ধকর জায়গা। এখানে চমৎকার হ্রদ এবং চারপাশে ছোটবড় পাহাড় রয়েছে। নাগরিক জীবন থেকে কিছুটা দূরে। শান্তি উপভোগ করার জন্য উপযুক্ত জায়গা। এছাড়াও রয়েছে কয়েকটি মন্দির। যা সত্যিই দেখার মতো।
এখন চলছে বিয়ের মরশুম। বিয়ের পরেই মধুচন্দ্রিমা। নবদম্পতিরা চাইলে এদিক-ওদিক না বেড়িয়ে জিতুজুড়ি (Jitujuri Village – Purulia) মানবাজারের চিরসবুজ প্রকৃতির কোলে দু’চার দিন কাটিয়ে আসতে পারেন।
কীভাবে যাবেন?
হাওড়া থেকে ট্রেনে বাঁকুড়া। সেখান থেকে বাস ধরে মানবাজার। মানবাজার থেকে হাতিপাথর প্রায় ১০ কিলোমিটার। অথবা হাওড়া থেকে পুরুলিয়া ট্রেন ধরতে পারেন। সেখান থেকে বাসে ৫৩ কিলোমিটার দূরে মানবাজার। ক্যাম্প আরও ১০ কিলোমিটার। জিতুজুড়ি-পুরুলিয়ার দূরত্ব ৪৪ কিলোমিটার। চাইলে স্টেশনে নেমে টানা গাড়িতে যেতে পারেন।
কোথায় থাকবেন?
রয়েছে দু’টি কটেজ, ছ’টি তাঁবু। একেবারে জঙ্গল ছুঁয়ে রাত্রিবাসের পাশাপাশি আছে খাওয়া-দাওয়ার সুব্যবস্থা। মাংস ভাতের পাশাপাশি মিলবে মুড়ি, ঘুগনি, চপ, লঙ্কা, পিঁয়াজও। বলা যায়, সবরকম খাওয়ারই ব্যবস্থা রয়েছে। তাঁবুর ভাড়া মোটামুটি মাথাপিছু ১২-১৩০০ টাকা। এবং কটেজ প্রায় ১৫০০ এর মতো। খুব সম্ভবত খাওয়া-দাওয়া এবং ক্যাম্প ফায়ার এই দামের সঙ্গেই ধরা থাকে। খাবারের মধ্যে পাওয়া যাবে যাবে ওয়েলকাম ড্রিঙ্কস, লাঞ্চ, ইভনিং স্নাক্স, ডিনার আর পরের দিন ব্রেকফাস্ট।