কোনও কোনও লেখকের যশভাগ্য এমনই হয় যে—তাঁদের সাহিত্যসৃষ্টির থেকেও ব্যক্তিপরিচয় বড় হয়ে ওঠে, তাঁদের রচনার থেকেও চর্চিত হয়ে ওঠে তাঁদের জীবন—কোনও সাহিত্যিকের কাছে এমনটা প্রার্থিত কি না জানা নেই, কিন্তু মহাশ্বেতা দেবীর (Mahasweta Devi) ক্ষেত্রে এমনটিই হয়েছে। তাঁর বিপুল রচনাসম্ভারের কিছু অংশই পাঠকসমাজ জেনেছে। বাঙালি পাঠকসমাজের কাছে তিনি একজন সাহিত্য ব্যক্তিত্ব, সমাজকর্মী, প্রতিবাদী, প্রখর রাজনীতি সচেতন এবং অবশ্যই মানবতাবাদী একজন ব্যক্তিত্ব—এই বহুকৌণিক ব্যক্তিত্ব হয়তো তাঁর সাহিত্যকীর্তিকে কিছুটা হলেও আড়াল করে দিয়েছে।
১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ছোটগল্প রচনার মাধ্যমে তাঁর সাহিত্যজগতে পদার্পণ—অবশ্য স্বনামে নয়, ছদ্মনামে। তিনি নাম নিয়েছিলেন সুমিত্রা দেবী ছদ্মনামে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘রংমশাল’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থ সম্পর্কে একটি আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিল—পরিণত বয়সে ছোটগল্প রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর আত্মপ্রকাশ—‘সচিত্র ভারত’-এ ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মরাচিঠি নামে একটি গল্প প্রকাশিত হয়, এরপর কুড়িটি গল্প ছদ্মনামে তিনি রচনা করেন। পাশাপাশি চলছিল ইতিহাসভিত্তিক ‘ঝাঁসির রানী’ রচনার প্রস্তুতি—এই তথ্যসমৃদ্ধ অথচ উপন্যাসের কাঠামোয় গ্রন্থটি লেখার জন্য তিনি শিশুপুত্র নবারুণকে রেখে ঝাঁসি পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন এবং বহু পরিশ্রমে গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন—প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে।
ব্যক্তিগত জীবন, সমাজ ও রাজনীতি নানা উত্থান পতন মহাশ্বেতার (Mahasweta Devi) সৃষ্টিশীলতাকে স্তব্ধ করতে পারেনি, বরং তা সমৃদ্ধ হয়েছে, হয়েছে নানা বাক্পরিবর্তন। এই পরিবর্তনকে সমাজ ও রাজনৈতিক বিচলনের সঙ্গে একেবারে সুচিহ্নিত করা যায়, কারণ তিনি ছিলেন সমাজ ও মানবজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও সংবেদনশীল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাঁর প্রায় ২৩টি উপন্যাস ও চারটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেগুলি সেই সময় পাঠক সমাদৃত ও স্বাদু পরিবারিক উপন্যাস। কিছু উপন্যাসে ভিন্ন জগতের স্বাদ দিতে চেয়েছিলেন— যেমন সার্কাসের মেয়েদের জীবন নিয়ে উপন্যাস ‘প্রেমতারা’ বা মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন নিয়ে লেখা ‘তারার আঁধার’। তবে এই পর্যায়ের অন্যতম রচনা ‘কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু’—বাংলাদেশের মধ্যযুগের পটভূমিতে রচিত এই ভাষা, শৈলী ও জীবনদর্শনের দিক দিয়ে অনবদ্য এবং মহাশ্বেতার শ্রেষ্ঠ লেখাগুলির মধ্যে অন্যতম। ছোটগল্পের মধ্যে এই পর্যায়ে ‘রোমহা’ (সেনযুগের বাংলার পটভূমিতে রচিত) গল্পটি ব্যতীত বাকি গল্পগুলি অত্যন্ত সাধারণ।
আরও পড়ুন-৫০ লক্ষ! সব রেকর্ড ভাঙবে এবার গঙ্গাসাগর
মহাশ্বেতার (Mahasweta Devi) দীর্ঘ সাহিত্যজীবন বিশ্লেষণ করলে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হয় সত্তরের দশককে। সব চেতনাসম্পন্ন বাঙালির মতোই সত্তরের দশক মহাশ্বেতাকে আলোড়িত করেছিল। মহাশ্বেতা চেয়েছিলেন সময়ের দলিলীকরণ করতে। যেটা মহাশ্বেতা সম্পর্কে বলা হয় না সেটি হল—মানবের প্রতি তাঁর অপরিসীম মায়া। এই মায়ার জন্যই যেখানে মানবতার অপমান তিনি দেখেছেন সেখানেই তাঁর ব্যক্তিসত্তা ও লেখকসত্তা একসঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠেছে। সেই প্রতিবাদের সুর শোনা গেল ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে (১৯৭৪)। এরপর মহাশ্বেতা বাঙালি লেখকদের চিরাচচিত মধ্যবিত্ত জীবনের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এলেন। বেরিয়ে এলেন নিজের ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবনের ক্ষেত্রেও—কারণ সমাজের এক বিরাট অংশের না-বলা কথা প্রকাশের দায়ভার তাঁকে তাড়া করে ফিরছিল, এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে বিরাট ভারতবর্ষের বিপুল সংখ্যক অথচ অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তাই একের পর এক রচনা করেছিলেন অরণ্যের অধিকার (গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ১৯৭৭), চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর (১৯৭৯), তিতুমীর (১৯৮৪), বন্দোবস্তী (১৯৮৮), টেরোড্যাকটিল, পূরণ সহায় ও পিরথা (১৯৮৯), আগুন জ্বলেছিল (১৯৯৪), কৈবর্তখণ্ড (১৯৯৪) ইত্যাদির মতো উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। বাংলার পাঠককে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন এমন এক ভারতবর্ষে যেখানে আমাদের যাপিত জীবন, সযত্নে লালিত মূল্যবোধ, সুকুমার নন্দনতত্ত্ব বারংবার আহত হয়। অধিকাংশ সাহিত্য সমালোচক সত্তর পরবর্তী লেখায় মহাশ্বেতার প্রতিবাদের সুরটিকে নকশাল আন্দোলন বলে চিহ্নিত করতে চান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মহাশ্বেতা মুখোমুখি হয়েছিলেন সত্তর দশকে উত্থাপিত প্রশ্নগুলির। মানুষের অধিকারের প্রশ্ন। তাই সত্তর পরবর্তীকালে তাঁর লেখায় ভিড় করে এল ভারতবর্ষের প্রান্তিক জনসমাজ। তাঁর লেখাকেও ফেরালেন না। তাই তাঁর কলম থেকে একের পর এক বেরিয়ে এল ‘দ্রৌপদী’, ‘অপারেশন’, ‘বসাই টুডু’, ‘জল’, ‘এমডব্লু বনাম লখিন্দ’, ‘বিছন’, ‘বাঁয়েন’, ‘স্তনদায়িনী’, শালগিরার ডাকে, উর্বশী ও জনি, দৌলত, আজীর, সংরক্ষণ, নুন, গান্ধী ময়দান ও রঘুয়া দুসাদ, লাইফার, আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ, জগমোহনের মৃত্যু, শেষ শামানিন, লালগড়ের মা-এর মতো অজস্র ছোটগল্প। এইসব গল্প-উপন্যাসে ভিড় করে এল সাঁওতাল, মুণ্ডা, লোধা, শবর, ভূমিজ প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠী, এল খেতমজুর, শ্রমিক, কৃষক, ডোম সমাজের কথা, এল প্রচীন দেহব্যবসার কথা। তথ্যপ্রমাণ সহযোগে বহু লেখা লিখলেন মহাশ্বেতা। লিখলেন আশির দশকেও কীভাবে ভারতবর্ষের বুকে চলে দাসব্যবসা—লিখলেন অচ্ছুত সম্প্রদায়ের কথা, ভারতবর্ষের মূলস্রোতের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতির জাঁতাকলে হারিয়ে যাওয়া আদিবাসী গোষ্ঠী ও সংস্কৃতির কথা। তৈরি করলেন নতুন এক লিখনশৈলী—সেখানে গল্প মানেই বানানো রূপকথা নয়, নির্মম সমাজসত্য। তাই মহাশ্বেতা লিখতে পারেন—‘এমন একটি ঘরের বর্ণনা দিইনি, যেখানে নিজে থাকিনি, এমন খাদ্যের কথা লিখিনি, যা খাইনি, এমন নদী বা পুকুরের কথা লিখিনি, যেখানে স্নান করিনি৷’ (ভূমিকার পরিবর্তে— মহাশ্বেতা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী রচনাসমগ্র, খণ্ড ১২, দে’জ প্রকাশনী)
বাঙালি পাঠককে তিনি চেনাতে চেয়েছিলেন এক অন্য ভারতবর্ষকে প্রায় একশোটি উপন্যাস ও ৪৭টি গল্প সংকলনে প্রায় ২৩০টি ছোটগল্পের মাধ্যমে (এর বাইরেও আরও গল্প-উপন্যাস থেকে যাওয়া সম্ভব)। ‘লেখিকা’ শব্দটিতে প্রবল আপত্তি ছিল তাঁর। বহুবার শুনতে হয়েছে তাঁকে যে তিনি পুরুষদের মতো লেখেন। কিন্তু পুরুষরাও অনেকসময় তীব্র বাস্তবতাকে তুলে ধরতে হয়তো পারতেন না মহাশ্বেতার মতো—সেখানে এই দেশে না খেতে পেয়ে মরে যেতে মাত্র চোদ্দ জন আগারিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ বেঁচে থাকে – কিন্তু পুষ্টির অভাবে শুকনো রুক্ষ দেহ–শিশুসদৃশ-রিলিফ অফিসারকে রাতের অন্ধকারে ঘিরে ধরে তারা বলে—
—মরতে মরতে মোরা এই চোদ্দজনা আছি। খেতে পাই না বলে দেহ শুকিয়ে ছোট হয়া গিয়াছে। পুরুষরা শুধু মুতে যায়, রাতের কাম উঠাতে পারে না। মেয়েদের পেটে ছেলা আসে না। তাতেই মোরা রিলিফ চুরাই। খেয়ে খেয়ে আবার ত বড় হতে হবে কি না বল্?
—নাঃ! নাঃ! নাঃ!
—আগরিয়ারা মোরাদের মদত দেয়। কুভার বলোয়ার লেগ্যে মোরাদের এই হাল।
কুভার বলোয়া!
—নাঃ! নাঃ! এ হতে পারে না।
কেননা এ যদি সত্য হয়, তাহলে সব মিথ্যা। কোপার্নিকাসের বিশ্ববিন্যাস, বিজ্ঞান, এই শতক, এই স্বাধীনতা, এই প্ল্যানের পর প্ল্যান। তাই রিলিফ-অফিসার বলে চলেন, নাঃ নাঃ নাঃ।
—‘না’ বললে ‘না’ হবে? তবে এগুলো হল কী করে? ই গুলান্ দেখে বুঝিস না, মোরা ছেলাপিলা নই?
ওরা পিশাচ আনন্দে, প্রতিহিংসার উল্লাসে খিক-খিক করে হাসে। তারপর ওরা ওঁকে ঘিরে ছুটতে থাকে, হাসতে হাসতে। মাঝে মাঝে ওঁর গায়ে ঘষে দেখায় পুরুষাঙ্গ, বুঝিয়ে দেয়, ওরা পূর্ণবয়স্ক ভারতীয় মানুষ। (শিশু)
এই নিষ্ঠুর অমানবিক, বাস্তব সমাজের ছবি মহাশ্বেতা আঁকেন। তাই তাঁর লেখার মধ্যে এক ভয়ানক রাগী কণ্ঠস্বর উঁকি দিয়ে যায়। কিন্তু, তাঁর শিল্পীসত্তাকে কোথাও খর্ব করেননি। বরং আপাত শৃঙ্খলহীন বৃত্তগঠন, অতি সংক্ষিপ্ত অথচ তীক্ষ্ম সংলাপ নির্মাণ, দেশজ শব্দের বিপুল ব্যবহার তাঁর লেখাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
মহাশ্বেতা বাংলা সাহিত্যের গতিকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করে নতুন লেখক সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন বললেও অত্যুক্তি হয় না। যাঁরা স্থানিক ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৌমচেতনাকে অবলম্বন করে অনেক উপন্যাস রচনা করেন—যা মূল ইতিহাস চেতনার সমান্তরালে অন্য এক ধরনের ইতিহাসের প্রতিস্পর্ধী ধারা তৈরি করে। অভিজিৎ সেন (বর্গক্ষেত্র, ‘রহু চণ্ডালের হাড়’) ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায় (‘বন্দর’ চরপূর্ণিমা), অনিল ঘড়াই (নুনবাড়ি), সৈকত রক্ষিত (‘কুশকরাত’ ‘মদনভেরি’)—একঝাঁক তরুণ লেখক তাঁদের প্রতিভাকে ব্যবহার করেছেন মহাশ্বেতার দেখানো পথ ধরেই, এখানেই বাংলা সাহিত্যজগতে মহাশ্বেতা (Mahasweta Devi) অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছেন।