পাহাড়িয়া রাজ্য মণিপুর (Manipur)। পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সুপ্রাচীন ঐতিহ্য, উন্নত সংস্কৃতি। আবহাওয়া অতি মনোরম। সবুজ বনাঞ্চল, সুউচ্চ পাহাড়, স্বচ্ছ জলের ঝরনা প্রতি মুহূর্তে হাতছানি দেয়। আছে সুগন্ধী চায়ের বাগান। তার সঙ্গে জিভে জল আনা রকমারি খাবার। সব মিলিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের অপূর্ব সুন্দর রাজ্য মণিপুর প্রাণখুলে বেড়ানোর আদর্শ জায়গা। বাঙালিদের অত্যন্ত পছন্দের।
মণিপুর শব্দের অর্থ ‘মণির দেশ’। কথিত আছে, মণিপুর জায়গাটি নাকি আবিষ্কৃত হয় দেবতাদের নৃত্যের আনন্দের ফলে। এখানকার লোকনৃত্য জগৎবিখ্যাত।
১৮৯১ সালে ইঙ্গ-মণিপুরি যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এই প্রাক্তন দেশীয় রাজ্যটি ব্রিটিশদের দখলে আসে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয় মণিপুর। ১৯৭২ সালে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের রূপ পায়।
মহাভারতেও আছে মণিপুরের (Manipur) উল্লেখ। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন মণিপুর রাজ্য পরিভ্রমণে গিয়ে গন্ধর্বরাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার রূপে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে বিয়ে করেন। অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার সেই প্রেমকাহিনি নিয়ে ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বহু সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালিরই মণিপুর রাজ্যের সঙ্গে পরিচিতি রবীন্দ্রনাথের এই অনবদ্য নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে।
মণিপুরে আছে বেশ কয়েকটি বেড়ানোর জায়গা। পর্যটকরা ঘুরে দেখতে পারেন। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য :
কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্যান
বিশ্বের একমাত্র ভাসমান জাতীয় উদ্যান কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্যান। মণিপুরের বিখ্যাত লোকটাক হ্রদের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। সেন্দ্রা নামের একটি দ্বীপ রয়েছে লোকটাক হ্রদে। দ্বীপের আয়তন প্রায় ৪০ বর্গ কিলোমিটার। এই দ্বীপেই রয়েছে কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্যান। এটি মূলত অভয়ারণ্য। এখানে রয়েছে বিখ্যাত মণিপুরি সাংগাই হরিণ। এটি বর্তমানে বিলুপ্ত প্রজাতির। ভাসমান এই জাতীয় উদ্যানে পৌঁছোনোই একটি রোমাঞ্চকর ঘটনা। জঙ্গলে প্রবেশ করলে দেখা মেলে বুনো শিকারি কুকুর, ভোঁদড়, বুনো শূকর, ভারতীয় গন্ধগোকুল, বন বিড়াল, এশিয়ান সোনালি বিড়াল, বাঁশ ইঁদুর, সরু মুখের ইঁদুর, ময়াল সাপ, কচ্ছপ, ডোরাকাটা শঙ্খচূড়, এশিয়ার ইঁদুর খেকো সাপ ইত্যাদির। এছাড়াও দেখতে পাওয়া যায় হিমালয়ের শিকারি মাছরাঙা, বর্মীয় ময়না-সহ বিচিত্র বিরল প্রজাতির পাখি। মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে ভাসমান জাতীয় উদ্যানের দূরত্ব মাত্র ৪৫ কিলোমিটার।
রেনগান অরণ্য
মণিপুরের (Manipur) আদিবাসীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র তামেংলং জেলার রেনগান অরণ্য। বনের সম্পদ থেকেই আদিবাসীদের রুজি রোজগার। সংগ্রহ করেন বনের ফল, ভেষজ, কাঠ, মধু। এখানকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এককথায় অসাধারণ। চোখে পড়বে নানা প্রজাতির পাখি। অনুমতি নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে আসা যায়।
আরও পড়ুন-পাহাড়ে পর্যটন উৎসব
ডেইলং বায়োডাইভার্সিটি হেরিটেজ
ভারতের ১২টি জীববৈচিত্র্য হেরিটেজ সাইটগুলির মধ্যে দুটি রয়েছে উত্তর-পূর্বে। অসমের মাজুলি এবং মণিপুরের টেমেংলং জেলায় ডেইলং। স্থানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দুর্লভ প্রজাতির ভারতীয় বুনো কমলার খোঁজ পাওয়ার পর থেকেই। এই কমলা লেবুটি বিশ্বের প্রাচীনতম সাইট্রাস ফলের উদাহরণ।
শিরুই পাহাড়
মণিপুরের (Manipur) উখরুল। শহরটি ছবির মতো সুন্দর। এখানে উপত্যকা, ঝরনা, ছোট নদী সবই আছে। এই উখরুলেই অবস্থিত শিরুই পাহাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দূরত্ব প্রায় ২৮৩৫ মিটার। পাহাড়ে প্রায় সারা বছরই ঠান্ডা থাকে। ফোটে নানা ধরনের ফুল। শিরুই পাহাড় ঘোরার শেষে উরখুলের খায়াং পার্ক, শিরুই কাশুং শৃঙ্গ, কোচুই ফুং হ্রদ, খাংখুই গুহা, হংডুং মাংভা গুহা, নিল্লাই চা-বাগান, অ্যাঙ্গো চিং ইত্যাদি ঘুরে দেখা যায়।
বরাক নদী
ভারতের চার রাজ্যের উপর দিয়ে প্রবাহিত উত্তর-পূর্ব ভারতের বরাক নদী। তারপর বাংলাদেশ পেরিয়ে গিয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। অসমের মহিপুর এবং কাছাড় জেলায় সুরমা নদীর উজান প্রবাহপথের নামই হল বরাক। প্রায় ৫৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী। নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম এবং অসমের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে। উৎপত্তি স্থল মণিপুরের লিয়াই কুলেন গ্রাম। গ্রামের অধিকাংশই বাসিন্দাই পাউমানি নাগা উপজাতি। এই অঞ্চলে বরাক নদীর নাম ভৌরী। নদীর উৎসের কাছে রয়েছে প্রচুর ঝরনা। গুমতি, হাওড়া, কগনি, সেনাইবুড়ি, হরিমঙ্গল, কাকরাই, কুরুলিয়া, বালুঝুরি, শোনাইছড়ি এবং দুরদুরিয়া ঝরনাগুলি প্রত্যেকটিই বেশ আকর্ষণীয়। জলজ জীব বৈচিত্র্যের পরিপ্রেক্ষিতে বরাক বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ নদীগুলির মধ্যে অন্যতম। এখানে নিওন টেট্রা-সহ প্রায় ২,০০০ প্রজাতির মাছ আছে। এ ছাড়াও বিরল এবং বিপন্ন প্রজাতির সিয়ামিজ কুমির বরাক নদীতে বাস করে। জলে আছে শুশুক, ডলফিন, ভোঁদড় এবং কালো রঙের কুমির। বরাক নদীর উপত্যকা বন্যপ্রাণীতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই উপত্যকাটি ঘুরে দেখা যায়।
কীভাবে যাবেন?
মণিপুর পৌঁছোনো যায় বিমান, রেল এবং সড়ক পথে। মণিপুরের রাজধানী শহর ইম্ফলে একটি বিমানবন্দর রয়েছে। ইম্ফল বিমানবন্দর দিল্লি, কলকাতা এবং গুয়াহাটির মতো প্রধান ভারতীয় শহরগুলির সঙ্গে আকাশপথে যুক্ত। মণিপুর রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন মোদপুর। এ ছাড়াও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর যেমন গুয়াহাটি, ডিমাপুর এবং শিলচর রেল স্টেশন থেকে সড়কপথে মণিপুর যাওয়া যায়। মণিপুরে ভারতীয়দের ভ্রমণের জন্য অন্তঃসীমা অনুমতিপত্র প্রয়োজন হয়। এটি নতুন দিল্লি, কলকাতা, গুয়াহাটি, শিলং-এর নাগাল্যান্ড সরকারের সংযোগ কর্মকর্তা ও সাব-ডিভিশনাল অফিস (সিভিল) ডিমাপুর, জেলা প্রশাসক ইম্ফল থেকে পাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন?
ইম্ফল-সহ মণিপুরের বিভিন্ন শহরে আছে অসংখ্য হোটেল, গেস্ট হাউস। সব জায়গায় থাকা এবং খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে। খরচ নাগালের মধ্যে। প্রসঙ্গত, মণিপুর ভ্রমণের সেরা সময় অক্টোবর থেকে এপ্রিল। এপ্রিলের পর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানে বেশ গরম থাকে। যদিও সকাল এবং সন্ধ্যার দিকে আবহাওয়া বরাবরই মনোরম। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে অন্যরকম সাজে সেজে ওঠে এই পাহাড়ি রাজ্য। শীতকাল মণিপুর বেড়ানোর অন্যতম সেরা সময়।