দুই বাংলার মায়ার জঞ্জাল

ভাষা, ভাবনা, সংস্কৃতির সাদৃশ্য শুধু নয়, দুই বাংলার নাড়ির টান আজও অটুট একইরকম। ভৌগোলিক সীমানা যা-ই বলুক, আবেগ বলে আলাদা কথা। আর তাই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বাইরে, বারে বারে দুজনকে এক জায়গায় এনে দেয় সংস্কৃতির ভিন্ন ক্ষেত্র। যৌথ উদ্যোগে একাকার হন গুণিজনেরা, প্রাপ্তি হয় বাকিদের। পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরির ছবি ‘মায়ার জঞ্জাল’ তৈরি হয়েছে দুই বাংলার যৌথ প্রয়াসে। মুক্তি পাচ্ছে আজ। জানাচ্ছেন প্রীতিকণা পালরায়

Must read

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি ছোটগল্প ‘বিষাক্ত প্রেম’ ও ‘সুবালা’ অবলম্বনে নির্মিত ‘মায়ার জঞ্জাল’ পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরির নতুন ছবি। বাংলাদেশ ও ভারত, যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত সিনেমাটির ইংরেজি নাম ‘ডেব্রি অফ ডিজায়ার’। একেবারে নতুন বলাও ভুল হবে, সাধারণ দর্শকের কাছে নতুন হলেও যাঁরা সিনেমা-চর্চার মধ্যে থাকেন তাঁরা জানেন ‘মায়ার জঞ্জাল’ তৈরি হয়ে গিয়েছিল ২০২০-তেই। ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়েছে সাংহাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ইউরোপিয়ান প্রিমিয়ার হয়েছে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। এ ছাড়াও মাঝের সময়টিতে পৃথিবী জোড়া আরও বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে আমন্ত্রিত হয়েছে ‘মায়ার জঞ্জাল’ (Mayar Jonjal) সেই সঙ্গে ফেস্টিভ্যালের প্রতিযোগিতাতেও অংশগ্রহণ করেছে। তার মধ্যে আছে জাকার্তায় জোগজা-নেটপ্যাক এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, রোমের এশিয়াটিক্যা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, লন্ডনের রেইনবো চলচ্চিত্র উৎসব এবং ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। সর্বত্র সবিশেষ প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। তাই সীমিত সংখ্যায় হলেও অনেকেরই এ ছবি দেখা। তবে তাঁরাও অপেক্ষায় ছিলেন কবে এ ছবি সাধারণ দর্শক দেখতে পাবেন। সেই শুভদিনটি সমাগত।

এক সাহিত্যিকের দুই গল্পকে মিলিয়ে একটি ছবি বানানোর ভাবনা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। চিত্রনাট্যে অদ্ভুতভাবে দুটি গল্পকে মিলিয়েছেন ইন্দ্রনীল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজে মনে করেন সমাজের সব শ্রেণির গল্প, জীবনযাপনই সিনেমা-মাধ্যমে উঠে আসা উচিত। যেটা হাল আমলের নির্মাতাদের খামতি। বেশিরভাগ ছবিই সমাজের নির্দিষ্ট অংশের গল্প বলে। আর তাই ভাবনার পরিধি ছোট হয়ে যাচ্ছে শুধু নয়, একঘেয়েমিও এসেছে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই। ২০১৩-তে ‘ফড়িং’ ছিল ইন্দ্রনীলের বড়পর্দার প্রথম ভেঞ্চার। এরপর টেলিভিশনের জন্য ‘একটি বাঙালি ভূতের গপ্পো’, ‘ভালোবাসার শহর’ নামে স্বল্প দৈর্ঘ্যের একটি ছবি, বেশ কিছু চিত্রনাট্য, ইত্যাদি নানা কাজ করলেও ‘মায়ার জঞ্জাল’ (Mayar Jonjal) অনেকদিন পর ইন্দ্রনীলের বড়পর্দার প্রচেষ্টা। জানিয়েছেন, ‘বিশ্বাস-অবিশ্বাস, চেনা- অচেনার দ্বন্দ্ব ঘিরে এই ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে।’

দুই বাংলার কলা-কুশলী ও শিল্পীরাই কাজ করেছেন ‘মায়ার জঞ্জাল’-এ (Mayar Jonjal)। এই ছবিতে অনেকদিন পর বড়পর্দায় অভিনয়ে ফিরেছেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী অপি করিম। ২০০৪-এ সরয়ার ফারুকির পরিচালনায় ‘ব্যাচেলর’ ছিল অপি করিমের প্রথম চলচ্চিত্র। এরপর আর বড়পর্দায় পাওয়া যায়নি তাঁকে। ছবিতে তাঁর চরিত্রের নাম সোমা। কলকাতায় স্বামী ও একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। স্বামী বেকার। তাই সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতে একটি বাড়িতে বয়স্ক একজনকে দেখাশোনার কাজ করতে শুরু করে সে। সেই চরিত্রটিতে আছেন পরান বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সোমার স্বামী চাঁদু চায় না তার স্ত্রী লোকের বাড়ি কাজ করুক। এদিকে তার নিজেরও উপার্জন সেভাবে নেই। চাঁদুর সঙ্গে দেখা হয় এক চোরের। চাঁদুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী। বাকি চরিত্রগুলিরও নিজস্ব জোরালো গল্প আছে। অভিনয়ে আরও আছেন সোহেল মণ্ডল, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, শাঁওলি চট্টোপাধ্যায়, কমলিকা ব্যানার্জি। এ ছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী তথা অভিনেতা ও পরিচালক ব্রাত্য বসু।

আরও পড়ুন: মোদি-নির্মলার বাজেটে তরুণের স্বপ্ন উপেক্ষিত

প্রযোজনার দায়িত্বে আছেন কলকাতার ফ্লিপবুক ও ঢাকার প্রযোজক জসিম আহমেদ। জসিম নিজে তিনটি স্বল্প দৈর্ঘের ছবি পরিচালনা করেছেন। ‘দাগ’, ‘চকোলেট’ ও ‘আ পেয়ার অফ স্যান্ডাল’। তবে এ ছবির প্রযোজক হলেও সিনেমা প্রযোজনা নিয়ে জসিমের স্পষ্ট কিছু মতামত আছে। খোলা মনেই বলেন, “আজকাল সিনেমায় প্রযোজক কম ইনভেস্টর বেশি! তাই তাঁদের নির্দেশ ও মতামত মাথায় নিয়ে ছবি বানাতে হয় অনেকক্ষেত্রেই। এটা একটা সংকট। অনেক মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিমান পরিচালক আছেন যাঁরা নিজের মতো করে ছবির গল্প বলতে চান কিন্তু ‘মার্কেটের’ কথা ভেবে তাতে ইনভেস্ট করতে রাজি হন না অনেকে। তাই সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে নির্মাতারাই যদি প্রযোজনায় এগিয়ে আসেন কিছুটা হলেও সুবিধে হয়।”

সম্প্রতি কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় এক অনুষ্ঠানে ছবিটির ট্রেলার লঞ্চ অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে ঋত্বিক জানিয়েছিলেন, “ইন্দ্রনীল কোনওদিনই শুধু পরিচালনার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখে না। সিনেমার সঙ্গে ওর যোগ ভীষণ আত্মিক। গল্প থেকে, চিত্রনাট্য, লোকেশন সবকিছুর মধ্যে ও প্যাশনেটলি জড়িয়ে থাকে। আর ভীষণই ঠান্ডা মাথায় সবটা করে। এটুকু বলতে পারি আমরা সবাই অত্যন্ত পরিশ্রম করে ছবিটা করেছি। আশা রাখি দর্শকদেরও ভাল লাগবে।” ইন্দ্রনীল নিজে জানিয়েছেন, “ছবিতে অনেকগুলি চরিত্র। তাদের রোজকার জীবন, ক্রাইসিস সবই ভীষণ চেনা যেগুলি অতিক্রমের চেষ্টা করি আমরা সবাই। তাই দর্শক নিজের জীবনের সঙ্গেও মিল পাবেন।” ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর করেছেন প্রবুদ্ধ ব্যানার্জি। সিনেমাটোগ্রাফার ইন্দ্রনীল মুখার্জি, এডিটর সুমিত ঘোষ। আজ দুই বাংলায় একসঙ্গে ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে।

Latest article