মোদিকে বিশ্বাস করাটাই দায় হয়ে উঠেছে। কোনও কথাই ওঁর বিশ্বাস যোগ্য নয়। বিশ্বাস করেছ কি ঠকেছ। এটাই মোদির গ্যারান্টি (Modi’s Lies)।
আর সব না হয় বাদই দেওয়া গেল। বিজ্ঞাপনে নিজেদের বিপণন করতে বসেও মোদিবাদী বিজেপিওলারা বেমালুম মিথ্যে বলছেন।
বঙ্গ বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে সেবার ‘অব কী বার ২০০ পার’-এর ডাক দিয়েছিলেন বিজেপির দুই ‘পোস্টার বয়’ নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। ২১’এর ভোটে বঙ্গবাসীকে বিস্তর স্বপ্ন দেখিয়ে মোদির ‘গুণকীর্তন’ সম্বলিত ঢালাও প্রচার করেছিল গেরুয়া শিবির। সেরকমই এক বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পে ঘর পাওয়া মানুষের প্রতীক হিসেবে কলকাতার এক সাফাইকর্মী মহিলার ছবি ব্যবহার করেছিল পদ্মপার্টি। পিছনে ‘ফটোশপে’ বসানো বাড়ি। সঙ্গে গেরুয়া পার্টির ট্যাগ লাইন ছিল—‘আত্মনির্ভর ভারত, আত্মনির্ভর বাংলা, আমি পেয়েছি নিজের ঘর’। ওই মহিলার মতোই বাংলার আরও ২৪ লক্ষ মানুষ মাথায় ছাদ পেয়েছেন বলেও প্রচার করা হয়। আসলে সবটাই মিহি নয়, একেবারে মোটা দাগের মিথ্যা।
এবার লোকসভা ভোট। ‘অব কী বার ৪০০ পার’— জোরকদমে প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি। কিন্তু মধ্য কলকাতার সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে যোগাযোগ ভবনের কাছে মলঙ্গা লেনের সেই সাফাইকর্মী লক্ষ্মীদেবী এখনও ৫০০ টাকা ভাড়ায় বস্তির একচিলতে ঘরেই রয়েছেন। পুত্র, পুত্রবধূ আর নাতি-নাতনি নিয়ে কষ্টে দিনযাপন। জায়গার অভাবে ফুটপাতেও শুতে হয়, নিজেই জানাচ্ছেন লক্ষ্মী। অথচ প্রকল্প বাবদ বাংলার প্রাপ্য সমস্ত অর্থ বন্ধ রেখে, তিন বছর পরে ফের প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় পাকা বাড়ির স্বপ্ন বিলি করার ‘জুমলা’ নতুন মোড়কে শুরু। বিজ্ঞাপনে এবার অন্য মহিলার ছবি। পাল্টে গিয়েছে ট্যাগ লাইনও। এবার তা মোদির গ্যারান্টি হয়েছে। শীর্ষক হয়েছে, ‘মধ্যবিত্তের সেবা, মধ্যবিত্তের নিজের বাড়ির স্বপ্ন হবে সত্যি।’
লক্ষ্মীদেবীর একটি ভিডিও সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। লিখেছেন— ‘দু’মিনিট খরচ করে মজা নিন। মোদির গ্যারান্টিটা দেখুন।’ একেবারে সত্যি কথা। মোদির মিথ্যাচারের গ্যারান্টির মজাই বটে! গরিবের স্বপ্ন নিয়ে ভয়ানক রকমের ঠাট্টা।
এবারই প্রথম হল এমনটা, তেমন নয়। এর আগেও বিজ্ঞাপনে নরেন্দ্র মোদির মিথ্যাচার দেখেছি আমরা। সিঙ্গাপুরের মেট্রোরেল দেখিয়ে নিজের সাফল্যের দাবি করেছিল বিজেপি। গত বিধানসভা ভোটের প্রচারপর্বে কলকাতার মেট্রো নেটওয়ার্কের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর একক কৃতিত্ব তুলে ধরতে গিয়ে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিল তারা। সেবার সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদেশি মেট্রোর ঝাঁ চকচকে ছবির পাশে মোদিকে রেখে তারা প্রচার করে। তাতে ভোট মরশুমে হাসির খোরাক হতে হয় পদ্মপার্টিকে। সেবার রাজ্যের ক্ষমতা দখলের খোয়াবও মুখ থুবড়ে পড়ে। তা থেকে যে শিক্ষা নেয়নি গেরুয়া শিবির, সেটা ভালমতোই বোঝা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি ৩ দেশের
এবারের লোকসভা ভোট চলাকালীন আবার তেমন একটি বিজ্ঞাপন সামনে এসেছে। কর্মসংস্থান বেকারত্বের ইস্যুতে তামাম বিরোধী দলের তোপের মুখে মোদি সরকার। স্যোশাল মিডিয়ায় তার পাল্টা জবাব দিতে বঙ্গ বিজেপির অফিসিয়াল এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে একটি বিজ্ঞাপন পোস্ট করা হয়। ‘কর্মসংস্থান না বাড়লে কীভাবে ভারতের শহরে শহরে পৌঁছে গেল মেট্রো পরিষেবা?’
এই বিজ্ঞাপনেও প্রধানমন্ত্রীর পিছনে দেখা যাচ্ছে একটি মেট্রো রেক ও একঝাঁক লাইনের ছবি। বাস্তবে সেটি সিঙ্গাপুরের জুরং ইস্ট মেট্রো স্টেশনের ছবি। ২০২০ সালের নভেম্বরে সেটি প্রকাশ করেছিলেন ফোটোগ্রাফার শন অ্যাং। তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ সাকেত গোখলে এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করেন, ‘বঙ্গ বিজেপি মেট্রো রেলের ছবির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছবি শেয়ার করেছে। তাদের দাবি, অসংখ্য মেট্রো লাইন তৈরি করেছেন মোদি। যদিও এটি সিঙ্গাপুর মেট্রোর ছবি। এখন সিঙ্গাপুর যদি ‘বিশ্বগুরু মোদি’র নেতৃত্বে অখণ্ড ভারতের অংশ না হয়ে থাকে, তাহলে এটা বিজেপির আরও এক মিথ্যা প্রচারের নিদর্শন। গত ১০ বছরে দেখানোর মতো কোনও কাজ করেননি মোদি। তাই তাঁকে মিথ্যাচার (Modi’s Lies), বিদ্বেষ ভাষণ, ভুয়ো প্রচারের আশ্রয় নিতে হচ্ছে।’
২০২১-এর সেপ্টেম্বরে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের পাতাজোড়া সাফল্যের বিজ্ঞাপনে জায়গা করে নিয়েছিল কলকাতার ‘মা ফ্লাইওভার’। ‘বিজেপি জালি পার্টি’ বলেই এমন কাণ্ড ঘটে চলে, ঘটেই চলে।
আর নির্বাচন কমিশনকেও বলিহারি! নির্বাচন কমিশন যে বিজেপির মদতপুষ্ট সেটা জানতে আর কারও বাকি নেই। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী সংসদে গায়ের জোরে বিল পাশ করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে অমিত শাহকে বসিয়ে নির্বাচন কমিশনারকে মনোনয়ন দিয়েছেন। এই অবস্থায় তারা যে বিজেপির শাখা সংগঠনে পরিণত হবে এটাই স্বাভাবিক। প্রথমে নীরব দর্শক সেজে বসে থাকেন। পরে যখন পদক্ষেপ নেয় ততদিনে যা ক্ষতি করার করে ফেলেছে। নিয়মভঙ্গ করার পর তার থেকে যে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার তা তারা তুলে নেয় তারপরে তাদের শো-কজ করা হয়। এই কাণ্ডটাই ঘটল বিজ্ঞাপনী মিথ্যাচারে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে শো-কজ করে নির্বাচন কমিশন। সেখানে এই বিজ্ঞাপনের জন্য বিজেপি রাজ্য সভাপতিকে কারণ দর্শানোর কথা বলা হয়েছে। গত ৪ এবং ৫ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মেট্রো রেলের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় আর ১৯ মে অবলাকান্তকে শো কজ করেছে কমিশন।
তথ্য তেমন বিশেষজ্ঞের হাতে পড়লে বিদ্বেষের অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। এই কাজ করে দেখিয়েছেন শমিকা রবি। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পারিষদ। লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন রাশিবিজ্ঞানের নিয়মের অবিশ্বাস্য অপপ্রয়োগ করে তিনি এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, যার মূল প্রতিপাদ্য হল, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভারতের জনসংখ্যায় হিন্দুদের অনুপাত যে হারে কমেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে মুসলমানদের অনুপাত। আর ওদিকে ভোগব্যয় সংক্রান্ত জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য সম্পূর্ণ চেপে যাওয়া হল, এবং লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে প্রকাশ করা হল ভোগব্যয় সংক্রান্ত এক বিচিত্র পরিসংখ্যান, যাতে দারিদ্র্য মাপার মাপকাঠিই গুলিয়ে গেল।
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া ভারতের পরিসংখ্যান পরিকাঠামো গোটা দুনিয়ায় দৃষ্টান্তস্বরূপ ছিল। সেই পরিকাঠামো ভারতীয় অর্থব্যবস্থার উন্নতিতে প্রশ্নাতীত ভূমিকা পালন করেছে। পরিসংখ্যানকে রাজনীতির বিষয়বস্তু বানানোর উদগ্র তাগিদে বর্তমান সরকার সেই গৌরবকে যমুনার কালো জলে বিসর্জন দিয়েছে।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের মোদি?