স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা। কথাগুলো উচ্চারণ করামাত্র সচরাচর যে মুখগুলো মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে তাঁরা প্রত্যেকে বিদেশিনি। সেই তালিকায় ভগিনী নিবেদিতা তো আছেনই, রয়েছেন মেরি লুই (স্বামী অভয়ানন্দ), মিস এস ই ওয়াল্ডো (ভগিনী হরিদাসী), মিসেস ওলি বুল (ধীরামাতা) মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড (জয়ামাতা), সিস্টার ক্রিস্টিন, মিস হেনরিয়েটা মুলার, মিসেস ফাঙ্কি প্রমুখ।
কিন্তু এঁরা সবাই বিদেশিনি। শ্বেতাঙ্গ। ইউরোপীয় বা আমেরিকান। পাশ্চাত্যে স্বামী বিবেকানন্দের সান্নিধ্যে এসে তাঁরা ওঁর অনুগামিনী হয়েছিলেন।
ইতিহাস বলছে, এই বৃত্তের বাইরে ছিলেন আরও দু’জন। তাঁরা সর্বতোভাবে ভারতীয়। স্বামী জীবানন্দ ও কালীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘স্বামীজির সন্নিধানে’ আগত সমকালীন ব্যক্তিত্বদের সংক্ষিপ্ত জীবনী সংকলন প্রকাশ করেছিল উদ্বোধন বছর দশেক আগে। সেই গ্রন্থে স্পষ্ট লেখা আছে, ‘স্বামীজির ভারতে দীক্ষিতা শিষ্যা মাত্র দুইজনেরই নাম পাওয়া যায়। একজন মৃণালিনী দেবী এবং দ্বিতীয়া হরিপদ মিত্র মহাশয়ের সহধর্মিণী ইন্দুমতী মিত্র (Mrinalini Devi- Indumati Mitra)।’
সন ১৮৯২। ১৮ অক্টোবর। মঙ্গলবার। হরিপদ মিত্র তখন বেলগাঁও সাবডিভিশনের ফরেস্ট অফিসার। এক আইনজীবীর সঙ্গে হরিপদর বাড়িতে এলেন বিবেকানন্দ। আইনজীবীর নাম শ্রীভাটে। তিনি হরিপদর বন্ধু।
হরিপদ নাস্তিক মানুষ। দেব-দ্বিজে ভক্তির কোনও বালাই নেই। ভিখারিকে ভিক্ষে দেওয়ার ঘোর বিরোধী। সাধুমাত্রই ঠগ, জোচ্চর, এ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।
প্রথমে হরিপদ ভেবেছিলেন, স্বামীজি ওই শ্রীভাটের বাড়িতে থাকতে গিয়ে অসুবিধায় পড়েছেন। বাঙালি সাধু। মারাঠার বাড়িতে থাকা-খাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে। তাই বুঝি হরিপদর বাড়িতে থাকার আর্জি নিয়ে এসে হাজির হয়েছেন।
কিন্তু খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর সে ভুল ভাঙল। হরিপদ টের পেলেন এই বাঙালি সাধু যথেষ্ট বিজ্ঞ, যথেষ্ট জ্ঞানী এবং পরম নির্লোভ। যেমনটা তিনি ভেবেছিলেন তেমনটা মোটেই নন। গেরুয়া পরেন বটে, কিন্তু সন্ন্যাসীর চেনা পোশাক সেটা নয়। ইংরেজিতে স্বছন্দে কথাবার্তা বলেন। নানা বিষয়ে বিদ্বান। হরিপদ অবাক।
হরিপদ যেচে পড়ে সাধুকে তাঁর বাড়িতে থাকার জন্য বললেন। সন্ন্যাসী উল্টে তাঁকে বললেন, ভাটে সাহেব মারাঠি বলে তাঁর তো কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। এখন বিনা কারণে যদি তিনি হরিপদর আতিথ্য নেন, তবে ভাটে সাহেব দুঃখ পাবেন। হরিপদ সন্ন্যাসীর বিচারবিবেচনা মূল্যবোধ দেখে অবাক।
বিবেকানন্দ তাঁর বাড়িতে থাকতে রাজি নন। সে কথা বুঝে গিয়ে হরিপদ বিবেকানন্দকে পরদিন প্রাতরাশের সময় তাঁর বাড়িতে আসার জন্য বললেন। বিবেকানন্দ রাজিও হলেন। কিন্তু প্রাতরাশের সময় তাঁকে দেখা গেল না। হরিপদ ছুটলেন শ্রীভাটের বাড়িতে।
সেখানে পৌঁছে, সেখানকার দৃশ্য দেখে তিনি হতবাক। স্বামীজিকে ঘিরে বেলগাঁও শহরের গণ্যমান্য লোকদের ভিড়। নানা লোকের নানা জিজ্ঞাসা। বিবেকানন্দ সবার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। বেলগাঁওতে সে-সময় একজন এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার থাকতেন। তিনি শাস্ত্রজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি বিবেকানন্দের সঙ্গে তর্কে মেতে উঠেছেন।
হরিপদ শ্রীভাটেকে অনেক বলেকয়ে সেদিন বিবেকানন্দকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন।
প্রথমে ঠিক ছিল দিন চারেক থাকবেন। হরিপদর পরিবারের সঙ্গে এমন সখ্য তৈরি হল যে একটানা ৯ দিন সেখানে থেকে গেলেন বিবেকানন্দ। হরিপদর স্ত্রী ইন্দুমতীর (Mrinalini Devi- Indumati Mitra) সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়।
বদলে গেল স্বামী-স্ত্রীর জীবন, তাঁদের জীবনদর্শন। আগে ভিখারিকে ভিক্ষে দিতেন না হরিপদ। স্বামীর মত মেনে নেন ইন্দুমতীও। বিবেকানন্দ বললেন, ‘যাদের দেওয়ার সামর্থ্য আছে, তাদের তো ভিখারিকে কিছু দেওয়া উচিত। ওই পয়সায় ভিখারি কী করে, সেটা তাদের দেখার দরকার নেই। চুরি করার চেয়ে তো ভিক্ষে দিয়ে চুরির পথ বন্ধ করা ভাল।’
আমেরিকা যাওয়ার পাথেয় সংগ্রহ করার জন্য চাঁদা তোলার উদ্যোগ নেন হরিপদ। বিবেকানন্দ বারণ করেন।
আমেরিকা যাওয়ার জন্য বোম্বেতে পৌঁছলেন বিবেকানন্দ। সেখান থেকে চিঠি লিখলেন ইন্দুমতীকে (Mrinalini Devi- Indumati Mitra)। ২৪ মে, ১৮৯৩-তে। তাতে লেখা, ‘পত্র লিখিতে পারি নাই বলিয়া দুঃখিত হইও না। সর্বদা শ্রীহরির নিকট তোমাদের কল্যাণ প্রার্থনা করিতেছি।’ সঙ্গে প্রতিশ্রুতি, ‘আমেরিকা ও ইউরোপ পরিভ্রমণ করিয়া আসিয়া প্রভুর ইচ্ছায় পুনরায় তোমাদের দর্শন করিব।’ সেই সঙ্গে নির্দেশ, ‘সর্বদা শ্রীকৃষ্ণে আত্মসমর্পণ করিবে। …সর্বদা পবিত্র থাকিবে।… সদা যথাসাধ্য পরোপকার করিতে চেষ্টা করিবে।’
ওই চিঠিতেই দেখতে পাচ্ছি স্বামীজি ইন্দুমতীকে (Mrinalini Devi- Indumati Mitra) রোজ ‘যথাশক্তি গীতাপাঠ’ করতে বলছেন। একসময় ইন্দুমতীর স্বামী হরিপদ গীতা পড়ে মানে বুঝতে না-পেরে গীতাপাঠ ছেড়ে দিয়েছিলেন। ধরেই নিয়ে ছিলেন, বাস্তব জীবনে গীতার কথাগুলোর কোনও উপযোগিতা নেই। স্বামীজির কাছে গীতার ব্যাখ্যা শুনে সেই ধারণার অবসান ঘটে। তখন থেকে হরিপদ ফের গীতাপাঠ শুরু করেন। ইন্দুমতীও সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। শুধু গীতা নয়, টমাস কার্লাইলের লেখার ব্যাখ্যা, জুলে ভার্নের উপন্যাস, সে-সবও হরিপদর সঙ্গে সঙ্গে ইন্দুমতী স্বামীজির কাছ থেকেই শুনেছিলেন, বুঝেছিলেন, আত্মস্থ করেছিলেন।
ইন্দুমতী চিঠি লিখেছিলেন বিবেকানন্দকে। তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন ‘ইন্দুমতী দাসী’ হিসেবে। বিবেকানন্দ লিখে পাঠালেন, “দাসী’ কেন লিখিয়াছ?… জাতি ইত্যাদি আধুনিক ব্রাহ্মণ-মহাত্মারা করিয়াছেন। কে কাহার দাস? সকলেই হরির দাস।” সুতরাং, ইন্দুমতীকে ‘ইন্দুমতী দাসী’ নয়, ‘প্রাচীন বৈদিক প্রথা’ অনুসারে ‘ইন্দুমতী মিত্র’ লেখার পরামর্শ দিলেন।
চার বছর পর ১৮৯৭-এর ১৫ নভেম্বর লাহোর থেকে ইন্দুমতীকে চিঠি লিখেছিলেন বিবেকানন্দ। সেখানে ছত্রে ছত্রে পরিস্ফুট বিবেকানন্দের মঠ স্থাপনের সংকল্প, তার জন্য হার-না-মানা জেদ। অসুস্থ বিবেকানন্দ তখন জীবনের ওপর ভরসা হারাতে শুরু করেছেন। ওদিকে মঠ তৈরির জন্য অর্থের সংস্থান কিছুতেই হচ্ছে না। বিবেকানন্দ লিখছেন, “আমার অসুখ হওয়ার জন্য জীবনের উপর ভরসা নাই।
এক্ষণেও আমার উদ্দেশ্য যে কলকাতায় একটি মঠ হয়, তাহার কিছুই করিতে পারিলাম না। অপিচ দেশের লোক বরং পূর্বে আমাদের মঠে যে সাহায্য করিত, তাহাও বন্ধ করিয়াছে। তাহাদের ধারণা যে, আমি ইংল্যান্ড হইতে অনেক অর্থ আনিয়াছি!!”
এসবের মধ্যেই গুঁজে দিয়েছেন আর একটা খবর। হতাশাজনক, দুঃখব্যঞ্জক সংবাদ। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বিবেকানন্দের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ঘোষণা করেছেন রানি রাসমণির বংশধররা। কারণ, বিবেকানন্দ কালাপানি পার হয়ে বিলাত-আমেরিকায় গেছেন। আর তাঁর সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে তথায় ‘মহোৎসব হওয়া পর্যন্ত অসম্ভব’। ‘মহোৎসব’ মানে শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথিকে ঘিরে তাঁর শিষ্য ও ভক্তবৃন্দের উৎসব।
এর ৯ দিন পর, দেরাদুন থেকে লেখা আর একটি চিঠিতেও হতাশা এবং সম্ভাবনায় বুক বাঁধা, দুই-ই আছে। লিখছেন, ‘এক্ষণে দেরাদুনে যে কার্যে আসিয়াছিলাম, তাহাও নিষ্ফল হইল’। সবকিছুই ‘প্রভুর ইচ্ছা’ বলে মেনে নিয়েছেন। জানিয়েছেন, দেরাদুন ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে প্লেগের প্রাদুর্ভাব হওয়ায় ‘অনেক হাঙ্গামা করিতেছে’ এবং তার জন্য তাঁকে ‘অনেকটা ব্যাঘাত সহ্য করিতে হইতেছে এবং হইবে’। কখন কোথায় যাবেন, কবে কোথায় থাকবেন, ঠিক নেই। তাই বলেছেন, মঠের ঠিকানায় চিঠি লিখতে। তাহলে যখন যেখানেই থাকুন না কেন, চিঠি ঠিক পেয়ে যাবেন।
২৪ নভেম্বর, ১৮৯৭-এ বিবেকানন্দর মনে হয়েছে, ‘শরীর এক্ষণে ভাল আছে’। আর তখনও তাঁর স্থির বিশ্বাস, ‘কষ্ট করিলে তার সুফল আছে নিশ্চিত’।
এর পাঁচ বছর পর ১৯০২-এর ৪ জুলাই, মহাপ্রয়াণ।
মহাপ্রয়াণের কয়েক সপ্তাহ আগে বিবেকানন্দ বেরিয়েছিলেন তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনের শেষ ছুটিতে, তাঁর মৃণালিনী মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।
মৃণালিনী মা মানে মৃণালিনী বসু। বিবেকানন্দর আর এক ভারতীয় শিষ্যা।
স্বামী ব্রহ্মানন্দ অর্থাৎ রাখাল মহারাজের ডায়েরি জানাচ্ছে, স্বামীজি মৃণালিনীর সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রথমে ৩৪ মাইল ট্রেনে চেপে কাঁচরাপাড়ায় যান, তারপর ৭ মাইল গরুর গাড়িতে নদিয়া জেলার বড় জাগুলিয়ায়। সেখানেই থাকতেন মৃণালিনী।
সেখান থেকে ফিরে এসে নিজের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত বিবেকানন্দ। নিজেই লিখছেন, “আমি এখন আগের তুলনায় অনেক শক্তিমান। সাত মাইল গরুর গাড়িতে নড়বড়ে রাস্তায় যাত্রা এবং সেই সঙ্গে ট্রেনে ৩৪ মাইল যাত্রার পরেও আমার পা ফুলল না, ড্রপসি ফিরে এল না। আমার নির্ঘাত বিশ্বাস, ওই রোগ আর ফিরছে না।” তার সঙ্গে বড় জাগুলিয়ার সপ্রশংস উল্লেখ, “এই মুহূর্তে সবই আমার শ্রেষ্ঠ স্থান”। মহাপ্রয়াণের বিশ দিন আগে এসব লিখে গিয়েছেন মৃত্যুপথযাত্রী এক সিংহপ্রতিম যুগনায়ক।
বড় জাগুলিয়ার দিঘা গ্রামে বাস ছিল সর্বেশ্বর সিংহের। তাঁরই কন্যা মৃণালিনী। বিয়ে হয়েছিল বেণীমাধব বসুর সঙ্গে। বেণীমাধব সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ছাড়েন। স্বামী ঘর ছাড়ায় মৃণালিনী স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়িতে চলে আসেন। সেখানেই ৬ জুন, ১৯০২ থেকে ১২ জুন, ১৯০২, কাটিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। সঙ্গে ছিলেন স্বামী নির্ভয়ানন্দ ওরফে কানাই মহারাজ এবং বিবেকানন্দের ভাগনে নাদু।
মৃণালিনী তাঁর মন্ত্রশিষ্যা শুধু নন, দূর সম্পর্কের বোনও বটে। জাগুলিয়া থেকে বেলুড়ে ফেরত আসার সময় মৃণালিনী বিবেকানন্দকে এক ঝুড়ি কালো জাম দেন। বিবেকানন্দর ডায়াবেটিস ছিল আর কালোজাম ডায়াবেটিসের ভাল দাওয়াই, এজন্য দাদা-কাম-গুরুকে ভগিনী-কাম-শিষ্যার আন্তরিক উপহার। ঘটনাচক্রে সেটাই বিবেকানন্দকে মৃণালিনীর অন্তিম উপহার। সেই জাম বেলুড়ে নিয়ে এসে প্রবল উৎসাহে ফারমেন্ট করে সিরকা বানিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। আর এসব কিছুই মহাপ্রয়াণের কয়েকদিন আগে।
এই মৃণালিনীর একমাত্র ছেলে বিষাদ বসু। তাঁর ছেলে অশোক বসু। প্রকাশ রায় ছদ্মনামে অশোক তেভাগা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করেন। পুলিশ তাঁর মাথার দামও ঘোষণা করেছিল।
এই মৃণালিনী দেবীকেই দেওঘরের বৈদ্যনাথ থেকে একটা চিঠি লেখেন স্বামীজি। সেই চিঠিতেই তাঁর সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ, সামাজিক নিয়মগুলো কস্মিনকালেও ঋষি, মুনি, দেবতাদের করা নয়। দরকার মতো, সমাজরক্ষার প্রয়োজনে মানুষ এগুলো তৈরি করে। “সমাজের পশ্চাতে যখন তাৎকালিক আবশ্যকতার বেগ লাগে, তখন আত্মরক্ষার জন্য আপনা-আপনি কতকগুলি আচারের আশ্রয় লয়। ঋষিরা ওই সকল আচার লিপিবদ্ধ করিয়াছেন মাত্র।”
তার চেয়েও বড় কথা, ঋষি-মুনিদের লেখা ওইসব বিধি যখন লেখা হচ্ছে তখন সেগুলো কাজে দিলেও পরবর্তীকালে ‘অতি অহিতকর’ হিসেবে দেখা দিতে পারে। ‘সমাজও অনেক সময় সেই সময়ের জন্য রক্ষা পান, কিন্তু যে উপায়ে বাঁচেন, তাহা পরিণামে ভয়ঙ্কর হয়’। বিবেকানন্দর অকপট গোঁড়ামিরহিত বিশ্লেষণ।
বিধবা বোনকে সন্ন্যাসী-দাদা স্পষ্ট জানাচ্ছেন, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে বিধবার বিয়ে না-দেওয়ার যে গোঁড়ামি, সেটা একদা সময়ের দাবি মেনে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে সেটার দরকার ফুরিয়েছে। যে সময় ওই বিধি চালু করা হয়, সে সময়, বিবেকানন্দ মনে করছেন, সম্ভবত, পুরুষের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি ছিল। সেজন্য বিধবারও বিয়ে হলে কুমারীরা সবাই পতিলাভ করতে পারত না। এজন্যই বিধবার বিয়েতে আপত্তি জানিয়েছিল প্রাচীন হিন্দু সমাজ। বিবেকানন্দের মনে হয়েছে, এজন্যই, অর্থাৎ বিধবা বিবাহে কোনও বাধা নিষেধ না থাকার জন্যই, ‘পাশ্চাত্য দেশে… কুমারীদের পতি পাওয়া বড়ই সংকট হইতেছে’।
আরও পড়ুন-দূরদর্শী মহাশ্বেতা
সুতরাং বিধবা বিবাহে বাধাদান যেমন ‘দুষ্ট পুরুষের’ অপকীর্তি নয়, সমসাময়িক সামাজিক প্রয়োজনে সেটার প্রচলন, ‘সমাজের সাময়িক আবশ্যকতার সহায়-অবলম্বন ব্যতিরেকে’ এই বিধি ‘সফলকাম’ হতে পারত না, এটা যেমন ঠিক, তেমনই এটাও ঠিক যে এ ধরনের সামাজিক রেওয়াজ ঋষি, মুনি, দেবতাদের তৈরি বলে সর্বকালে সর্বথা অলঙ্ঘনীয়, অপরিবর্তনীয়, তেমনটাও নয়। সমাজ সংস্কারের ব্যাপারে তাই বিবেকানন্দের একেবারে যুক্তিবাদী ‘Rational’ চিন্তা। ‘‘কোনও ‘আচারের মূলে কী আবশ্যকতা আছে, সেইটি প্রথমে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে এবং সেইটি পরিবর্তন করিয়া দিলেই উক্ত আচারটি আপনা হইতে নষ্ট হইয়া যাইবে।” এই যুক্তি মেনে নিলে, বিধবা বিবাহকে সমাজে সার্থক স্বীকৃতিদানের জন্য প্রথমে দরকার পুরুষ ও নারীর সংখ্যায় অনুপাতে ভারসাম্য আনয়ন। ‘তদ্ভিন্ন নিন্দা বা স্তুতির দ্বারা কাজ হইবে না’, বিবেকানন্দের অনন্য পর্যবেক্ষণ।
শিষ্যা এবং রক্তের সম্পর্কে বোনকে তাঁর সন্ন্যাসী দাদা আমেরিকা ইউরোপ ঘুরে আসার পর নির্দ্বিধচিত্তে জানাচ্ছেন, ‘মুষ্টিমেয় ধনীদের বিলাসের জন্য লক্ষ লক্ষ নরনারী অজ্ঞতার অন্ধকারে ও অভাবের নরকে ডুবিয়া থাকুক, তাহাদের ধন হইলে বা তাহারা বিদ্যা শিখিলে সমাজ উচ্ছৃঙ্খল হইবে’ এমন ভাবনাচিন্তার গোড়ায় গলদ রয়েছে। তাঁর সুস্পষ্ট জিজ্ঞাসা, ‘সমাজ কে? লক্ষ লক্ষ তাহারা? না, এই তুমি আমি দশ জন বড় জাত!!!’
এবং সেই শিষ্যাকেই তিনি সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ‘মনুষ্যে ঈশ্বর-আরোপ বড়ই মুশকিল, কিন্তু চেষ্টা করিতে করিতে নিশ্চয়ই সফল হওয়া যায়’। এমন ইতিবাচক সম্ভাবনার পেছনে রয়েছে একটি প্রত্যয়পূর্ণ বিশ্বাস, ‘প্রতি মনুষ্যে তিনি আছেন, সে জানুক বা না জানুক; তোমার ভক্তিতে সেই ঈশ্বরত্ব-উদয় তাহার মধ্যে হইবেই হইবে’।
নিজের জীবনেও কি এই তত্ত্ব প্রয়োগ করেছিলেন বিবেকানন্দ? তার সাফল্যেই কি বিকচিত হয়েছিলেন অবতার বরিষ্ঠ?
এসব অর্বাচীন জিজ্ঞাসার উত্তর মেলে না।
মৃণালিনীদের বাড়িতে থাকার সময় সর্বেশ্বর সিংহের বাড়িসংলগ্ন বড় পুকুরটায় স্থানীয় ছেলেপুলেদের নিয়ে সাঁতার প্রতিযোগিতার আসর বসিয়েছিলেন বিবেকানন্দ।
উল্লিখিত প্রশ্নগুলোও যেন সেটার প্রতিযোগীদের মতো মহাকালের পুকুরে এখনও সাঁতরে চলেছে।
বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের ঘাট খুঁজে পাচ্ছে না।