রতনতনু ঘাটী: কখন থেকে ঘরবার করছিল বীণা। ওদের বাড়ি থেকে বেরোলে সোজা দক্ষিণ দিকে হাঁটলে পড়ে যে কুশি নদীটা, তার সঙ্গে মাঝে-মাঝে বীণা নিজের তুলনা করে। তখনই তার মনে হয়, সে ভাল নেই! তার মতো অত জ্বালা-যন্ত্রণার জীবন কুশির নয়!
বিয়ের পরপরই বীণা ভেবেছিল, সে একদিন নদী দেখতে যাবে। প্রথমদিকে তার খুব সাগর দেখার ইচ্ছে হত। একদিন বিজয়কে বীণা বলল, ‘হ্যাঁ গো, তুমি আমাকে একদিন সাগর দেখাতে নিয়ে যাবে? আমি কখনও সাগর দেখিনি!’
বীণার কথার কোনও উত্তর দিল না বিজয়। বীণা ভাবল, লোকটা তো কোনও কথাই তো বলল না!
তারপর একদিন বিজয় সকাল-সকাল বাড়ি থেকে কাঁধে একটা কাপড়ের ময়লা লম্বা ঝোলা ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল। নগেন মাইতিদের কাসুন্দে গাছের ঝোপটায় বিজয় আড়াল হয়ে যেতে, বীণা ভাবল, দুর! গরিব ঘরের মেয়ের কপালে কি আর সাগর-দেখা লেখা থাকে? মনে হয় নদী-দেখার কথাও লেখা থাকে না। হয়তো বিজয় তাই কোনও কথাই বলল না। কত বড়লোকের বাড়ির মেয়েরাই কখনও সাগর দেখেনি!
এখন গ্রামে পাইপ কল বসেছে। লোকে বলে ‘টাইম কল’। কাল টাইম কলে জল ধরতে গিয়ে বীণা সরখেলদের বড়বউকে জিজ্ঞেস করল, ‘ও মেনকাদিদি, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
পিতলের কলসিটায় হাত ঢুকিয়ে জল ধরে ভাল করে পরিষ্কার করতে-করতে মুখ তুলল মেনকা, ‘বল না কী বলবি? কথা বলতে কি আর পয়সা লাগে?’
বীণা বলল, ‘তোমরা তো বড়লোক! তোমাদের দাদা পঞ্চায়েত অফিসে কাজ করে। আচ্ছা, তুমি কখনও সাগর দেখেছ?’
কলের নিচে কলসিটা বসিয়ে এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল মেনকা। কোমরের শাড়িটি পেঁচিয়ে গুঁজে নিয়ে কপাল কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করল খানিক। তারপর বলল, ‘না রে! তোর দাদার সঙ্গে বিয়ের পর থেকে একদিন শুধু গঙ্গাতলার বাজারে সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেছল। এখন তো টিভিতে কেবল লাইনে সিনেমা দেখতে পাই।’
বীণা ফের সাগরের প্রসঙ্গ তুলল, ‘না, আমি বলছিলাম কী, তুমি কখনও সাগর দেখোনি?’
মেনকার কলসি জল ভরে টইটই। কলসিটা সরিয়ে কাঁখে তুলতে গিয়ে বলল, ‘না রে। সাগর মানে তো দিঘা? সে আমার দেখা হয়নি রে!’
মেনকা চলে যাচ্ছিল। গলা তুলে বীণা বলল, ‘দিদি, নদী? কখনও নদী দেখোনি?’
মেনকা সামনে এগিয়ে যেতে-যেতে ডান হাতটা পিছনে নেড়ে নিষেধের ভঙ্গিতে বলল, ‘না রে!’
এবার নিজের মনকে প্রবোধ দিল বীণা, ‘মেনকাদিদিই যখন সাগর দেখেনি, এমনকী, নদীও দেখেনি, তা হলে আমার কপালে সাগর দেখা হবে কী করে?’
তারপর একদিন বিজয় সত্যি-সত্যি নদী দেখাতে নিয়ে গেল। প্রথমে বীণা বুঝতে পারেনি, বিজয়ের মনে অন্য মতলব আছে। নদীর একদম ধারে ঘাসের উপর বসে ভীষণ খুশি হয়ে যেন হাওয়ায় ভাসছিল বীণা। দূরে একটা নৌকা ভেসে যাচ্ছিল। সেদিকে আঙুল তুলে বীণা বলল, ‘আমাকে একদিন নৌকায় চড়াবে গো? আমার খুব নৌকায় চড়তে ইচ্ছে করে!’
একটু পরে বীণা বুঝল, বিজয় মন দিয়ে ওর কথা শুনছে না। ফের বলল, ‘কী গো, কথা বলছ না যে?’
বিজয় খিঁকুটে গলায় বলে উঠল, ‘‘কী বলব? আজ চারমাস একটা মালও সাপ্লাই দিতে পারিনি! কাল তেন্ডাই-মেন্ডাই করছিল ফোনে শশধর বংশী— ‘তুই আজ কতদিন একটা মালও দিসনি মনে করে দ্যাখ বিজয়!’
শশধর বংশী শহরে থাকে। এক সপ্তাহ অন্তর বিজয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে দু-তিনটে ঝাঁপি নিয়ে হরিণগড়ে। কাল এসেছিল শশধর। খালি ঝাঁপি তিনটে দড়ি দিয়ে বাঁধা, পিঠে ঝোলানো। তিনটে ঝাঁপি দোলাতে দোলাতে বলে গেছে, ‘বিজয়, না পারলে এ কাজ ছেড়ে দে। যে কাজ পারবি না, সে কাজ ধরে রাখিস কেন? আমি দেখেছি, বিয়ে করার পর-পরই ব্যবসা লাটে তুলে দিলি? তোর এখন চলে কী করে?’
বিজয় শশধরের কথা মনে করে এখন নিজের মনেই গজগজ করল, ‘চলে না গো শশধরদা। চলে না!’
হঠাৎ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল বিজয়। তারপর হনহন করে ঝোপজঙ্গলে ভরা নদীর পাড় ধরে হেঁটে যেতে-যেতে পিছনে তাকিয়ে বলে গেল, ‘নতুন বউ, তুই এখানে বসে থাক। আমার ফিরতে দেরি দেখলে সটান বাড়ি চলে যাস!’
বীণা আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
বিরক্ত গলায় বিজয় বলে গেল, ‘ভাতের জোগাড় করতে।’
পশ্চিম আকাশে সূর্য বিকেল গড়িয়ে দিল। ডানহাতি দেবদারু গাছের ছায়াটা দৈত্যের মতো লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে পাশের খাঁড়ি মতো জায়গাটায়। একটা ডিঙি বাঁধা হয়ে আছে সেখানে। লোকজন নেই ডিঙিটায়।
সন্ধের ঝুঁঝকো নামি-নামি করছিল। এবার বীণার কেমন গা-ছমছম করে উঠল। লোকটা গেল কোথায়? মনে-মনে ভাবল, কেউ নতুন বিয়ে-করা বউকে বসতে বলে এমন করে উধাও হয়ে যায়?
বাড়ির দিকে পা বাড়াল বীণা। নদী দেখা ঢের হয়েছে! ঘরে ফিরে কেরোসিন তেলের ল্যাম্প জ্বালল। কেরোসিন তেল পুড়লে বড় টিকটিক করে বিজয়, ‘জানিস, তেলের দর এখন কত? রেশনে আর তেল দিচ্ছে কই? রাঁধতে হলে চোখ-দেখা বেলা থাকতে রেঁধে নিস।’
নদীর ধার থেকে বাড়ি ফিরতেই তো আঁধার নেমে গেছে। আলু ভাতে দিয়ে যেটুকু চাল ছিল, ভাত চড়াল বীণা। উনুন থেকে ভাত নামানো হয়েছে সবে, হাতে-পায়ে কাদামাটি মেখে ফিরে এল বিজয়। কাপড়ের ব্যাগটার মুখ আলগা করে একটা বেতের ঝাঁপির ঢাকনা একটু ফাঁক করে একটা কিছু ঝাঁপিটার ভিতর ছেড়ে দিয়ে বিজয় হাঁফ ছেড়ে দাঁড়াল। বলল, ‘আজ একটা পেয়েছি।’
বীণা জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’
‘একটা বুড়ো কালনাগিনী! দ্যাখ, বিষে টিকটিক করছে চোয়ালের দু’পাশ।’
‘তুমি সাপ ধরো!’ অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল বীণা।
আরও পড়ুন-প্রতিবন্ধকতা পরাজিত যেখানে…
‘বিয়ের পর তোর সঙ্গে লটপটিয়ে কেটে গেল ক’মাস! জমানো টাকা শেষ। এবার না বেরোলে চলবে কেন?’ বলে রহস্যময় চোখে ওর দিকে তাকাল বিজয়।
‘জানি তুমি সাপ ধরো! তোমাকে না বলে একদিন আমি ঘরের কোণে রাখা বড় মাটির ফুটো করা কলসির মাটির ঢাকনা খুলে চাল আছে কি না হাত ঢুকিয়ে দেখতে গিয়ে দেখি কী, ওর ভিতরে একটা মস্ত বড় সাপ জটলা পাকিয়ে শুয়ে আছে? সেদিন তোমাকে কিছু বলিনি। ওটাকে বেচে দাওনি কেন?’
‘ও, তুই নয়নাকে বেচে দেওয়ার কথা বলছিস? ও কথা মুখেও আনিস না বীণা! নয়না আজ কতদিন আমার সঙ্গে আছে, জানিস? শশধর কাল বলল, কতদিন একটা মালও দিতে পারিসনি? বাড়ির বুড়োটাকে আমাকে বেচে দে! ওকে তো ব্যাঙ-ইঁদুর ধরে এনে খাওয়াতেও হয়?’
আমি শশধরকে বলেছি, ‘আমি না খেতে পেয়ে মরে গেলেও নয়নাকে বেচতে পারব না শশধরদা। ও আমার বউ!’
‘তা হলে ফট করে আর-একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেললি যে বড়?’
শশধরের কথায় গুম মেরে গেল বিজয়। কোনও উত্তরই দিল না।
কিন্তু ইদানীং বিজয় যে কাণ্ড করছে, বীণা অনেক ভেবে দেখেছে, এর পর আর বিজয়ের সঙ্গে থাকা যায় না! এইটুকু ঘরে রাতে দুটো বিছানা পাততে হয় বীণাকে। একটা বাঁশের খাটিয়ায়। আর-একটা মেঝেতে ছেঁড়া কাঁথা পেতে। বিজয়ই বলল কথাটা, ‘বীণা, এবার থেকে দুটো বিছানা পাতিস!’
‘কী হবে?’
‘তুই খাটিয়ায় শুবি। আমি আর নয়না মেঝেতে শোব। আমার সঙ্গে শোয়ার অনেকদিনের ওর অভ্যেস। ক’দিন ধরে দেখছি, নয়না রাতে খুব রেগে গিয়ে গরগর করে। ফোঁসফোঁস করে। ওকে কষ্ট দিতে পারব না রে।’
বীণা জিজ্ঞেস করল, ‘আর আমার কষ্ট হবে না বুঝি?’
হেসে উঠে বিজয় বলল, ‘তুই তো মানুষ! মানুষ কষ্ট পেলে দোষের কিছু নেই!’
তারপর দিন পনেরো কোথায় বনে-বাদাড়ে ঘুরে আরও দুটো খরিশ সাপ ধরে আনল বিজয়। রাতে আলাদা বিছানায় শুয়ে ডাক দিয়ে বিজয় বলল, ‘নতুন বউ, কাল সাপ তিনটে নিয়ে কলকাতা যাব বেচতে। ফেরার সময় তোর জন্যে একটা তাঁতের শাড়ি কিনে আনব!’
একটাও উত্তর দিল না বীণা। পাশ ফিরে শুয়ে থাকল। তারপর সেই বুড়ো কালনাগিনীকে নিয়ে সারারাত বিজয়ের সে কী আদরের ঘটা! ভোরবেলা উঠে বিজয় কলকাতার ট্রেন ধরতে বেরিয়ে পড়ল সাপের তিনটে ঝাঁপি নিয়ে। বলল, ‘আমার ফিরতে দিন পাঁচেক দেরি হবে। চিন্তা করিস না নতুন বউ! মনে করে নয়নাকে খেতে দিস!’
চোখের জল মুছে বীণা বলল, ‘এর পরের ট্রেন ক’টায় আসে জানো?’
‘দুপুরবেলা! দুটোয়!’ বলে বিজয় হাঁটতে লাগল স্টেশনের দিকে।
সারা সকাল দু’চোখ ভাসিয়ে কাঁদল বীণা। তারপর ভাবল, এ সংসারে সে থাকবে না! এ জীবন রেখে কী হবে? ঠিক করল রেললাইনে মাথা দেবে। কিন্তু ট্রেন আসতে অনেক দেরি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল মুখ নিচু করে। দুপুর রোদে ট্রেন আসা পর্যন্ত বসে রইল একটা খিরিশ গাছের ছায়ায়।
গলা শুকিয়ে কাঠ। বীণা শুনতে পেল, দূর থেকে ট্রেনের শব্দ ভেসে আসছে। সে নিজেকে শেষ করে দিতে মনে-মনে তৈরি হয়ে নিল। যখন ট্রেনটা ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে, তখন ঝপ করে মনে পড়ে গেল বীণার, এই যাঃ! বিজয় যে বলে গিয়েছে নয়নাকে মনে করে খেতে দিতে। ইস, নয়নাকে তো ব্যাঙ দুটো খেতে দিয়ে আসা হয়নি?
ততক্ষণে ট্রেনের বাতাসের ঝটকায় রেললাইনের পাথরের উপর ছিটকে মুখ থুবড়ে পড়ল বীণা। একটু পরে উঠে বসে দেখল, ট্রেনটা অনেকটা দূরে চলে গেছে। বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল বীণা।
থলকলমির ঝোপটা পেরোতে দেখল, একটা বুড়ো মানুষ দুটো গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছে। বীণা জিজ্ঞেস করল, ‘কাকু, এর পরের ট্রেন কখন আসবে গো?’
লোকটা বলল, ‘সেই সন্ধের মুখে গো মা!’
বীণা মনে-মনে ভেবে নিল, নয়নাকে খেতে দিয়ে সন্ধের আগে-আগে রেললাইনে ফিরে আসতেই হবে তাকে।