গান্ধীজি একটা কথা বলতেন। তাঁর মতে, ‘গণতন্ত্রের (Parliamentary democracy) দিনগুলোতে ব্যক্তির প্রতি সক্রিয় আনুগত্য বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে আনুগত্য ও আগনুগত্যহীনতা কেবল প্রতিষ্ঠানের প্রতি।’
গান্ধী-হত্যাকারীর পূজারি যাঁরা, তাঁদের মহাত্মাবাক্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতে পারে না। মোদিজিদের তা নেইও। গেরুয়াপক্ষ তাই মোদিবিরোধী মানেই দেশবিরোধী, এই সরল সমীকরণে আস্থাশীল।
তাতেও কিছু এসে যেত না। যদি না, সংসদের প্রতি গেরুয়া পক্ষের অবজ্ঞা হিটলারের পার্টির রাইখস্ট্যাগ পোড়ানোর সঙ্গে উপমিত হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যেত।
নাঃ! ভারতীয় জঞ্জাল পার্টি ভারতের সংসদ ভবনে অগ্নিসযোগ করার বেনজির দুঃসাহস দেখায়নি। কিন্তু তাদের কাজকর্মের সৌজন্যে গণতান্ত্রিক (Parliamentary democracy) ভারতের হৃদয় আজ দগ্ধ।
সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে মোদিপক্ষ সর্বমোট ১৪৬ জন বিরোধী সাংসদকে সংসদে থেকে বহিষ্কার করেছেন। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা মূলত দুটি বিষয় নিয়ে সংসদে আলোচনার দাবি জানাচ্ছিলেন। এক, সংসদে নিরাপত্তার বেহাল দশা। দুই কৃষকদের দুরবস্থা, কৃষি সংক্রান্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়সমূহ। গম, চাল, চিনির মতো প্রধান খাদ্যদ্রব্যের বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণের ফলে কৃষিজ পণ্যের রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সেই বিষয়টা আলোচিত হওয়া আবশ্যক ছিল। কিন্তু দুটির মধ্যে কোনওটিই আলোচিত হল না। উল্টে, বিরোধী সাংসদদের বহিষ্কার করে দিয়ে বিরোধীশূন্য সংসদে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হল। একেবারে ‘অরওয়েলীয়’ বিল।
জর্জ অরওয়েল একটি বই লিখেছিলেন। নাম ‘নাইটিন এইটি ফোর’ (১৯৮৪)। সেই বইতে সর্বাত্মক আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র কেমন হবে, তার একটা কাল্পনিক বর্ণনা ছিল। এই বিলগুলো, যেগুলো ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত আইন হয়ে গিয়েছে। সেগুলোর প্রতিটিতে ওই অরওয়েলের লেখা সর্বাত্মক আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের লক্ষণ সুপরিস্ফুট।
কেন এ কথা বলা হচ্ছে। তার বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া আবশ্যক।
প্রথমেই আসবে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও অপরাপর কমিশনার বিল, ২০২৩-এর কথা। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, নির্বাচন কমিশনের প্যানেলে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা এবং দেশের প্রধান বিচারপতি। আর, যে বিল বিরোধীশূন্য সংসদে হয়ে গেল সেটাতে বলা হল, ভারতের প্রধান বিচারপতির পরিবর্তে ওই প্যানেলে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। এর ফলে, নির্বাচন কমিশনার পদে শাসক দলের পছন্দের ব্যক্তিই মনোনীত হবেন, সেটা একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গেল। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা নষ্ট হবেই হবে। প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা তাঁর ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান মন্থন : স্টেট, স্টেটক্র্যাফট অ্যান্ড দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে উদ্দেশ্যে গঠিত, সেই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে যদি সেগুলো সচেতনভাবে ও আন্তরিকভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে জনগণ সেই প্রতিষ্ঠানসমূহে (এবং পরিণামে, সার্বিকভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর) আস্থা রাখে।’’ যেভাবে অধ্যাদেশগুলো পাশ হল এবং শেষমেশ আইনে পরিণত হল, তাতে একটা কথা স্পষ্ট। ভারতীয় জনতা পার্টি কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা রক্ষায় আগ্রহী নয়।
দ্বিতীয় যে বিলটার কথা বলতে হবে, সেটা হল নয়া দণ্ডসংহিতা। এটিও ক’দিন আগেই আইনে পরিণত হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে, ব্রিটিশ জমানায় প্রণীত হয়েছিল ফৌজদারি আইন। বলে হয়েছিল, সেই আইনের বদ্ধদশা থেকে যাতে ভারতের বিচার পদ্ধতি মুক্তি পায়, সরল ও আধুনিক হয়ে ওঠে, সেজন্যই সেটি সংস্কার করে নয়া দণ্ডসংহিতা প্রণয়ন করা হচ্ছে। বাস্তবে যেটা হল তাতে বোঝা যাচ্ছে, সবটাই ফাঁপা প্রতিশ্রুতি। একটু এদিক-ওদিক করে নতুন পাত্রে পুরোনো মদই পরিবেশিত হল, মাঝখান থেকে আইনি ভাষা আরও দুর্বোধ্য করে তােলা হল। এই বাহ্য! বিধি সংস্কারের অছিলায় সুনিপুণভাবে পুলিশি রাষ্ট্র গড়ে তোলার ব্যবস্থা হল। আগে বলা হত, ‘জামিন প্রাপ্তিটাই স্বাভাবিক, না-পাওয়াটা ব্যতিক্রম’, ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় নাকি এই নীতি অনুসৃত হয়। আর এখন, এই নয়া দণ্ডসংহিতার চক্করে ‘ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই জামিন পাওয়া যাবে, সাধারণভাবে জামিন মঞ্জুর হবে না।’ এটাই চালিকানীতি হয়ে দাঁড়াল। পুলিশি হেফাজতে থাকার সময়সীমা ১৫ দিন থেকে বেড়ে ৯০ দিন হল। ফলে, সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়ার অছিলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি আরও বেশি করে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হবেন, সে সম্ভাবনা প্রবলতর। অভিযুক্তের ওপর অত্যাচার চালিয়ে তথ্যপ্রমাণ নষ্টের কিংবা লোপাটের সুযোগও পুলিশ আরও বেশি করে পাবে। গ্রেফতার এবং আদালতে হাজির করার সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হাতকড়া পরানোর ওপর অতিমাত্রায় অহেতুক জোর দেওয়া হয়েছে নয়া সংহিতায়। বিভ্রান্তিকর তথ্য যা দেশের সার্বভৌমত্ব, সংহতি ও ঐক্যের পক্ষে ক্ষতিকারক, সেটার বিস্তার ঘটানো এখন থেকে ফৌজদারি অপরাধ। এর ফলে শাসক শিবিরের রাজনীতিকরা পুলিশি ক্ষমতার ওপর আরও বেশি মাত্রায় মাতব্বরি করার সুবিধা পাবেন আর বিজেপি সেটাই চায়। মোদিবিরোধীকে দেশবিরোধী হিসেব দেগে দিয়ে কারোকে ফৌজদারি অপরাধী হিসেবে হেনস্থা করার সুযোগ বৃদ্ধি পায় তাতে। বিচারব্যবস্থার পরিকাঠামো আদৌ আশানুরূপ নয়, অথচ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার দুরাশা এই নয়া দণ্ডসংহিতায় ব্যক্ত হয়েছে।
তৃতীয়তে যে অধ্যাদেশটির কথা বলতেই হবে, সেটি হল প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অব পিরিয়ডিক্যালস বিল, ২০২৩। এই অধ্যাদেশ জনস্বার্থ সুরক্ষিত রাখার আছিলায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কাটছাঁট করার পথে হেঁটেছে। বিজেপি সরকারের অনুমতি আগেভাগে না নিয়ে কেউ যদি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত কোনও কারাবন্দি ব্যক্তি বা সন্ত্রাসমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত এই অভিযোগে জেলবন্দি ব্যক্তির বিষয়ে কোনও সংবাদ প্রকাশ করেন বা পুনর্মুদ্রণ করেন, তবে তার কণ্ঠটি রোধ করা হবে। এটা নিশ্চিত করা হয়েছে নয়া আইনে। সরকার-বিরুদ্ধ কোনও অভিমত প্রকাশ বন্ধ করে দিতে পারে এবং জনগণের নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে গণমাধ্যমের দফতরে প্রবেশ করতে পারে, সে-অধিকারও নয়া আইন দিয়েছে।
টেলিকমিউকেশন বিল, ২০২৩-এর মতো মৌলিক অধিকারের পক্ষে হানিকারক আইন যে আরও আসবে, এটা প্রত্যাশিতই ছিল। তবে বিরোধীদের আইনসভা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এভাবে বাক্ স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতার টুঁটি টিপে ধরা হবে, এটা বোধহয় কেউ ভাবতেই পারেননি। কিন্তু জনগণের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ‘বিগ ব্রাদার’-এর ‘আচ্ছে দিন’ তো এভাবেই অতীতে নাৎসি জার্মানিতে এসেছিল, এখন পদ্ম-সুরভিত আমাদের দেশেও আসছে। যার দেওয়া পাস নিয়ে বোমা-কাণ্ডের দুষ্কৃতীরা সংসদে ঢুকেছিল, তার কোনও শস্তি হল না, আর এই ঘটনা নিয়ে যারা সংসদের ভিতরে প্রশ্ন তুলেছিল, তাদের বের করে দেওয়া হল! ওইসব কালাকানুন পাশ করানোর জন্যই এত নাটক।
প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি বলে গিয়েছেন, সংসদ যখন পিছনে আড়ালে চলে যায়, তখন জানবে সেটা হল সংসদীয় সংস্কৃতি বিলুপ্তির প্রথম লক্ষণ। এটাই ভারতের বিরুদ্ধে যে ‘বিশ্বের বৃহত্তম অনুদার গণতন্ত্র’ হয়ে ওঠার অভিযোগ উঠছে, সেটাকে পোক্ত করে।
আম্বেদকর বলতেন, ‘গণতন্ত্র (Parliamentary democracy) শুধু সরকারের একটা রূপমাত্র নয়।… এটা অবশ্যই সহ-নাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে সম্পর্কিত।’
গান্ধী, আম্বেদকর, এঁরা সবাই তো এখন পরিত্যজ্য। সুতরাং …।
আরও পড়ুন- বাংলার মুখ্যমন্ত্রীই সেরা, ব্যাখ্যা দিয়ে জানালেন ভারতীয় ক্যাথলিক বিশপ কাউন্সিলের ফাদার