স্বর্ণযুগের দুই মধুকণ্ঠী

একজনের অপাপবিদ্ধ কণ্ঠ বিরলের মধ্যে বিরলতর। যাঁর গানের আবেদন কখনও ফুরোবে না। অপরজনের সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ আপামর বাঙালি। বাংলা গানের স্বর্ণযুগে একঝাঁক সংগীত-নক্ষত্রের মাঝেও স্বতন্ত্র ঘরানার সেই দুই শিল্পী হলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নির্মলা মিশ্র। ২৯ এবং ৩১ জুলাই দুই শিল্পীর প্রয়াণদিবস উপলক্ষে তাঁদের স্মরণ করলেন উৎপল সিনহা

Must read

গায়িকাদের মধ্যে কার গলাটি তাঁর সবচেয়ে সুরেলা লাগে?
এক সাংবাদিকের করা এই কঠিন প্রশ্নটির উত্তরে একমুহূর্ত দেরি না করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন— প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় (Pratima Bandopadhyay)।
বিস্মিত সাংবাদিক জানতে চান লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখের চেয়েও কি এগিয়ে প্রতিমাদেবী? একটু হেসে কণ্ঠে চিরবসন্তের মালিক হেমন্ত বলেছিলেন—
‘প্রতিমার (Pratima Bandopadhyay) গানের কলি লতা নিজের বিশেষ সংগ্রহে রেখেছে। ওরা বলে, প্রতিমা মানুষই নয়। ও তো পাখি!’
এই প্রতিমাই গেয়ে গেছেন, ‘সাতরঙা এক পাখি, পাতার ফাঁকে ডালে ডালে করছে ডাকাডাকি’। তাঁর সারা জীবনে গাওয়া বিভিন্ন স্বাদের গানগুলিও নানা রঙের।
আটপৌরে চেহারা, কপালে টিপ, তাম্বুল-রাঙা ঠোঁট ও সাদামাঠা শাড়ির এই বঙ্গতনয়া বিদুষী, অনন্যা।
বাংলা গানের স্বর্ণযুগের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মধুকণ্ঠী প্রতিমা, যাঁর গানের আবেদন কখনও ফুরোবে না। আশ্চর্য তাঁর গায়নভঙ্গি। ধীর, স্থির, অচঞ্চল ও নির্লিপ্ত, প্রতিমার মতোই। ‘কঙ্কাবতীর কাঁকন বাজে ইচ্ছামতীর কূলে’, গাওয়ার সময়েও তালের ওঠানামায় এতটুকু হাতের মুদ্রার ব্যবহার থাকতো না, মাথা নড়ত না, দুরন্ত আবেগ প্রকাশের সময়েও মুখের একটি রেখাও কাঁপত না। শ্রোতারা তাঁর গানে মজে জগৎসংসার ভুলে মাথা দুলিয়ে তাল ঠুকে অস্থির! অথচ প্রতিমা স্বয়ং যেন পাথর, স্থাণুবৎ। এমন অনায়াস দক্ষতা ও সুরের এই মণিহার উনি পেলেন কোথায়? এ-প্রশ্নেরও জবাব দিয়ে গিয়েছেন কালজয়ী গায়ক ও সুরস্রষ্টা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ‘সে বাঁশরীকণ্ঠী, তাই সা থেকে সা তার থেকে সুরে আর কেউ গাইতে পারে না।’ সত্যিই, এমন অপাপবিদ্ধ কণ্ঠ বিরলের মধ্যে বিরলতর। তাঁর নিস্পৃহ ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে গাওয়া ছিল একটা শৈলীমাত্র। আনন্দ, দুঃখ, শোক ও বিষাদ প্রকাশে প্রতিমার তুলনা প্রতিমাই (Pratima Bandopadhyay)।

জন্মকথা
১৯৩৪ সালের ২১ ডিসেম্বর কলকাতার টালিগঞ্জে, তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন বিদুষী প্রতিমা (Pratima Bandopadhyay)। তাঁর আদিনিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরের বাহেরক গ্রামে।
তাঁদের পরিবার বরাবরই সংগীতে অনুরক্ত ছিল। পিতা মণিভূষণ চট্টোপাধ্যায় চাকরিসূত্রে সপরিবার কলকাতার ভবানীপুরে থাকতেন। তিনিও সংগীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর অকালমৃত্যু হয়। প্রতিমা মাত্র এক বছর বয়সে পিতৃহারা হন। আর্থিক অনটনের মধ্যেও প্রতিমার মা কমলা দেবীর প্রবল ইচ্ছায় হারমোনিয়াম কেনা হয় প্রতিমার জন্য এবং মায়ের কাছেই ছোট্ট প্রতিমার সংগীতের হাতেখড়ি হয়। এরপর প্রতিমা বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ প্রকাশকালী ঘোষালের কাছে গান শিখতে শুরু করেন। প্রতিমার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে প্রকাশকালী তাঁকে নিয়ে যান তাঁর গুরু স্বনামধন্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তাঁর কাছেও তালিম নেন প্রতিমা ।
শৈশবে সাত-আট বছর বয়সে ছুটিতে একবার ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এসে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে প্রতিমা শিশুবিভাগে গান গাওয়ার সুযোগ পান। সুকৃতি সেনের কথা ও সুরে ‘প্রিয় খুলে রেখো বাতায়ন’, ও ‘মালাখানি দিয়ে আমারে ভোলাতে চাও’, গান দু-খানি প্রতিমার কণ্ঠে সেনোলা কোম্পানি রেকর্ড করে এবং গানদুটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

প্রথম নেপথ্যের গায়িকা
কলকাতার এক জলসায় প্রতিমার (Pratima Bandopadhyay) গান শুনে চমৎকৃত হন খ্যাতিমান শিল্পী সুধীরলাল চক্রবর্তী। তিনি ১৯৫১ সালে ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছায়াছবিতে প্রতিমাকে দিয়ে
‘উছল তটিনী আমি সুদূরের চাঁদ’ গানটি গাওয়ান। আর সেইসাথে নেপথ্য গায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে প্রতিমার। ‘যদুভট্ট’ ছবিতে বিখ্যাত গান ‘বাবুল মোরা নৈহর ছুট হি যায়’ গেয়েছিলেন প্রতিমা ১৯৫৪ সালে। ওই বছরেই ‘ঢুলি’ চলচ্চিত্রে বৃন্দাবনী সারং-রাগাশ্রিত ‘নিঙাড়িয়া নীল শাড়ি শ্রীমতী চলে’ গানটি প্রতিমাকে জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। পরে ১৯৫৫ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘শাপমোচন’ ছবিতে চিন্ময় লাহিড়ীর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গাইলেন অবিস্মরণীয় গান, ‘ত্রিবেণী তীর্থপথে কে গাহিল গান’। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ও গায়কীর গুণে কঠিন গানেরও সূক্ষ্ম কারুকাজ সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করার সহজাত দক্ষতা ছিল এই অসামান্য প্রতিভাময়ী শিল্পীর। তারপর কয়েক দশক জুড়ে ছায়াছবির গানের জগৎ ভরিয়ে রেখেছিলেন প্রতিমা তাঁর মহার্ঘ্য কণ্ঠের কান্তিময় আলোয়। একইসঙ্গে আনন্দ ও বেদনার এমন অপরূপ প্রতিষ্ঠা বিরল কণ্ঠ ছাড়া সম্ভব নয়। ছুটি, চৌরঙ্গী, পরিণীতা, দাদাঠাকুর ইত্যাদি ছবিতে গাওয়া তাঁর গানগুলিও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায়। আধুনিক বাংলা গানে তো একসময় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন প্রতিমা। আবার রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, ভক্তিগীতি, কীর্তন, ভজন, কাব্যগীতি, রম্যগীতি এবং অতুলপ্রসাদের গানেও প্রতিমা ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তাঁর গাওয়া ‘আঁধার আমার ভালো লাগে’, ‘আমার যেমন বেণী তেমনি রবে’, ‘আমার সোনা চাঁদের কণা’, ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’, ‘একা মোর গানের তরী’, ‘একটা গান লিখো আমার জন্য’, ‘কুসুম দোলায় দোলে শ্যামরাই’, ‘ছলকে পড়ে কলকে ফুলে’, ‘তোমার দু’চোখে আমার স্বপ্ন আঁকা’, ‘তোমার দেওয়া অঙ্গুরীয় খুলতে পারিনি’, ‘তোমায় কেন লাগছে এত চেনা’, ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই’, ‘বড়ো সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি’, ‘সাতরঙা এক পাখি’, ‘সজনী গো রজনীকে চলে যেতে দাও’ ইত্যাদি কালজয়ী গানগুলি বাঙালি কোনওদিন ভুলতে পারবে না।
নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরপর তিন বছর বিএফজেএ পুরস্কার লাভ করেন এই অসামান্য শিল্পী। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্তহীন গভীরতায় পরিপূর্ণ ছিল প্রতিমার কণ্ঠ তথা অন্তর। শাস্ত্রীয় সংগীতের ঐশী উপলব্ধিই যে কোনও ধরনের গানে অপূর্ব আলোর মতো প্রতিভাত হয়ে উঠত প্রতিমার বিরলতর কণ্ঠে।

আরও পড়ুন- কেন্দ্রের উন্নয়নের আসল রিপোর্ট ফাঁস করে চাকরি গেল অধিকর্তার

শেষের দিনগুলি
১৯৮৬ সালে প্রতিমার স্বামী অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাঁর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। শেষ জীবনে প্রতিমা (Pratima Bandopadhyay) বাতের ব্যথায় খুবই কষ্ট পেয়েছেন এবং ভীষণ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছেন। ২০০৪ সালের ২৯ জুলাই তিনি কলকাতায় প্রয়াত হন।
প্রতিমা প্রায়ই গানের অনুশীলন করতেন মাঝরাতে। ছিলেন চাপা রসিক। তাঁর নিজের ইংরেজি ভাষায় অস্বাচ্ছন্দ্য নিয়েও মজা করতেন। প্লেনে চড়তে ভয় পেতেন বলে বিদেশে অনুষ্ঠান করতে যেতেন না। মাত্র একবার বাংলাদেশে গিয়েছিলেন গান গাইতে। অনেকেই বলেন প্রতিমা ছিলেন গায়িকাদের গায়িকা। একইসঙ্গে একটি কণ্ঠে এমন লাবণ্য, এমন পেলবতা ও মাধুর্য এবং এমন মায়াবী আকর্ষণ সচরাচর বিরল। এমন ঐশী ধ্যানমগ্ন সৌন্দর্য যাঁর কণ্ঠে বিরাজ করে, তাঁর প্রকাশে তো নিস্পৃহ ও নির্লিপ্ত ঔদাসীন্য থাকবেই। তাঁর গান গাওয়ার অনায়াস ভঙ্গিতেই প্রচ্ছন্ন থাকত তাঁর ঈশ্বরদত্ত প্রতিভার বিশালতা। সব মিলিয়ে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নিগ্ধ গায়কী যেন শান্ত প্রদীপের এক অপরূপ অনুচ্চ আভা।

………………………………………………………………

 

‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না যাতে মুক্তো আছে’ এবং ‘ও তোতা পাখি রে শিকল খুলে উড়িয়ে দেব মাকে যদি এনে দাও’— এই দুটি গান ছাড়া আর একটি গানও যদি সারাজীবনে না গাইতেন বাংলা গানের ‘তোতাপাখি’ নির্মলা মিশ্র (Nirmala Mishra), তাতেও কিছু যেত আসত না। তিনি অবিস্মরণীয় ও অমর হয়েই থেকে যেতেন বাঙালির মনে ও মননে। বাঙালির বড় আদরের শিল্পী এই নির্মলা সব ধরনের গানের শ্রোতাদের কাছেই সমান জনপ্রিয়।

জন্মকথা
১৯৩৮ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মজিলপুরে জন্মগ্রহণ করেন নির্মলা। এরপর বাবার চাকরি সূত্রে পরিবারের সঙ্গে কলকাতার চেতলায় স্থানান্তরিত হন। বাড়িতে ছিল সাংগীতিক পরিবেশ। বাবা ও দাদু দুজনেই ছিলেন গায়ক হিসেবে সুপরিচিত। নির্মলার ডাকনাম ছিল ঝামেলা। তাঁদের পারিবারিক পদবি ছিল ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’। পরে তাঁর পরিবার ‘মিশ্র’ উপাধিতে ভূষিত হয়। তাঁর বাবাকে কাশী সংগীত সমাজের পক্ষ থেকে পণ্ডিত, সংগীতরত্ন ও সংগীতনায়ক উপাধিতেও ভূষিত করা হয়।
সংগীত পরিচালক বালকৃষ্ণ দাস তাঁকে ১৯৬০ সালে ওড়িয়া চলচ্চিত্র ‘শ্রী লোকনাথ’-এ প্রথমবার একটি গান গাওয়ার সুযোগ দেন। পরে ‘স্ত্রী’, ‘অভিনেত্রী’, ‘অনুতাপ’, ‘কি কাহারা’, ‘মালাজানহা’, ‘আমদাবাতা’, ‘আদিনা মেঘা’ ইত্যাদি জনপ্রিয় ওড়িয়া চলচ্চিত্রে গান গেয়ে নির্মলা মিশ্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং
‘সংগীত সুধাকর বালকৃষ্ণ দাস’ সম্মানে ভূষিত হন। এ ছাড়াও ‘জীবন সাথী’, ‘ধরিত্রী’, ‘ঘরবাহুদা’, ‘অমর প্রেমা’, ‘বন্ধনা’, ‘মানিকজোদি’, ‘সংসার’, ‘চিলিকা তেরে’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে তাঁর গাওয়া গানগুলি ওড়িয়া ছায়াছবিতে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে। নিজের কিশোরীবেলা থেকেই দারুণ গান গাইতেন নির্মলা।

তাঁর অমর সৃষ্টি
সুরেলা কণ্ঠের জাদু এবং অনায়াস গায়নভঙ্গিতে তিনি মুগ্ধ করেছেন আপামর বাঙালিকে। বাংলা গানের স্বর্ণযুগে একঝাঁক সংগীত-নক্ষত্রের মাঝেও এক স্বতন্ত্র ঘরানা তৈরি করেছিলেন নির্মলা। এখানেই তিনি বিশিষ্ট ও অনন্যা।
‘তোমার আকাশ দুটি চোখে’, ‘ও আমার মনপাখি, সুখ যে আমার’, ‘আমায় বাঁশের বাঁশি দাও বাজাতে’, ‘আকাশে নেই তারার দীপ’, ‘চাঁদকে নিভিয়ে রাখো’ ইত্যাদি জনপ্রিয় গানগুলি গেয়ে বাংলা গানের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করে গেছেন তিনি।
১৯৭৫ সালে ‘অনুতাপ’ নামের ওড়িয়া ছায়াছবিতে তাঁর গাওয়া ‘নিদা ভরা রাতি মধু ঝড় জানহা’ গানটি আজও সেরা ওড়িয়া গানের তালিকায় একেবারে শীর্ষে আছে।
‘সবুজ পাহাড় ডাকে’, ‘বলো তো আরশি’, ‘রিমিঝিমি রিমিঝিমি’, ‘আজ কোনো কাজ নেই’, ‘আমি তো তোমার চিরদিনের’, ‘ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি’ ইত্যাদি গানগুলি বাংলা গানের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাঁর অনন্য কণ্ঠে গাওয়া ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’ যেন মুক্তোসন্ধানী বাঙালি শ্রোতাদের মর্মের কথা। এই মন-কেমন-করা গানের কথা ও সুরে একইসঙ্গে মন বিষণ্ণতা ও প্রশান্তির আলোছায়ায় দুলতে থাকে। এই হাহাকারে যেন শুশ্রূষাও লুকিয়ে আছে খানিকটা। আছে সাময়িক ভারমুক্তির আশ্বাস।
‘ও তোতা পাখি রে’ গানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে মাতৃহারা এক সন্তানের মাকে ফিরে পাওয়ার করুণ আর্তি। এই গানে বাঙালির চোখ ভিজে যায়, গ্রাস করে অতল এক বিষণ্ণতা এবং তখনই যেন মনে হয় মায়ের প্রকৃত তর্পণ সম্পন্ন হল কথা, সুর ও অসামান্য গায়কীর অপূর্ব মেলবন্ধনে। তাঁর গাওয়া ‘আবেশে মুখ রেখে পিয়াল ডালে’ গানটিতে পাওয়া যায় আশ্চর্য এক সুরের আবেশ। নরম, স্নিগ্ধ, মায়াময়।
‘আমি তো তোমার চিরদিনের হাসিকান্নার সাথী’ গানটি এই প্রজন্মের নতুন শ্রোতারা তো বটেই, এমনকী প্রবীণেরাও আপনমনে গুনগুন করেন আজও। নির্মলার গাওয়া ‘সেই একজন দিও না তাকে মন’ শুনলে যেন একআকাশ আবেগ আর অনুভূতি হাজির হয় বুকে জমে থাকা অভিমানের হাত ধরতে। তিনি গেয়েছেন— ‘কাগজের ফুল বলে আজও ঝরেনি, সত্যি সে ফুল হলে ঝরে যেত, পাষাণ হৃদয় তাই আজও গলেনি, সত্যি হৃদয় হলে গলে যেত’। এই গান যেন দার্শনিক চেতনার আলোয় আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় রূঢ় কঠোর এক জীবনসত্যের মুখোমুখি। ‘এই বাংলার মাটিতে মাগো জন্ম আমায় দিও’ বাঙালির অন্তরের বাসনা। উল্লেখ্য, অসমীয়া ছায়াছবিতেও গান গেয়েছেন বাংলার এই বিদুষী-কন্যা।
তিনি অনেক গীতিনাট্যেও অংশ নিয়েছেন। ১৯৭৬ সালে তিনি উত্তমকুমারের সঙ্গে মহালয়া গীতিনাট্যে অংশগ্রহণ করেন। এ-ছাড়াও তিনি অসংখ্য নজরুল গীতি, রবীন্দ্রসংগীত, শ্যামাসংগীত, দেশাত্মবোধক গান, ভজন ও লোকসংগীত গেয়েছেন।
‘উন্মনা মন স্বপ্নে মগন’, ‘আবিরে কে রাঙালো আমায়’, ‘চোখের মণি হারিয়ে খুঁজি’— এই সমস্ত মনকাড়া গান বাঙালি কোনওদিন ভুলতে পারবে না।
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু এবং অন্যান্য অনেক বিশিষ্ট শিল্পীর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গান গেয়ে বাংলা গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধশালী করেছেন নির্মলা মিশ্র।

শেষের কথা
২০২২ সালের ৩০ জুলাই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার চেতলার বাড়িতে জীবনাবসান হয় এই কিংবদন্তি শিল্পীর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন তিনি। পরিবারে তাঁর স্বামী, পুত্র ও পুত্রবধূ রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ২০১২ সালে ‘সঙ্গীত সম্মান’ এবং ২০১৩ সালে ‘সঙ্গীত মহাসম্মান’ ও ‘বঙ্গ বিভূষণ’ সম্মাননা প্রদান করে। নির্মলা মিশ্রের প্রয়াণ কেবলমাত্র একজন গায়িকার চলে যাওয়া নয়, বরং বলা যেতে পারে সংগীত জগতের এমন এক অধ্যায়ের সমাপ্তি, যে-অধ্যায় বাংলা গানের সোনাঝরা সময়ের এক যুগান্তকারী পর্ব। মণিমুক্তো-সমৃদ্ধ গানের যে বিশাল ভাণ্ডার রেখে গেলেন নির্মলা, সেই ভাণ্ডারের কোনও ক্ষয় নেই, তা অবিনশ্বর। সেইসব মণিমুক্তো-গাঁথা গানের মধ্যেই অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন বাংলা গানের বড় আদরের তোতাপাখি নির্মলা।

Latest article