‘আমি সতেরও মা অসতেরও মা’ বলতেন শ্রীশ্রীমা। আমাদের মা সারদা (Sarada Devi- Jayrambati)। মহাসমাধির আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তাঁর সন্তানদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করে গিয়েছিলেন। সহজ-সরলভাবে ভগবততত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। মহাসমাধির আগে সারদা মায়ের শেষ উক্তি সম্পর্কে স্বামী গম্ভীরানন্দজি বলেছিলেন, ‘‘এক ভক্ত মাকে দেখতে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, মা আমাদের কী হবে? তখন শ্রীশ্রীমা তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি ঠাকুরকে দেখেছ, তোমার আবার ভয় কী? তবে একটা কথা বলি, যদি শান্তি চাও মা তবে কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয় মা, জগৎ তোমার।’ এই ছিল তাঁর শেষবেলার অন্তিম বাণী। সত্যি এমন করে জীবনের সারৎসার, বেঁচে থাকার মন্ত্র আর কেই-বা বোঝাবে!’’ ইতিহাস অনুযায়ী পরমহংস ঘরনি মা সারদার জন্মতিথি ১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর। বাংলার ১২৬০ সালের ৮ পৌষ বৃহস্পতিবার রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামাসুন্দরী দেবীর ঘর আলো করে এসছিলেন সারদামণি। তাঁর জন্মস্থান জয়রামবাটি এবং ঠাকুরের কামারপুকুর। শ্রীশ্রীমা এবং ঠাকুরের বাল্য-শৈশব এবং পরবর্তী জীবনের স্মৃতি-বিজড়িত এই জয়রামবাটি এবং কামারপুকুর গ্রাম।
পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সেরা দর্শনীয় স্থান হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে। যাঁরা বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর বেড়াতে আসেন তাঁরা এই দুটো জায়গা একসঙ্গে দর্শন করে যান। মা এবং ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভক্তবৃন্দদের কাছে এই স্থান তীর্থক্ষেত্র।
জয়রামবাটিতেই আবির্ভূত হয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সাধনসঙ্গিনী, দেবীর অংশ মা সারদা। সেখানে তাঁর ভিটের সামনেই ছিল পুন্যিপুকুর এবং একটি পাড়বাঁধানো সুন্দর দিঘি। যা এখনও আছে।
মাতৃমন্দির মঠ
কলকাতা থেকে বাঁকুড়া প্রায় দুশো কিলোমিটার আর বাঁকুড়া থেকে পঁচাশি কিলোমিটার হল জয়রামবাটি। ছোট্ট একটি গ্রাম বিষ্ণুপুর থেকে সাতাশ মাইল দূরে এবং কামারপুকুর থেকে তিন মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। ১৯২৩ সালে সারদা মার বাসভবনটিতে একটি মঠ নির্মিত হয়। যার নাম ‘মাতৃমন্দির মঠ’ জয়রামবাটি। এই মঠের মধ্যেই রয়েছে মাতৃমন্দির, মায়ের পুরনো বাড়ি, নতুন বাড়ি, পুন্যিপুকুর এবং সূর্যনারায়ণ ধর্মঠাকুরের মন্দির। এইগুলো দেখতেই আসেন ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি। এ এক অন্য বেড়ানো, অন্য উপলব্ধি।
মায়ের আরাধনা
মাতৃমন্দির হল যেখানে সারদা মায়ের জন্ম হয়। এর উপরেই মন্দিরটি তৈরি হয়েছে। ১৯৩২ সালের ১৯ এপ্রিল স্বামী সারদানন্দ এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীশ্রীমা এখানে ছিলেন ৯ বছর বয়স পর্যন্ত। এখানেই শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এখানে মা সারদার একটি শ্বেতপাথরের মূর্তি রয়েছে। ১৯৫৪ সালে মায়ের জন্মশতবর্ষপূর্তিতে এই শ্বেতপাথরের মূর্তিটি বসানো হয়। মাকে যথাযথ ‘ভোগ’ ও আচার-অনুষ্ঠান দিয়ে প্রতিদিন উপাসনা করা হয়। মন্দিরটির সামনে একটি উপাসনাকক্ষ রয়েছে। চাইলে যে কেউ এখানে বসে শান্তিতে ধ্যান করতে পারেন।
আরও পড়ুন-কার্নিভালের উদ্বোধন করে বিশ্বশান্তির বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
পুরনো ও নতুন বাড়ি
এখানে মা সারদা ছিলেন ১৮৬৩ সাল থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত। মায়ের কাছে এখানে বহু ভক্ত দীক্ষা লাভ করেছিলেন। এখানেই মা শুরু করেছিলেন জগদ্ধাত্রী পুজো। সামনেই পুন্যিপুকুর যে পুকুর সেটি মা নিয়মিত ব্যবহার করতেন। এটা মায়ের ঘাট নামে পরিচিত আর আমোদর নদকে বলা হয় সারদা মায়ের গঙ্গা। মাতৃমন্দির থেকে বাঁদিক দিয়ে হেঁটে গেলে একটা পাঁচিল ঘেরা সারদা মায়ের নতুন বাড়ি। ১৯১৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মা এখানেই থাকতেন। মায়ের বহু ভক্ত মিলিতভাবে এটা তৈরি করে আরও ভাল করে রাখবার জন্য। খড়ের চাল দিয়ে ঢাকা মাটির কুঁড়েঘর আর একটা উঠোন রয়েছে। মাতৃমন্দিরের মূল ফটক থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে পড়ে সারদা মায়ের পুরনো বাড়ি। এখানে ১৯১৫ সালের আগে পর্যন্ত তিনি থাকতেন। নতুন বাড়ির মতো এখানেও খড়ের চাল দিয়ে ঢাকা কয়েকটা মাটির বাড়ি রয়েছে।
ধর্মঠাকুরের মন্দির। পুন্যিপুকুরের পাশেই এই মন্দিরটি আছে। মন্দিরটি সারদা মায়ের পরিবারের গৃহদেবতা সূর্যনারায়ণ ধর্মঠাকুরের মন্দির। এখানে নিয়মিত তাঁর পুজো করা হয়।
সিংহবাহিনীর মন্দির
মা সারদা মা সিংহবাহিনীর পুজো করেছিলেন এখানে। শ্রীশ্রী মায়ের মতে দেবী এবং তাঁর দুই সঙ্গী, শ্রীমহামায়া এবং চণ্ডী খুবই জাগ্রত। মঠের কাছেই এই মন্দিরটি অবস্থিত। সিংহবাহিনী হল মা দুর্গার একটি রূপ এবং এটি জয়রামবাটি গ্রামের দেবতা। মন্দিরটিতে সিংহবাহিনী, মহামায়া, চণ্ডী ও মনসার ধাতব মুখ রয়েছে, তবে কোনও সম্পূর্ণ মূর্তি নেই। সারদা দেবী বহুবার এই মন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন। এখানকার লোকেরা এই মন্দিরের মাটি খুব পবিত্র হিসেবে ধরে এবং এই মাটিকে ঔষধ হিসাবেও ব্যবহার করেন তাঁরা।
কামারপুকুর
জয়রামবাটির (Sarada Devi- Jayrambati) সঙ্গে কামারপুকুর না এলে ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না। শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মভিটে এই কামারপুকুর গ্রামে। সেই জন্মভিটে ঘিরে খড়ের চালা, কাঁচাবাড়ি অক্ষত রেখে গড়ে উঠেছে এখানকার রামকৃষ্ণ মঠ। ঠাকুরের পৈতৃক ভিটে এই কামারপুকুরের অনতিদূরে দেরে গ্রামে। ঠাকুরের পিতা জমিদারি-অত্যাচারে সব খুইয়ে কামারপুকুরে আসেন। এখানেই গদাধরের জন্ম। ১৯৫১ সালে তাঁর এই জন্মভিটেতে রামকৃষ্ণদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাদা মার্বেলের শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে এখানে। মঠের প্রবেশদ্বারে যোগী শিবের মন্দির। এখানে এলে হালদার পুকুর, লাহাবাবুদের বাড়ি, গোপেশ্বর শিবমন্দির, রঘুবীর মন্দির, ভিক্ষামা ধনী কামারনির বাড়ি, ঠাকুরের নিজের হাতে পোঁতা আমগাছ, বৈঠকখানা ইত্যাদি হল বিশেষ দর্শনীয় স্থান। কত স্মৃতি, কত ভক্তিবৎসলতা জড়িয়ে আছে এখানে।