লাজে রাঙা হল কনে বউ গো

বিয়েতে সানাই হোক বা ঢোল, নাকাড়া— যা-ই বাজুক না কেন লাজুক নয়নে নববধূর মালাবদল আর শুভদৃষ্টির অপেক্ষাটা কিন্তু একইরকম। মালাবদল আর শুভদৃষ্টি এ-দেশের প্রায় সব বিয়েতেই হয়ে থাকে। কিন্তু তবুও তার মধ্যে প্রত্যেকের কিছু আলাদা নিয়ম রয়েছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের বিবাহের বৈচিত্র নিয়ে লিখলেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

সকাল থেকেই মধুপর্ণার বাড়িতে হইচই শুরু হয়ে গেছে। কারণ আজ যে তাঁর বিয়ে কুশলের সঙ্গে! বাড়িময় আত্মীয়-স্বজন। মধুপর্ণার ঘুম ভেঙেছে সেই কাকভোরে মা-কাকিমার ডাকে। আজ ভোরবেলা দধিমঙ্গল হবে তাঁর। বাঙালি বিয়ের (Marriage- Bride) রীতি অনুযায়ী ভোরবেলা সূর্যোদয়ের আগে কনেকে (Marriage- Bride) দই-খই খেয়ে নিতে হবে, সূর্য উঠে গেলে সারাদিন আর কিছু খাওয়া চলবে না, সারাদিন শুধুমাত্র শরবতের উপর ভরসা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একে একে চলেছে নান্দীমুখ, গায়েহলুদ পর্ব। সন্ধেবেলায় শুভদৃষ্টি, মালাবদল, সাতপাক, হোম-যজ্ঞ, সিঁদুরদান শেষে সম্পূর্ণ হয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠান। সাঙ্গ হল মধুপর্ণার বিয়ে। সুন্দর একটি সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হল সে তার ভালবাসার মানুষ কুশলের সঙ্গে।
ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। নানা ধর্ম, নানা বর্ণ-সমন্বিত দেশ এই ভারতবর্ষ। বৈচিত্রের মধ্যেই ঐক্য এখানে সর্বত্র বিরাজমান। তাই অন্যান্য সবকিছুর মতোই এখানে এক-একটি প্রদেশের বিবাহ এক-একরকম বৈচিত্রপূর্ণ। বাঙালি বিয়ের মতোই মালাবদল এবং শুভদৃষ্টি প্রায় সব প্রদেশের বিয়েতেই রয়েছে। তবুও প্রতিটা বিয়েই একে অপরের চেয়ে আলাদা অথচ সুন্দর।

কল্যায়ানম
দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে দিনের বেলায় বিবাহ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তামিল বিয়েকে বলা হয় কল্যায়ানম। তামিলদের বিবাহ অনুষ্ঠান পাঁচদিন ধরে চলে। বিয়ের আগের দিন বর তার ভাই-বোন, মা-বাবা-সহ কনে যেখানে থাকে সেখানে এসে অন্য একটা জায়গায় ওঠে। এরপর মন্দির ঘুরে বরকে একটি বিবাহ মণ্ডপে নিয়ে আসা হয়। সেখানে উপস্থিত লোকের সামনে ঘোষণা করা হয় ওই মেয়ের বিয়ে হবে বা অমুকের মেয়ের বিয়ে হবে এই বরের সঙ্গে। এরপর বর-কনেকে একসঙ্গে বসানো হয় এবং খাওয়াদাওয়া করা হয়। বিয়ের দিন সকালবেলায় প্রথম অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘ব্রতম’। নবদম্পতির সুখ-শান্তি এবং দীর্ঘায়ু কামনা করাই হচ্ছে এই অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্দেশ্য। এ ছাড়াও যাতে তাদের সমস্ত বাধা-বিপত্তি কেটে যায়, এবং তাদের কোনও অমঙ্গল না হয় তার উদ্দেশ্যেও এই ব্রতম অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে।

তালিবন্ধন
দক্ষিণ ভারতের সমস্ত বিয়ের মূল অনুষ্ঠানের অংশ হচ্ছে তালিবন্ধন। এই তালির অপর নাম হচ্ছে থিরুমঙ্গলম। বিয়ের সময় বর কনের গলায় এই থিরুমঙ্গলাম বেঁধে দেয়। আর বাঙালিদের সিঁদুরের মতো থিরুমঙ্গলম হচ্ছে দক্ষিণ ভারতের বিবাহিত মহিলাদের চিহ্ন। দক্ষিণ ভারতের বিয়ের সময় বর-কনেকে পিঁড়ির ওপর বসিয়ে পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করে হোম-যজ্ঞ করেন। এই হোম-যজ্ঞের সময় বর একটি শাড়ি এবং থিরুমঙ্গলম কনের হাতে দেয় এবং সেই সময় বরকেও একটি বস্ত্র দেওয়া হয়। বর-কনে উভয়েই সেই বস্ত্র পরিধান করে। এরপর থিরুমঙ্গলমটি দেবতার কাছে উৎসর্গিত হয় এবং এরপর থালার ওপর রেখে বিয়েতে উপস্থিত লোকজনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য। এরপর একটি জোয়াল পুজো করা হয়। এবং সেটি বর-কনের কাঁধের ওপর রাখা হয় আর বর-কনে একসঙ্গে সংসারের সব সুখ-দুঃখের সমান অংশীদার সেটার রূপক হিসেবে এই প্রথা করা হয়ে থাকে। এই জোয়াল গ্রহণের পর অনেককে তার বাবার কোলে বসানো হয় এবং এই অবস্থায় বর কনের গলায় থিরুমঙ্গলম বেঁধে দেয়। এরপর বর-কনে হোমাগ্নি প্রদক্ষিণ করে এবং এরপর কনে একটা পা পাথরের ওপর রাখে এই কনের পাথরে পা রাখার অর্থ হচ্ছে স্বামীর প্রতি তার ভক্তি আর অনুরাগ দৃঢ় থাকবে। রাত্রিবেলা বর-কনে আকাশের ধ্রুব ও অরুন্ধতী নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে তাদের বিবাহ সম্পন্ন করে এবং বড়দের আশীর্বাদ নেয়। বিয়ের পরের দিন বর কনেকে (Marriage- Bride) নিয়ে নিজের বাড়ি চলে যায়।

আরও পড়ুন-ভোলবদলের সাতপাক

সাখরপুড়ায় পাকাদেখা
দক্ষিণ ভারতে পাঁচদিনব্যাপী বিয়ে হলেও হরিয়ানাতে দু’দিন এবং মহারাষ্ট্র এবং গুজরাতে একদিনের মধ্যেই বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়। মহারাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী পছন্দ হলে সকলকে সাক্ষী রেখে যৌতুকের জন্য ইয়াদি নামের এক চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। মেয়েকে বিয়েতে কী কী যৌতুক দেওয়া হবে সেইগুলো এই চুক্তিপত্রে লেখা থাকে। এই পত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার পর মেয়ের বাবা-মা পাত্র ও তার আত্মীয়-স্বজনকে তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায়। এই দিন মেয়ের বাবা ছেলেকে এবং ছেলের বাবা মেয়েকে (Marriage- Bride) পুরোহিতের কুমকুমতিলক পরিয়ে দেয়। এরপর ছেলের বাবা জোড়ি দিয়ে তৈরি একটি ঠোনায় করে মেয়ের হাতে মিষ্টি দেয়। আর এই অনুষ্ঠানটির নাম সাখরপুড়া। মহারাষ্ট্রে এটাকেই পাকা দেখার অনুষ্ঠান বলা হয়ে থাকে। বিয়ের দিন সকালে বর-কনে উভয়ের বাড়িতেই গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান হয়। এরপর বর বিয়ে করতে এলে মেয়ের বাবা-মা জল ও দুধ দিয়ে বরের পা ধুইয়ে দেয়। বরের এই বিবাহ অনুষ্ঠানে প্রবেশ অর্থাৎ বিয়ের মূল পর্বটির নাম সীমন্ত পুজা। এরপর বরকে নিয়ে যাওয়া হয় বিবাহ মণ্ডপে। সেখানে একটি পিঁড়ির উপর বরকে দাঁড় করিয়ে তার সামনে একটি কাপড় দিয়ে আড়াল করে দেওয়া হয়। এরপর কনের মামা কনেকে নিয়ে আসে এবং আটবার মঙ্গলাষ্টক মন্ত্র পাঠ করা হয়। মন্ত্রপাঠ শেষ হলে মাঝখানের কাপড়টা সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর কনে বরকে মালা পরিয়ে দেয় এবং বর সোনার পুঁতি দিয়ে তৈরি মঙ্গলসূত্রম কণ্ঠি কনের গলায় পরিয়ে দেয়। এরপর বর কনেকে পাশাপাশি বসিয়ে মেয়ের (Marriage- Bride) বাবা কন্যাদান করে। এই কন্যাদান করার সময় বরের হাতের ওপর কনের হাত রেখে কনের বাবা মেয়ের হাতে অল্প জল ঢেলে দেন। সেই জল কনের আঙুলের ফাঁক দিয়ে বরের হাতে পড়লেই কন্যাদান সমাপ্ত হয়। এরপর খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে বর কনেকে নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে যায়। এবং শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশের সময় সদর দরজায় রাখা এক-কুনকে-চাল পা দিয়ে ফেলে তারপরে কনেগৃহে প্রবেশ করে। এই সময় বর কনেকে নতুন নাম দেয় এবং সেই নামেই শ্বশুরবাড়িতে সে পরিচিতি পায়। মহারাষ্ট্রে এই দিনই ফুলশয্যা অনুষ্ঠিত হয়।

‘সেহা’ আর ‘চৌকা’
হরিয়ানার বিয়ের মূল পর্বটি বলা হয় ‘সেহা’। এই পর্বে বর মণ্ডপে উপস্থিত হয়। হরিয়ানাতে বিয়ের দিন কন্যাদান, হোম-যজ্ঞ, মাল্যদান প্রভৃতি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বরমালা এবং সাতফেরে হল আসল পর্ব। এরপর অগ্নি প্রদক্ষিণ শেষ হলে বরের বোনেরা কনের (Marriage- Bride) গলায় মালা পরিয়ে দেয়। এই অনুষ্ঠানটিকে চৌকা বলা হয়। আর এই চৌকা অনুষ্ঠান পালন করার জন্য কনের মা বরের বোনেদের শাড়ি প্রদান করে। বিয়ের পরের দিন কনে তার শ্বশুরবাড়ি যায়। শাশুড়ি সদর দরজায় এসে বর-কনেকে দুধভরা ঘটি দিয়ে আশীর্বাদ করেন। এবং সেই দিনই ফুলশয্যা অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়।

শাগুন থেকে জয়মালা
গুজরাতে প্রথম মেয়ে দেখতে আসার দিন পাত্রও তার বাড়ির লোকের সঙ্গে মেয়ে দেখতে আসে। মেয়ে পছন্দ হয়ে গেলে পাত্র-পাত্রী নিজেদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় সারে এবং বরপক্ষকে মেয়ের বাড়ির লোক মিষ্টিমুখ করায়। আর এই অনুষ্ঠানটির নাম মিঠাজিভ।
তারপর কনের বাবা শাগুন নিয়ে হাজির হয় ছেলের বাড়ি। এক্কেবারে বিয়ের দিন ঠিক করে ফেরেন তিনি। সাধারণত দুপুরবেলাতে গুজরাতিদের বিয়ে হয়। আর কনেরা লাল অথবা সবুজ রঙের শাড়ি পরে বিয়ে করে। বিয়ের আগে গুজরাতিদের ‘চুনরি প্রসঙ্গ’ নামক একটি অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে সবুজ রঙের জারদৌসি শাড়ি অলংকার-মিষ্টি-নারকেল ইত্যাদি নিয়ে ছেলের মা পাত্রীর বাড়ি আসে এবং পাত্রীকে তিলক পরিয়ে সেগুলো তার হাতে দেয়। এ ছাড়াও মেয়ের নাকে একটা নাকছাবি এবং পায়ে একটি আংটি পরিয়ে দেয়। এরপর হয় নারকেল বদলি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে মেয়ে পক্ষের মহিলারা ছেলের বাড়িতে যায় এবং পাত্রকে তিলক পরিয়ে আশীর্বাদ করে। এরপরে পাত্রর বোন অথবা বউদি এসে পাত্রীকে পাত্রর বাড়ি নিয়ে যায়। সেখানে মেয়ের পায়ে কুমকুম লাগিয়ে একটা সাদা কাপড়ের উপর ছাপ নেওয়া হয়। এরপর হবু শাশুড়ি তার হবু বউমাকে নতুন শাড়ি দেয় এবং শরবত খাওয়ায়।
বিয়ের দিন বর মণ্ডপে এলে বর-কনের মালা বদল হয় এবং কনের মা বরকে আরতি করে এবং জলপূর্ণ কলসি নিয়ে বরণ করে। এরপর বিয়েতে হোম-যজ্ঞ ও মন্ত্রপাঠ শুরু হয়, মন্ত্রপাঠ শেষ হলে কনের বোন বা বউদি এক টুকরো হলুদ কাপড় কনের শাড়ির আঁচলের সঙ্গে বেঁধে বরের কাঁধের উপরে দেন। এরপর বর-কনে হোমাগ্নি প্রদক্ষিণ করে। প্রদক্ষিণ করার পর তাদেরকে দেবতার মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই রাতেই বর কনেকে নিয়ে নিজগৃহে ফিরে যায়। সেখানে বর-কনেকে দিয়ে গণেশ পুজো করানো হয়। এবং সেই রাতেই ফুলশয্যা অনুষ্ঠিত হয়।

আদিবাসী বিয়ে
ভারতবর্ষের বুকে বহু আদিবাসী সম্প্রদায়ও বসবাস করে। তাদের বিয়ের মধ্যেও ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
ভিলদের মধ্যে বর তার বাবা এবং অন্যান্য আত্মীয়দের নিয়ে কনের বাড়ি যায় এবং কনের বাবাকে কিছু অর্থ দান করে। তারপর বর-কনেকে একসঙ্গে বসিয়ে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সবাই মিলে তাদের ঘিরে নাচ গান করতে থাকে। এরপর খাওয়াদাওয়া এবং মদ্যপান হয়, আর এই ভাবেই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়। গোগুদের মধ্যে বরপক্ষ এবং কন্যাপক্ষ উভয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে মধ্যপথে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়। এখানে তাদের মধ্যে দানসামগ্রীর আদান-প্রদান ঘটে এবং বর-কনে জলভর্তি একটি মঙ্গল ঘট সাতবার প্রদক্ষিণ করে বিবাহ সম্পন্ন করে। এক্ষেত্রেও বর-কনেকে ঘিরে নাচ-গান, খাওয়াদাওয়া মদ্যপান করা হয়ে থাকে। মারিয়া সম্প্রদায়ের বিয়েতে মেয়েকে নিয়ে মেয়ের বাড়ির লোক বরের বাড়িতে আসে এবং সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় এবং এদের মধ্যে বিয়েতে ছাগল বলি দেওয়ার নিয়ম আছে। উদয়পুরের পান্ডারা বিয়ে উপলক্ষে একটা দণ্ড স্থাপন করে এবং সেই দণ্ডকে সাতবার ঘুরে বিবাহকর্ম সম্পন্ন করে। মানডালা ও বালাঘাটের বাইগারদের মধ্যে বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেলে বরের বাবা কনের বাবাকে মদের বোতল উপহার দেয়। এই মদের কিছুটা দেবতার কাছে উৎসর্গ করা হয় এবং বাকিটা উপস্থিত সকলের মধ্যে পরিবেশন করা হয়।
ভারতবর্ষের এক-এক জায়গায় এক-এক রকম বিয়ের রীতি হলেও প্রজাপতি ব্রহ্মার আশীর্বাদে সর্বত্রই বিয়ের মণ্ডপে দুটি হৃদয় এক সুতোয় বাঁধা পড়ে যায়। আর তাই বলা যেতেই পারে—
‘সানাই বাজে, সানাই বাজে আজকে মিলন সুরে
সাত পাকে মন পড়বে বাঁধা, খুশি হৃদয় জুড়ে’।

Latest article