সম্প্রতি দুটো হইচই ‘ক্যাকটাস’কে ঘিরে, এক, কোর টিমের মেজর রদবদল আর দুই, তাদের সাম্প্রতিক গানের চাঁচাছোলা রাজনৈতিক বক্তব্য। তাই এ-দুটো দিয়েই শুরু করা যাক। দু’ক্ষেত্রেই পরিবর্তন কি অবধারিত ছিল?
সিধু : প্রশ্নের প্রথম ভাগটার জবাব প্রথমে দিই। শব্দটা ‘পরিবর্তন’ না বলে ‘বিবর্তন’ বলতে বেশি পছন্দ করব। কারণ দীর্ঘ ২৯ বছরের লম্বা একটা জার্নি। যেভাবে দর্শকের টেস্ট পাল্টাচ্ছে, মিডিয়াম পাল্টাচ্ছে, ফরম্যাট পাল্টাচ্ছে তেমনই আমাদের ভাবনাও পাল্টাচ্ছে। একটা সময় ক্ল্যাসিক রক বা সাইকেডেলিক রক বেশি গ্রহণীয় ছিল, সেখান থেকে অলটারনেটিভ রক, মেটাল রকে আগ্রহ বেড়েছে। একইভাবে ক্যাসেট-সিডি-পেন ড্রাইভ হয়ে বর্তমানে ফিজিক্যাল ফরম্যাট বলে কিছুই প্রায় নেই। এ-সবের সঙ্গে তাল মিলিয়েই এই অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন, যেটাকে বিবর্তন বলাটাই ঠিক হবে।
পটা : সিধুদা যেটা বলল সেই জেনারেল পার্টটার বাইরে গিয়ে আমি সরাসরি আমাদের দলটা নিয়েই বলছি। আর সেটা নিজেকে দিয়েই শুরু করছি। ক্যাকটাস-এর ফ্যান হিসেবে শুরু করে আমি দলের ভোকালিস্ট হয়েছি, তারপর দু’বার বেরিয়ে গেছি, তিনবার জয়েন করেছি! দলে কিছু মনোমালিন্য, মতানৈক্য থাকতেই পারে কিন্তু একই সঙ্গে দুর্দান্ত কিছু গানও আছে আমাদের যা এত বছরেও মানুষ মনে রেখেছেন। আর সেটাই আসল। সেটাই ক্যাকটাস। তাই অভ্যন্তরীণ মনোমালিন্য যা-ই হোক না কেন, যার সঙ্গেই হোক না কেন, সেটা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
আরও পড়ুন-ভবিষ্যতে সেনাপ্রধান হবেন কোনও মহিলা, আশাবাদী নারাভানে
এই এগিয়ে যাওয়াটা কী করে শুরু হল?
পটা : দ্বিতীয়বার আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর ফের দুজনে একসঙ্গে কাজ করি ‘এসো বন্ধু’তে। তারপর দু’বছর ধরে ‘এসো বন্ধু’ নামেই দুজনে একসঙ্গে পারফর্ম করেছি যখন ক্যাকটাস-এর ফ্যানেরা প্রচুর অভিমান, অনুযোগ করেছে আমাদের কাছে, ‘এসো বন্ধু’ নামে যদি করতে পার তা হলে ক্যাকটাস-এর হয়ে নয় কেন? সিধুদা এরপর একদিন প্রস্তাব দিল, যারা ‘এসো বন্ধু’ লাইন আপ-এ কাজ করছি তারা কি এটা ক্যাকটাস হিসেবে করলে কারও আপত্তি থাকতে পারে? আমরা তখন সবাই রাজি হয়ে গেলাম।
‘ক্যাকটাস’-এর ফ্যানেদের জন্য খুব ভাল খবর সন্দেহ নেই। কিন্তু কোর টিমের যে পরিবর্তন হল, তার কোনও প্রভাব কি দলের মিউজিকে পড়তে পারে?
সিধু : দেখুন একটা ব্যান্ডের মিউজিকাল স্কিল, সাউন্ড বা এক্সপ্রেশন আসলে তো তাদের ব্যান্ড মেম্বারদের সমষ্টিগত প্রয়াস। তাই ডেফিনিটলি আমাদের মতো ব্যান্ডে গিটারিস্ট পালটে গেলে তার একটা প্রভাব ব্যান্ডের সাউন্ডে পড়বেই। সেটা বাকি ইন্সট্রুমেন্টের জন্যও সত্যি। কারণ প্রত্যেক ইন্ডিভিজুয়ালের বাজানোর ধরন ভিন্ন। তাই এটা মেনে নিতেই হবে যে আমাদের সাউন্ডেও একটা চেঞ্জ আসবে।
এবার গানের কথায় আসা যাক, যেটা বলছিলাম, ‘ক্যাকটাস’-এর সাম্প্রতিকতম গান, ‘ছি ছি ছি’র মাধ্যমে সরাসরি কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছেন আপনারা। এই বাধ্যবাধকতা কেন তৈরি হল?
সিধু : পলিটিকাল স্টেটমেন্ট কিছু অবশ্যই আছে কিন্তু তা কোনও দলের হয়ে বা দলের বিরুদ্ধে নয় একেবারেই। তাই বাধ্যবাধ্যকতা যা, তা এসেছে নিজেদের ভেতর থেকে। শিল্পীদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আর এ শুধু আমাদের আশপাশে বা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, প্রতিবেশী দেশে বা সারা পৃথিবী জুড়েই সার্বিকভাবে এই অস্থিরতা, উন্মাদনা চলছে যার দ্বারা সাধারণ নাগরিকদের মনে প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। আমাদের গান সেই প্রতিক্রিয়ারই বহিঃপ্রকাশ।
পটা : আমি সরাসরি এটাকে ‘ক্ষোভ’ বলব। বাইডেন হোক বা তালিবান সরকার, কুম্ভমেলা হোক বা রাজ্যে রাজ্যে ভোট— প্রত্যেকটা সরকারি সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে। কোনওটাই জনগণের স্বার্থ ভেবে নয়। তাই যদি হত, এই প্যানডেমিক সিচুয়েশন-এ সবার আগে শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সি জনগণকে ভ্যাক্সিনেট করার প্রকল্প নেওয়া হত, নানাবিধ বিনোদনের রাস্তা খুলে দেওয়ার আগে শিক্ষাক্ষেত্র খোলার কথা ভাবা হত। কিন্তু তা কি হল? সাধারণ মানুষের মনে এরকম অনেক ক্ষোভ জমা হয়ে আছে। আমরা সে-সবগুলোর জন্যই ‘ছি ছি’ বলে উঠেছি।
‘ছি ছি ছি’র ফিডব্যাক কেমন?
পটা : ১৭ বছর পর আমি আর সিধুদা ‘ক্যাকটাস’-এর জন্য একসঙ্গে কোনও গান রেকর্ড করলাম। আমাদের নিজেদের কাছেই এটা দারুণ অনুভূতি। আর ‘ছি ছি ছি’-র মাধ্যমে আমরা আমাদের শ্রোতা ও যারা গান-বাজনার সঙ্গে যুক্ত তাদের সঙ্গে একটু অন্যভাবেও যোগাযোগ করছি। একটা মিউজিক্যাল জার্নি বলা যায় এটাকে। ইন্সট্রুমেন্ট প্লেয়ার হোক বা ভোকালিস্ট, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তারা নিজেদের মতো করে ‘ছি ছি ছি’-র ট্র্যাক তৈরি করে বা গেয়ে পাঠাতে পারে। বেস্ট অফ ফাইভকে বেছে আমরা তাদের প্রজেক্ট করব আগামী দিনে।
সিধু : এর সঙ্গে ‘কেন যে সব মেনে নিচ্ছি’ লেখা টি-শার্ট তৈরি করা হয়েছে যেটাও বেশ ভালই বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে গান ও ট্র্যাকের এন্ট্রিও এসেছে বেশ কিছু, সব মিলিয়ে রেসপন্স ভালই। ভাললাগা আরও সবটা গানের কারণেই বলে।
এখন কি মনে হচ্ছে না, মাঝের বিচ্ছেদটা অকারণ সময় নষ্ট?
সিধু : সময় নষ্ট খানিকটা তো বটেই। তবে তা অকারণ ছিল না। কিছু ডেফিনিট কারণ অবশ্যই ছিল।
পটা : হ্যাঁ। ব্যান্ডের ভারসাম্যটা খুব বাধাপ্রাপ্ত হত। একটা একপেশে চাপিয়ে দেওয়া মনোভাব, একটা ডমিন্যান্স কারও মধ্যে থাকত যেটা মিউজিক সম্পর্কিত যতটা তার চেয়েও বেশি ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত। বারবার ভুল বোঝাবুঝির মতো পরিবেশ পারপাসলি তৈরি করা হত।
কে করত?
পটা : তার নাম বলে তাকে কোনও বাড়তি মাইলেজ আর দিতে চাই না। তবে এটা বলতে পারি আমার আর সিধুদার মধ্যেও ইচ্ছাকৃত ঝামেলা লাগানোর একটা সূক্ষ্ম খেলা চলত।
আপনারা সেটা বুঝতে পারতেন না!
সিধু : পটা পেরেছিল অনেক আগেই, তাই ও কম্প্রোমাইজ করেনি সব সময়। আমার বুঝতে বা বিশ্বাস করতে সময় লেগেছিল। তা ছাড়া ‘ক্যাকটাস’ চরম দুর্বল জায়গা আমার। এর জন্য সব ছেড়েছি। তাই শেষ অবধি চেষ্টা করেছি মানিয়ে নিতে। কিন্তু একটা সময়ে মনে হল এবার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
পটা : আরও একটা কথা প্রসঙ্গক্রমে জানাই, একসঙ্গে কাজ না করলেও যেটা ঠিক ‘বিচ্ছেদ’ বলে, তা কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে হয়নি। মিউজিক্যাল যোগাযোগটা থেকেই গিয়েছিল। দুজনেই নতুন কিছু করলে বা বানালে সবার আগে দুজনের কাছেই শেয়ার করতাম, পরামর্শ নিতাম! পরস্পরের বাড়িতে আড্ডাও মারতাম রেগুলার। তাই ২০১৮-এর সেপ্টেম্বরে সৃজিত মুখার্জি যেদিন দুজনকে একসঙ্গে কাজ করতে ডাকল, কোনও অসুবিধে হয়নি কারওই!
আরও পড়ুন-রাঁচি থেকে কেশবের বার্তা, তিন স্পিনারে যাও বিরাট
তা হলে জামরুল গাছ, হলুদ পাখি, বুড়ো মাঝি, যুবরাজের ঘোড়া সমেত সোনালি দিন ফিরে এসেছে? ‘ফিরবে না সেকি ফিরবে না’র দ্বিধা আর নেই?
সিধু : আশা করছি তাই। সময়ের সঙ্গে বয়স যেমন বাড়ে, অভিজ্ঞতা ও সহনশীলতাও তো বাড়ে। আর এই কোভিড কালে মিউজিক বাঁচিয়ে রাখার লড়াইটা এত কঠিন এখন, অনাবশ্যক বিষয়গুলো জীবন থেকে বাদ দেওয়াটাই বিবেচনার কাজ। আমরা তাই সর্বতোভাবে চাই, শুধু ক্যাকটাস নয়, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সোনালি দিনও ফিরে আসুক ফের।