আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে রাত কেটেছে কত, তাইতো তাঁরা উদ্ধার করেছেন ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময় যত! ওঁরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী, রাতের পর রাত জেগে ওই মহাশূন্যের কত অজানা তথ্য ও তত্ত্বের উদ্ঘাটন করেন। এ যেন ইউরেকা!
আরও পড়ুন-আতশবাজি বিক্রেতাদের স্বার্থরক্ষায় পদক্ষেপ রাজ্যের
নক্ষত্রনির্ঝর
তারায় ভরা আকাশ, বিশ্বভরা প্রাণ, আর বিস্ময়ে ভরা ব্রহ্মাণ্ড! — এই নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে কত জল্পনা, কল্পনা ও কসরত। নিরন্তর চলছে খোঁজ। এভাবেই রাতের আকাশে দেখা মিলেছে ‘কেম্বলস্ ক্যাসকেড অব স্টারস’ বা কেম্বলের নক্ষত্রনির্ঝর!
কী এই নক্ষত্রনির্ঝর : আকাশের বুকে একদল নক্ষত্র একটি নির্দিষ্ট আকৃতি বা সজ্জার জন্ম দেয়। সুসংহত সজ্জার চিহ্নিত রূপকে নক্ষত্রপুঞ্জ বলা হয়ে থাকে। সাল ১৬১২ কিংবা ১৬১৩, বেলজিয়ান-ডাচ জ্যোতির্বিজ্ঞানী পেট্রুস প্লান্সিয়াস প্রথম নক্ষত্রপুঞ্জের ধারণা দেন। মহাকাশে আনুমানিক প্রায় অষ্টআশিটি এই রকম সুসংহত নক্ষত্রপুঞ্জ বা কনস্টেলেশন রয়েছে। তাদের মধ্যে একটি হল ‘কনস্টেলেশন ক্যামেলোপার্ডালিস’ যা কেম্বলস্ ক্যাসকেড অব স্টারস বা কেম্বলের নক্ষত্রনির্ঝর হিসেবে পরিচিত।
আরও পড়ুন-কোর্ট থামিয়ে দিল বিজেপির বুলডোজার
নির্দিষ্ট নক্ষত্রপুঞ্জ : কনস্টেলেশন ক্যামেলোপার্ডালিস হল উত্তর আকাশের একটি দীর্ঘ কিন্তু আবছা নক্ষত্রপুঞ্জ যা অনেকটাই জিরাফের মতো দেখতে। এই নক্ষত্রপুঞ্জটি প্রায় কুড়িটিরও বেশি তারার সমন্বয়ে গঠিত, যার মধ্যে পঞ্চম ও দশম ঔজ্জ্বল্য-মাত্রার নক্ষত্রও রয়েছে। তিন ডিগ্রি কোণে লেহিত প্রায় সরলরৈখিক এই নক্ষত্রপুঞ্জটি ক্রমশ এনজিসি ১৫০২ মুক্ত তারাগুচ্ছের দিকে ভেসে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ রুখল নিরাপত্তা বাহিনী
আবির্ভাব ও অবদান : বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী লুসিয়ান কেম্বল তাঁর সুপুত্র বিশিষ্ট আমেরিকান জনবিজ্ঞান লেখক ওয়াল্টার স্কট হাউস্টনকে এ-বিষয়ে চিঠি লেখেন। চিঠিতে জানান যে, একটি ৭ x×৩৫ বাইনোকুলারের সাহায্যে রাতের আকাশে তিনি ওই নক্ষত্রপুঞ্জটিকে চিহ্নিত করেছিলেন। এরপর ১৯৮০ সালে মিঃ হাউস্টন এই বিষয়টি গোটা বিশ্বের সম্মুখে তুলে ধরেন। তিনিই তাঁর পিতার সম্মানে এই নক্ষত্রপুঞ্জটির নামকরণ করেছেন ‘কেম্বলস্ ক্যাসকেড অব স্টারস’ বা কেম্বলের নক্ষত্রনির্ঝর! এ-কথা অবশ্যই সত্য যে, নক্ষত্রবাদের ইতিহাসে এর অবদান অনস্বীকার্য।
আশ্চর্য আয়াপেটাস : একটি উপগ্রহ নাকি আখরোটের মতো দেখতে— হম্! ভাবা যায়! শনি গ্রহের বহু সংখ্যক উপগ্রহের মধ্যে সাতটি উপগ্রহ খুবই উজ্জ্বল এবং পৃথিবীর বুক থেকে তাদের দূরবীক্ষণ মারফত দেখা সম্ভব। সেগুলো হল টাইটান, রিয়াহ, টেথিস, ডাইওন, এনসেলাডাস, আয়াপেটাস ও মিমাস। এদের মধ্যে আয়াপেটাস বড়ই অদ্ভুত ধরনের পৃষ্ঠতলযুক্ত!
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
বিচিত্র লক্ষণ : প্রদত্ত বৈশিষ্ট্যযুক্ত উপগ্রহ-চিত্রটির নিচের দিকে দৃশ্যমান বিষুবরেখাকে ঘিরে থাকা একটি অদ্ভুত শৈলশিরা উপগ্রহটিকে মুখরোচক ভোজ্য বাদামের মতো দেখায়। আশ্চর্য এই শৈলশিরাটির উৎসের কারণ আজও অজানা রয়ে গেছে। যদিও অনুমান করা হয় যে, প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর আগে বলয়াকারে বরফ-শৈল নিচ থেকে উপরে ওঠার সময় বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং সম্ভবত সেই দুর্ঘটনার পর ওই অদ্ভুত বলয়টি অবশিষ্ট কাঠামো হিসেবে রয়ে গেছে। এ ছাড়াও আশ্চর্যজনক যে প্রায় অর্ধেক আয়াপেটাস এতটাই অন্ধকার যে এটি পৃথিবী থেকে দেখতে গেলে প্রায় অদৃশ্য মনে হতে পারে, বাকি অংশ প্রতিফলিতভাবে বেশ উজ্জ্বল। পর্যবেক্ষণগুলি দেখায় ভূখণ্ডের অন্ধকারের মাত্রা অদ্ভুতভাবে অভিন্ন, যেন একটি অন্ধকার আবরণ সম্প্রতি একটি প্রাচীন এবং অত্যন্ত এবড়ো-খেবড়ো ভূমিপৃষ্ঠে প্রয়োগ করা হয়েছিল। সবশেষে, আয়াপেটাসের চারপাশে বেশ কয়েকটি বিস্তৃত অববাহিকা দেখা যায়। চিত্রে পরিদৃষ্ট কেন্দ্রের কাছে একটি ৪০০ কিলোমিটার প্রশস্ত গর্ত দৃশ্যমান, গভীর ও খাড়া বাঁধ দ্বারা বেষ্টিত যা তীক্ষ্ণভাবে গর্তের মেঝেতে নেমে আসে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছবিটি ২০০৪ সালের শেষের দিকে আয়াপেটাসের একটি গমন চলাকালীন শনি-প্রদক্ষিণকারী ক্যাসিনি মহাকাশযান দ্বারা তোলা হয়েছিল।
আরও পড়ুন-আমেরিকা থেকে অভিষেকের ট্যুইট, এজেন্সি–অফিসারদের অযোগ্য বলে তোপ
আবিষ্কার : আয়াপেটাস হল শনিগ্রহের তৃতীয় বৃহত্তম ও পুরো সৌরজগতের ১১তম বৃহত্তম উপগ্রহ : যার মোটামুটিভাবে সবটাই বরফে ঢাকা। এই উপগ্রহটি ১৬৭১ সালের ২৫ অক্টোবর ইটালিয়ান-ফরাসি গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ জিওভানি ডোমেনিকো ক্যাসিনি আবিষ্কার করেন। তবে এই উপগ্রহের নামকরণ করেন ইংরেজ গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ স্যার জন ফ্রেডেরিক উইলিয়াম হার্সেল; ১৮৪৭ সালে উত্তমাশা অন্তরীপের উপর জ্যোতির্বিজ্ঞান সমন্ধীয় পর্যবেক্ষণের গবেষণা পত্রে।
ইউরেকা ইউরোপা
হম্— পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের চেয়ে আকারে একটু ছোটই বটে, প্রায় সাদা রঙের পৃষ্ঠতল, সিলিকেট পাথরের তৈরি; তবে নিকেল ও লোহার মজ্জা উপস্থিত; গোটা সৌরজগতের মধ্যে ষষ্ঠ বৃহত্তম বৃহস্পতির এই উপগ্রহ: ইউরোপা। এর পৃষ্ঠতল সবচেয়ে বেশি মসৃণ, একে আবার বৃহস্পতি-২-ও বলা হয়ে থাকে। প্রদত্ত সুন্দর ছবিটি সম্প্রতি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জুনো মহাকাশযান ইউরোপার খুব কাছে থেকে তুলেছে।
আরও পড়ুন-রাজ্যে নয়া শিক্ষানীতি বাংলা শিক্ষায় জোর
আবিষ্কার : সাল ১৬১০, ইতালীয় জ্যোতির্বিদ ও পদার্থবিদ গ্যালিলিও ডি ভিনসেঞ্জো বোনাউটি ডে গ্যালিলেই বৃহস্পতি গ্রহের চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেন; যথা— আই ও, ইউরোপা, গ্যানিমেডে এবং ক্যালিস্টো। এদের মধ্যে ইউরোপা বিচিত্র! ওই সালের ৮ জানুয়ারি গ্যালিলিওর সাথে সাথেই এককভাবে জার্মানির জ্যোতির্বিদ সাইমন মারিয়াসও ইউরোপাকে আবিষ্কার করেন। এই উপগ্রহটির নামকরণ ক্রেট দেশের রাজা মিনোসের ফিনিসীয় মা ও গ্রিকদেব জিউসের প্রেমিকার নামানুসারে হয়েছে ইউরোপা।
আরও পড়ুন-অশান্ত মণিপুরে তিন মাসে নিখোঁজ অন্তত ৩০, হদিশ দিতে ব্যর্থ পুলিশ
আচরণ ও অবদান : সাল ১৯৯০-এর শেষের দিক, তখনকার বৃহত্তর গ্রহের সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্রাণু সৌরজগতের ন্যায় জোভিয়ান উপগ্রহ-পদ্ধতির পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে, গ্যালিলিও মহাকাশযান বৃহস্পতির ইউরোপা উপগ্রহের আকর্ষণীয় ছবি সংগ্রহ করে এবং তার বিচিত্র উপগ্রহ-পৃষ্ঠের রহস্য উন্মোচন করেন। জানা যায়, বরফের পৃষ্ঠ সম্ভবত একটি গভীর বিশ্বজনীন মহাসাগরকে লুকিয়ে রাখে। গ্যালিলিওর ইউরোপার দীর্ঘ পৃষ্ঠে বক্র ভগ্নাংশগুলি উপপৃষ্ঠের তরল জলের দিকে ইঙ্গিত করে। বৃহস্পতির চারপাশে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘটিত জোয়ারের টান, যা ইউরোপা তার উপবৃত্তাকার কক্ষপথে অনুভব করে, মনে করা হয় সমুদ্রকে তরল রাখতে ওই টানই শক্তি সরবরাহ করে। তবে আরও উত্তেজনাকর সম্ভাবনা এই যে, এমনকী সূর্যালোকের অনুপস্থিতিতেও এই প্রক্রিয়াটি প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শক্তি সরবরাহ করতে পারে, যা ইউরোপাকে পৃথিবীর বাইরে জীবন-সন্ধানের সেরা জায়গাগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে। গভীর, অন্ধকার, ভূপৃষ্ঠের সাগরে কী ধরনের জীবন বিকশিত হতে পারে? — তাই নিয়েই যত জল্পনা-কল্পনা বিজ্ঞানীমহলে।