বাংলার মান বাঙালির সম্মান…

গত বিধানসভা ভোটের চেয়েও শোচনীয় ফল হবে বিজেপির। এই একটা ব্যাপারে নিশ্চিত— বাংলার কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার, নিঃসন্দেহ কাঁথিও। বাংলার ও বাঙালির মানসম্মান রক্ষার দায়িত্ব এখন আপামর রাজ্যবাসীর। লিখছেন আকসা আসিফ

Must read

অতীতে কখনও এমনটা ঘটেনি। আগামী দিনে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক, চায় না কেউ, অন্তত এরাজ্যে (West Bengal) বসবাসকারী কোনও ব্যক্তি। অথচ ঘটনাটা ঘটছে। অনাকাঙ্ক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও ঘটছে।
গত লোকসভা নির্বাচনে ১১০টিরও বেশি কেন্দ্রকে আর্থিকভাবে স্পর্শকাতর হিসেবে চিহ্নিত করে কমিশন। শীর্ষে ছিল তামিলনাড়ু, গুজরাত ও তেলেঙ্গানা। ৩ রাজ্যের সব ক’টি কেন্দ্র ছাড়াও অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, বিহার, উত্তরাখণ্ডের ৭০ শতাংশ কেন্দ্রকে আর্থিকভাবে স্পর্শকাতর ঘোষণা করে আয়কর দপ্তর এবং আয়-ব্যয় পর্যবেক্ষকদের সতর্ক করেছিল কমিশন। আর এবার, সূত্রের খবর, সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গও (West Bengal)। সৌজন্যে ভারতীয় জঞ্জাল পার্টি।
২০১৯ লোকসভা ভোটে টাকা ছড়ানোর যত অভিযোগ কমিশনে জমা পড়েছিল, তার সিংহভাগই ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। আর এবার, সেসব অভিযোগের ভিত্তিতে কমিশন বাংলাকে এক্সপেন্ডিচার সেনসিটিভ বা আর্থিকভাবে স্পর্শকাতর রাজ্য হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্রিয়।
কেন? কারণ বুঝতে গেলে গত লোকসভার নানা ঘটনার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে।
গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে টাকা ছড়ানোর অভিযোগে সরব হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস-সহ বিজেপি-বিরোধীরা। সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ২৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিজেপি একাই। সেই প্রথম এ-রাজ্যেও ভোট কিনতে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ ওঠে বিজেপির বিরুদ্ধে। ঘাটালের বিজেপি প্রার্থী ভারতী ঘোষের গাড়ি থেকে ১ লক্ষ ১৩ হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত হয়। হাওড়া ও উত্তরবঙ্গে একাধিক আসনে বিরোধী দলের এজেন্টদের টাকা দিয়ে কিনে নেওয়ার অভিযোগও ওঠে বিজেপির বিরুদ্ধে। সেসব জমা পড়েছিল কমিশনের দপ্তরে। ভোটের সময় টাকা ছড়ানো হয়েছে, এবং সেটা করেছে বিজেপি। আর তার জেরেই এবার আর্থিক সংবেদনশীলতার তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা।
গত লোকসভা নির্বাচনে ১১০টিরও বেশি কেন্দ্রকে আর্থিকভাবে স্পর্শকাতর হিসেবে চিহ্নিত করে কমিশন। শীর্ষে ছিল তামিলনাড়ু, গুজরাত ও তেলেঙ্গানা। ৩ রাজ্যের সব ক’টি কেন্দ্র ছাড়াও অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, বিহার, উত্তরাখণ্ডের ৭০ শতাংশ কেন্দ্রকে আর্থিকভাবে স্পর্শকাতর ঘোষণা করে আয়কর দপ্তর এবং আয়-ব্যয় পর্যবেক্ষকদের সতর্ক করেছিল কমিশন। উল্লেখযোগ্য হল, এই তালিকায় বাংলার কোনও কেন্দ্র ছিল না। এবার ছবিটা অন্যরকম।

আরও পড়ুন- ভারতীয় ফাইটার জেটে ডিজিটাল ম্যাপ

এর মধ্যেই অন্য রকম বদমায়েশি চলছে। বাংলাকে বঞ্চিত করার বন্দোবস্ত। জিএসটির নামে এখান থেকে সব টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র। অথচ ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা, গ্রামীণ সড়ক-সহ একাধিক খাতে ১.১৫ লক্ষ কোটি টাকা আটকে রেখে বাংলার (West Bengal) গরিব মানুষকে বঞ্চিত করে চলেছে। ছেলেবেলায় পড়া ছিল, জেরম কে জেরমের টেকনোলজি ফর ম্যানকাইন্ড। এখন বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো লিখতেন, টেকনোলজি ফর পলিটিক্স। সেই টেকনোলজি বলছে, ধর্মতলায় বিজেপির সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের ফ্লপ সভা দিয়ে শুরু। এবার এ-রাজ্যেও, ভোটের কড়া নাড়া শুরু হতেই দিল্লি থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি শুরু হল বলে।
কিন্তু অমিত শাহদের নামে কি আর কোনও আবেগ অবশিষ্ট আছে এই বঙ্গে, কিংবা ঘটা করে প্রধানমন্ত্রীকে এনে লক্ষ কণ্ঠের গীতাপাঠে? কোনও একাত্মবোধ নেই। দাঁতে দাঁত চেপে স্থির সঙ্কল্পকে সামনে রেখে অটল লড়াই নেই। এরপরও এ-রাজ্য থেকে লোকসভার ৩৫টি আসন জেতার খোয়াব আর দেখছে কি কেন্দ্রীয় বিজেপি? নিদেন পক্ষে ডাবল ফিগার ছোঁয়ার দুরাশা, মায় দশটা লোকসভা আসন জয়ের টার্গেট? বোধহয় না। অমিত শাহ নিজে কোনও সংখ্যা ধর্মতলায় উচ্চারণও করেননি। যদি সেই জোশ থাকত, তাহলে বেশ কয়েক কোটি টাকা খরচ করে পুলিস, আদালতের বাধা পেরিয়ে ধর্মতলায় মঞ্চ বেঁধে মাত্র ২৩ মিনিটের এলেবেলে ভাষণ দিয়েই দিল্লি ফেরত যেতেন না ব্যস্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অন্তত ভাষণ দেওয়ার পর নিউ টাউন কিংবা বাইপাসের ধারের পাঁচতারা অট্টালিকায় বঙ্গ বিজেপির নেতাদের সংগঠনের অসুখ সারানোর দাওয়াই দিতেন চা-চক্রের ফাঁকে। কৌশল নিয়ে চুলচেরা মতবিনিময় হতো। কিন্তু সেসব কিছুই করলেন না। উল্টে যেখানে বেলা ৩টে পর্যন্ত তাঁর মঞ্চে থাকার কথা, সেখানে বেলা ২টো ৭ মিনিট নাগাদ স্টেজে উঠেই আড়াইটের মধ্যেই বক্তব্য শেষ করলেন তিনি! কারণ মঞ্চের উপর, মঞ্চের নীচে এবং উপস্থিত বঙ্গ বিজেপির নেতানেত্রীদের রঙ্গ মধ্যে নিহিত বিষগন্ধ তিনি বিলক্ষণ পেয়েছেন। দিশেহারা কর্মীদের মধ্যে ‘দেখে নেওয়ার মানসিকতা’র অভাব থেকেই আঁচ করেছেন, একুশের বিধানসভার চেয়েও বড় ভরাডুবি অপেক্ষা করছে পশ্চিমবঙ্গে। ‘উখারকে ফেক দেঙ্গে’ বলেছেন বটে কয়েকবার, কিন্তু লোহা তো গরমই হল না। বহুল ব্যবহারে বড্ড ক্লিশে শোনাল পুরনো হিন্দি বাক্যবন্ধটি! লোকসমাগম, সভার ঝাঁজ এবং আবেগ কিছুই পায়নি পদ্ম পক্ষের লোকজন। হিসেব বলছে, একুশ সালের শুধু ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে এ-রাজ্যে (West Bengal) ৩৮টি জনসভা করেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। এর মধ্যে আমাদের সম্মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন ১৭টি সভা আর দলের দ্বিতীয় সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী নেতা অমিত শাহ করেন ২১টি। তারপর বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির পর থেকে রাজ্যের সাধারণ কর্মীদের দুর্দশার কালে কতবার ঘুরে গিয়েছেন শাহজি? বিপন্নতার সময় দিল্লি থেকে আর কেউই আসেনি। কলকাতার বুকে ক’টা সভা করেছেন। দলীয় কর্মীদের ক’দিন উৎসাহ দিয়েছেন। রেকর্ডটা কিন্তু মোটেই সুখকর নয়। উল্টে বেশ কয়েকবার আসব আসব বলেও শেষ মুহূর্তে অজ্ঞাত কারণে তাঁর বঙ্গ সফর বাতিল হয়ে যায়। ২৯ নভেম্বর ধর্মতলার সভার আগে অমিতজি এসেছিলেন ১৬ অক্টোবর। এক দলীয় নেতার দুর্গাপুজোর উদ্বোধনে। রামমন্দিরের আদলে প্যান্ডেলের ফিতে কাটতে। কোনও সাংগঠনিক বৈঠকে নয়। এমনকী, তার আগে ইস্টার্ন জোনাল কাউন্সিলের বৈঠকে তাঁর আসার কথা থাকলেও তা শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়। অবশ্য দলের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তা নিয়েও তেমন কোনও সাড়া পড়েনি জনমানসে।

আসলে বাঙালির হৃদ্‌স্পন্দনের সঙ্গে অমিত শাহদের কোনও যোগ নেই। যেই বিজেপি আঙুল তোলে দুর্নীতির ইস্যুতে সঙ্গে সঙ্গে দলেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে এক দলবদলুকে ‘মুখ’ করা হল কেন? তিনি তো তৃণমূল কংগ্রেসেরই প্রোডাক্ট। তাঁকেও তো ক্যামেরার সামনে হাত পেতে টাকা নিতে দেখা গিয়েছে, জেরা হয়নি কেন? তিনি তো নারদ কাণ্ডে এফআইআর নেম। তাঁকে ছেড়ে রাখা হয়েছে কেন?
সুতরাং, বেশ বোঝা যাচ্ছে, গত বিধানসভা ভোটের চেয়েও শোচনীয় ফল হবে বিজেপির। এই একটা ব্যাপারে নিশ্চিত— বাংলার কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার, নিঃসন্দেহ কাঁথিও।
বাংলার মান, বাঙালির সম্মান রক্ষার দায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন লাখ লাখ বাঙালি। বিজেপি আর তাঁদের ভুল বোঝাতে পারবে না।

Latest article