১৭ এপ্রিল। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি নরসিমার ১ নম্বর এজলাসে শুনানি চলছে এক অস্বাভাবিক মামলার। বরিষ্ঠ আইনজীবী বলছেন, ধর্মাবতার, আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে যে মামলায় হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের আদেশ দিয়েছে, সেই মামলায় আমার মক্কেল পক্ষভুক্ত বা কোনওভাবে জড়িত নয়। তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও কোনও সুযোগ দেওয়া হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট ওইদিনই সিবিআই তদন্তের আদেশে স্থগিতাদেশ দেন।
আরও পড়ুন-বিজেপির ডাক উপেক্ষিত, অভিষেকের জনসংযোগে জনতার ঢল
এরপর ২৪ এপ্রিল। সিনিয়র কৌঁসুলি মনু অভিষেক সিংভি আদালতে সওয়াল করলেন। তাঁর মক্কেল, তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অপরাধ— ২৯ মার্চ এক জনসভায় তিনি অভিযোগ করেন, স্কুল-নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় ধৃত অভিযুক্তদের সিবিআই ও ইডি চাপ দিচ্ছে অভিষেকই তাদের মাথা, একথা বলতে। তারপরে হাইকোর্ট একতরফাভাবে অভিষেকের বিরুদ্ধে কার্যত তদন্তের নির্দেশ দেয়। অনতিবিলম্বে বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতের গোচরে আনা হলে স্থগিতাদেশ জারি হয়। পিটিশনে উল্লেখ করা হয়, সংশ্লিষ্ট বিচারপতি নাকি এরপর ভরা এজলাসে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের জজ হলেই কি যা খুশি করা যায়? এ কি জমিদারি নাকি?’ অবশ্য তিনি পরে বলেন তাঁর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। খবরে প্রকাশ, গতবছর মার্চ মাসে একই বিচারপতি নাকি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ করেন, ডিভিশন বেঞ্চ বারবার তাঁর আদেশে স্থগিতাদেশ দেওয়ায় তাঁর ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে। এসব কিছুই আদালতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাই কোনও মন্তব্য নয়। তবে ইতিপূর্বে এমন খবরও চোখে পড়েছে, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টকে অমান্য করায় হাইকোর্টের এক বিচারপতিকেও জেলে যেতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্টকে কটাক্ষ করে পরের বিচারপতিকে পরিহাস
সিংভি সুপ্রিম কোর্টকে জানালেন, সংশ্লিষ্ট বিচারপতি তাঁরই আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিনা কারণে আমার মক্কেল অভিষেকের বিরুদ্ধে অসূয়া প্রকাশ করেছেন। এইভাবে জজেরা তাঁদের কাছে বিচারাধীন বিষয়ে প্রকাশ্যে যদি মন্তব্য করেন, টিভিতে ইন্টারভিউ দেন তাহলে তা স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। কারণ, এর ফলে সহজেই বোঝা যায় জজসাহেব কী ধরনের রায় দিতে চলেছেন। অথচ, না তদন্ত শেষ হয়েছে। না সাক্ষীসাবুদ বিচার করে সংশ্লিষ্ট দায়রা আদালত (ফৌজদারি মামলার ট্রায়াল হাইকোর্টে হয় না) কোনও অভিযুক্তকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে। তাই এক্ষেত্রে মনে হতে পারে, সিবিআই-ইডি, বিজেপি-সিপিএমের মতো আরও কোনও পক্ষ সিবিআই-ইডিকে অভিষেকের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে চাইছে। বিশেষত যখন অভিষেকের বিরুদ্ধে কোনও আপাতগ্রাহ্য অভিযোগ কেউ তোলেনি। মামলা হওয়া তো দূরের কথা। তাহলে মামলায় নাম না থাকা বা পক্ষভুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও তদন্তের নির্দেশ কেন? কেনই বা টিভি সাক্ষাৎকারে অভিষেকের বিরুদ্ধে অকারণ হুমকি? এই মোক্ষম প্রশ্নগুলির সদুত্তর সুপ্রিম কোর্টে কেউ দিতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্টও তাই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নির্দেশ দিলেন, যে-এজলাসে এই মামলা চলছে সেখান থেকে মামলা অন্য এজলাসে সরিয়ে নিয়ে যেতে।
আরও পড়ুন-সত্যপালের বাড়িতে সিবিআই
এতদিন অনেক কিছু বলা হয়েছিল। যেমন, ‘ব্যাঙ্গালোর প্রিন্সিপলস অফ জুডিশিয়াল কন্ডাক্ট’ (২০০২) বা ব্যাঙ্গালোর প্রোটোকল। বিচারকদেরও বাক্স্বাধীনতা আছে। নিশ্চয়ই আছে। সংবিধানস্বীকৃত এটি সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার। তবে এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধও আরোপ করা যায়। কিন্তু ওই প্রোটোকলের ২.৪ নং নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ‘কোনও বিচারপতির কাছে কোনও মামলা বিচারাধীন আছে বা বিচারাধীন হতে চলেছে, সেই মামলার বিষয়ে ওই বিচারপতি জ্ঞানত এমন কোনও মন্তব্য করবেন না যা ওই মামলাকে প্রভাবিত করতে পারে।’ তারও আগে সুপ্রিম কোর্টের চার্টার-‘রিস্টেটমেন্ট অফ ভ্যালুজ অফ জুডিশিয়াল লাইফ’ (১৯৯৭)-এ উল্লেখ করা হয়— ‘একজন বিচারপতি যা বলতে চান তা যেন তাঁর রায়েই বলা হয়। তিনি যেন সংবাদমাধ্যমকে কোনও সাক্ষাৎকার না দেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সুপ্রিম কোর্টের এই চার্টারকে অগ্রাহ্য করে সর্বোচ্চ আদালতেরই কয়েকজন বিচারপতি বছরকয়েক আগে সাংবাদিক সম্মেলন করে ওই আদালতের কিছু বিষয় নিয়ে বিষোদ্গার করলেন। সেইসময় ওই আদালতেরই পরবর্তী প্রধান বিচারপতি আক্ষেপ করে বললেন, ‘আশা করি এমনটি আর কখনও কেউ করবেন না।’ সবাই কি তা মানছেন? আজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সময়োপযোগী আদেশের পরে এই প্রশ্নটিই নতুন করে উঠে এসেছে।