দেবাশিস পাঠক: সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বঙ্গ রাজনীতির এক বর্ণময় চরিত্র। কর্ম কৃতিত্বে এবং রাজনৈতিক দক্ষতায় জনমানসে চিরভাস্বর এক ব্যক্তিত্ব। গত বছর কালীপুজোর রাতে অর্থাৎ ৪ নভেম্বর, ২০২১-এ এই ব্যক্তিময় মানুষটি প্রয়াত হয়েছেন।
স্মৃতির অ্যালবাম উল্টে সেই চলে যাওয়া মানুষটির ফেলে আসা কয়েকটি ছবি।
ছবি নং ১। নকশাল আমল। মেদিনীপুর তখন লাল দুর্গ। কলেজে কলেজে সিপিএম-এর ছাত্র সংগঠন এসএফআই আর নকশালপন্থী উগ্র বামেদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছে কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদ। ছাত্র নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় মেদিনীপুরের লাল দুর্গে গেলেন বামপন্থী ছাত্রদের হাতে বেদম মার খাওয়া জাতীয়তাবাদী ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়াতে, তাদের উৎসাহিত করতে। জিপের সিটে বসে আছেন। পেছন থেকে ছুরি বসিয়ে দেওয়া হল ওঁর পিঠে। রক্তাক্ত আক্রান্ত সুব্রতকে মেদিনীপুর থেকে জিপে বসিয়ে আর জি কর হাসপাতালে আনেন তাঁর সহকর্মীরা। কলকাতার হাসপাতালে পিঠ থেকে ছুরি বের করা হয়। ডাক্তার জানান, আর একটু এদিক ওদিক হলে বাঁচানো যেত না সুব্রতকে।
আরও পড়ুন-পদকের আড়ালে
ছবি নং ২। জ্যোতি বসুর আমল। কলকাতায় চলচ্চিত্র উৎসব চলছে। টলিউডের শিল্পীদের অপমান করল বাম সরকার। প্রতিবাদে আন্দোলনে নামলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। পুলিশ গ্রেফতার করল। সেদিন রাত কাটল লালবাজারে। পরদিন সকালে নয়, একেবারে বিকেলবেলায় ছাড়া পেলেন সুব্রত। মুক্তি পাওয়ার পর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয়। চিনা খাবার খাচ্ছেন। অন্য টেবিলে দেখতে পেলেন সপরিবারে জ্যোতি বসু। খানিকক্ষণ বাদে জ্যোতি বসুর ছেলে চন্দন উঠে এলেন। জানালেন, সুব্রতদের বিল জ্যোতিবাবুই পেমেন্ট করবেন। সুব্রতর কঠাক্ষ, দুপুরে তো ওঁর দেওয়া খাবারই লালবাজারের কয়েদখানায় খেয়েছি। নৈশভোজের খরচটা আর ওঁকে বহন করতে হবে না। চন্দন জ্যোতিবাবুকে জানালেন সে কথা। জ্যোতি বসু সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে নিজের টেবিলে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, দুপুরে খেয়েছেন তো কী হয়েছে, রাতেরটাও আজ আমি দেব।
আরও পড়ুন-বদলে যাক এতদিনের চেনা ছবি
ছবি নং ৩। মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিয়ে। বউভাতের অনুষ্ঠান বালিগঞ্জের জুসলা হাউসে। সকালে আনন্দবাজার পত্রিকায় চণ্ডী লাহিড়ীর কার্টুন। পশ্চিমবঙ্গের হোম মিনিস্টার নব পরিণীতা বধূর হাতে অ্যারেস্ট হচ্ছেন। সন্ধেতে বউভাতে অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব নিজস্কন্ধে তুলে নিয়েছেন স্বয়ং প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। বউভাতের কার্ড আঁকা থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানস্থল সাজানো পর্যন্ত যাবতীয় শিল্পকর্ম সম্পাদনের দায়িত্ব শিল্পী শুভাপ্রসন্নর। খাবার-দাবারের আয়োজনে বসুশ্রী সিনেমার মালিক স্বনামধন্য মন্টু বসু ও রেশন দোকানের মালিক জীবন মোদক। কলকাতায় আসার পর এই জীবন মোদকের বাড়িই ছিল সুব্রতর ঠিকানা। সেই জমকালো বউভাতে নক্ষত্র সমাবেশ। পায়ে ভীষণ চোট। হাঁটতে পারছেন না ঠিকমতো। তবুও ক্রাচে ভর দিয়ে এসেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এবং সেই চাঁদের হাটে স্বয়ং চন্দ্রের উদয়। এসেছিলেন উত্তম কুমার।
বেশ কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তাঁকে ঘিরে এমন হইচই শুরু হল যে বউভাতের অনুষ্ঠান পণ্ড হওয়ার উপক্রম। ফলে তাঁকে চলে যেতে হল খানিক পরেই। পরে একদিন ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে সস্ত্রীক সুব্রতকে নিমন্ত্রণ করলেন মহানায়ক। সেদিন সুব্রতদের কোনও রেস্তোরাঁয় খাবার খাওয়ানো হয়নি। সবক’টি পদ নিজে হাতে রেঁধেছিলেন স্বয়ং সুপ্রিয়া দেবী।
আরও পড়ুন-ক্রীড়াবিদদের কলমে জাতীয় ক্রীড়াদিবস
ছবি নং ৪। বামফ্রন্ট জমানা। বিধানসভায় প্রহৃত হলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বামফ্রন্টের বিধায়কদের হাতে। দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধী তখন মন্ত্রিপরিষদের জরুরি বৈঠকে ব্যস্ত। সেখানেই খবর পেলেন, সুব্রত মার খেয়েছেন। মার খেয়েছেন, কথাটা শুনে তাঁর মনে হল, সুব্রত মারা গিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ফোন। ফোনে হুমকি, সুব্রতর কিছু হলে আমি সরকার ফেলে দিতে দ্বিধা করব না। জ্যোতিবাবু বুঝিয়ে উঠতে পারলেন না আসল ঘটনাটা। শেষে স্বয়ং সুব্রতকে ফোনে ধরিয়ে দিয়ে সে যাত্রায় নিস্তার পেলেন।
ছবি নং ৫। হেলিকপ্টারে একটাই আসন। অথচ সেখানেই নিজে ওঠার সময় সুব্রতকে তুলে নিয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি যাচ্ছেন মালদহে গনি খান চৌধুরির হয়ে প্রচার করতে। আকাশপথে যাত্রাকালে নিচে যত নদী দেখতে পাচ্ছেন ইন্দিরা বিশদে সেই নদীর বিষয়ে জানতে চাইছেন। নদীর নাম, সেটির উৎস ও মোহানা, এসব তো আছেই, সেই সঙ্গে বর্ষাকালে সে নদীতে জল কেমন হয়, বন্যা হয় কি না ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা নেই। ফলে নিজের মতো করে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা সুব্রতর। সেই সঙ্গে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার, উত্তর দিতে দিতে নাজেহাল হয়ে হেলিকপ্টার চালকের উদ্দেশ্যে তাঁর কথা, আরে! এত নদীর ওপর দিয়ে যাওয়ার কী আছে, ট্রেন লাইনের ওপর দিয়ে যেতে পারছ না। তাহলে তো আমি ঠিকঠাক তথ্য ওঁকে দিতে পারি।
আরও পড়ুন-সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করে এ কী অবস্থান ! সিপিএম নেতাদের নামে মামলা
এমন সব অজানা কিংবা প্রায় না-জানা তথ্যের সমাবেশ। স্মৃতির প্রকোষ্ঠ থেকে সে পিয়া রঙের সেই সব ছবি একটা একটা করে ‘কাছের মানুষ সুব্রত’ বইয়ের পাতায় পাতায় সাঁটিয়েছেন লেখিকা। ঋজু ভারমুক্ত গদ্য ভাষায় এই রোমন্থন জলের মতো ঘুরে ঘুরে চলে যাওয়া এক জীবনের কথা বলেছে। আকর্ষণের মাত্রায় অনন্য এই বইয়ের লেখিকাও যে অনন্যা। ছন্দবাণী মুখোপাধ্যায়। ব্যক্তি পরিচয়ে যিনি সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী।
কাছের মানুষ সুব্রতর কথা তিনিই লিখেছেন যিনি মানুষ সুব্রতকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন।