গঙ্গাসাগর মেলার প্রতি উপেক্ষা, এই বঞ্চনা কি তার প্রাপ্য ছিল?

হিন্দুত্ববাদী কিন্তু বঙ্গবিরোধী। মোদি সরকারের এই চরিত্রটি যত দিন যাচ্ছে ততই ফুটে উঠছে। গঙ্গাসাগর মেলার প্রতি বিমাতৃসুলভ মনোভাব তারই আর-একটা নমুনা। আলোচনায় দেবাশিস পাঠক

Must read

কুম্ভমেলার ঠিকানা হরিদ্বার, প্রয়াগ কিংবা উজ্জয়িনী। যেখানেই হোক, সেটা সব সময় মূল ভূখণ্ডে। আর গঙ্গাসাগরের ঠিকানা মূল ভূখণ্ডের বাইরে। একটা দ্বীপে। এক দিকে ভাগীরথী, অন্য দিকে মুড়িগঙ্গা, আর এক দিকে বড়তলা নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই ভারতে জলবেষ্টিত দ্বীপে একটিই সর্বভারতীয় ধর্মীয় মেলা হয়, তার নাম গঙ্গাসাগর। কুম্ভমেলায় দু’-তিনটি শাহি স্নানের লগ্ন থাকে। গঙ্গাসাগরে সেরকম নয়। মাত্র এক দিন, পৌষসংক্রান্তিতেই ভিড়ের অবগাহন। এক দিনে দ্বীপে এত লোকের জমায়েত, তার পর তাঁদের নিরাপদে ফিরিয়ে দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর ফি বছর সেই চ্যালেঞ্জটির সফলভাবে মোকাবিলা করছে মা মাটি মানুষের সরকার ও প্রশাসন।

আরও পড়ুন-কারও পৌষমাস

এ মেলা আজকের নয়। অর্বাচীন খেলা মেলা উৎসব প্রাণতার সঙ্গে যোগ নেই এই মেলার। এর নাড়ি আর শিকড় অনেক প্রাচীন। ১৮৩৭-এর ৪ ফেব্রুয়ারি ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা জানাচ্ছে, ‘ভারতবর্ষের অতি দূর দেশ অর্থাৎ লাহোর, দিল্লি ও বোম্বাই হইতে যে বহুতর যাত্রী সমাগত হইয়াছিল তৎসংখ্যা ৫ লক্ষের ন্যূন নহে…বাণিজ্যকারি সওদাগর ও ক্ষুদ্র দোকানদারেরা যে ভূরি ভূরি বিক্রয়দ্রব্য আনয়ন করিয়াছিল, তাহা লক্ষ টাকারো অধিক হইবে।’ পাশাপাশি উনিশ শতকেই মেলাটার একটা আন্তর্জাতিক চরিত্র ছিল। কেবল দেশীয় ব্যবসায়ীর পসরাতে ভরে থাকত না মেলা চত্বর। ওই সমাচার দর্পণই জানাচ্ছে, ‘ব্রহ্মদেশ হইতে অধিকতর লোক আসিয়াছিল।’

আরও পড়ুন-শীত শীতে

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল। কেবল পুরাণ কথিত কপিল মুনি নন, ওয়ারেন হেস্টিংসও সাগরতীর্থের অন্যতম প্রাণপুরুষ। জনবিরল দ্বীপে বসতি স্থাপনের প্রথম উদ্যোগ ওয়ারেন হেস্টিংসের। জঙ্গল কেটে লোক বসানোর জন্য ১৮১৯-এ ৩০ হাজার টাকা অনুমোদন করেন তিনি। বাঙালিরা গেল না, আরাকান থেকে পাঁচশো পরিবার বসতি গড়ল সেখানে। ১৮২২-এ দ্বীপে তৈরি হল রাস্তা, ১৮৩১-এ বসল টেলিগ্রাফের তার।
বাঙালির ধর্মমোহ, কৃচ্ছ্রসাধন, বন কেটে বসত, রোম্যান্টিকতা— সব এখানে পরতে পরতে, মিলেমিশে একসঙ্গে। ১৮৬৬ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে সাগরফেরত যাত্রী ও মাঝিরা নবকুমারকে জঙ্গলে ফেলে পালিয়ে যায়। তাদের ধারণা, নবকুমারকে বাঘে খেয়েছে। এর তেরো বছর আগে, ১৮৫৩ সালে সম্বাদ প্রভাকর রিপোর্টিং করছে: ‘সাগর হইতে প্রত্যাগত ব্যক্তির দ্বারা অবগত হইলাম…. টৌন মেজর সাহেব চারিটা তোপ ও এক দল সৈন্যসহ তথায় উপস্থিত থাকিয়া অবিশ্রান্ত রূপে তোপ করাতে ব্যাঘ্রের ভয়বৃদ্ধি হয় নাই, কেবল তিন জন নাবিক বনমধ্যে কাষ্ঠ কাটিতে গিয়া উক্ত জন্তুর দ্বারা হত হইয়াছে।’ এরও আগেকার কথা। বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা এখানে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। বলেছিল, ‘সাগরসঙ্গমজলে ত্যজিব মো কলেবরে।’ সাগরে দেবতার গ্রাসে সন্তান বিসর্জন বহুকালাগত একটি প্রথা। কোন তীর্থক্ষেত্রে লোকে স্বেচ্ছায় সন্তানকে ভাসিয়ে দেয়? লর্ড ওয়েলেসলি না থাকলে এই প্রথাটি আজও রয়ে যেত। সতীদাহ প্রথার মতোই। সেটা ভুললে চলবে না।

আরও পড়ুন-কে বেশি হিংস্র, বাঘ না মানুষ?

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পদসঞ্চার’ উপন্যাস। সেখানে পড়ি, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন দিতে এসেছেন এক রানি। পর দিন এক মূক মেয়ে কী যেন দেখে ‘আঁ আঁ’ চিৎকার করে ওঠে। সাগরের স্রোতে তার সামনে এক শিশুর ছিন্ন শরীর, গঙ্গায় অর্ঘ্য দেওয়া হয়েছিল, তার পর মাছেরা খুবলে খেয়েছে। তান্ত্রিক কুলপুরোহিত এক পর্তুগিজ কিশোরকে বলি দিয়েছিলেন, তার পর থেকেই নীরব হয়ে গিয়েছিল সেই মেয়ে। দু’-তিন বছর পর বিসর্জিত শিশুর খুবলে খাওয়া শরীর দেখে ফিরে আসে তার বাক্ শক্তি।
গঙ্গাসাগর এমন এক তীর্থ যা কেবল পৌরাণিক নয়, আধুনিক, কখনও বা অত্যাধুনিক। তাই কপালকুণ্ডলার নবকুমার তীর্থযাত্রার কথা ভাবে না, উলটে ‘রঘুবংশম্’ আওড়ায়, ‘দুরাদয়শ্চক্রনিভস্য তণ্বী তমালতালী বনরাজিনীলা।’ প্রকৃতি নিয়ে রোম্যান্টিকতা তাকে ঘিরে ফেলে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সাগরসঙ্গম’ গল্পে মুখুজ্যেবাড়ির আচারসর্বস্ব বিধবা দাক্ষায়ণী প্রতিবেশীদের সঙ্গে চলেছেন সাগরস্নানে। যৌনকর্মীদের একটি দলও সেই নৌকায়, তাদের মেয়েটি মিথ্যে কথার ঝুড়ি। বিধবা ব্রাহ্মণীর গা রাগে রিরি করে ওঠে। গল্পের শেষে মেয়েটি গঙ্গাসাগরের হাসপাতালে জ্বরে মারা যায়। ডাক্তার তাকে দাক্ষায়ণীর মেয়ে ঠাওরান, বামুনের বিধবাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘স্বামীর নাম?’’ আচারসর্বস্ব বিধবা বলেন, ‘‘দিন, লিখে দিচ্ছি।’’ গঙ্গাসাগরই মহিলাকে ব্রাহ্মণত্বের সংস্কার ছাপিয়ে মানুষের ধর্মে উত্তীর্ণ করে। এ কেবল সাহিত্যের কথা নয়, জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। সেকথা লেপটে থাকে গঙ্গাসাগরের গায়ে।

আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা, ২০ দেশের অংশগ্রহণ উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী

মকরসংক্রান্তির পর মাঘী পূর্ণিমা, শিবরাত্রি, মহালয়াতেও স্নানে জড়ো হন লাখো লাখো মানুষ। তাঁরা জানেন ও মানেন, আগেকার মতো যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এখন মা মাটি মানুষের আমলে না থাকা সত্ত্বেও, ‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’। দুর্গমতার কারণেই তো এই স্লোগান, এই বিশ্বাস শিকড় গেড়েছে।
স্নান, দানের পাশাপাশি গঙ্গাসাগরের ভিন্ন মাহাত্ম্য। এই মেলায় মুসলমানরাও দোকানপাট বসান। রেজাউল হকরা গলা চড়িয়ে বলেন, ‘‘শোনেন, পুরনো কপিল মুনির মন্দিরে যখন জল উঠেছিল, আমার দাদা-পরদাদারা বুক দিয়ে আগলেছিলেন। আমাদের মধ্যে বিভেদ নাই।’’ রোম্যান্টিকতা আর সম্প্রদায়িক বিভাজনমুক্ত স্বতঃস্ফূর্ত মানবিকতা। এতেই সাগরস্নানের মুক্তি। আজও।
গঙ্গাসাগরের সঙ্গে অযোধ্যার, সেখানকার রাম মাহাত্ম্যের সঙ্গে গঙ্গাসাগরের গৌরবের একটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগও রয়েছে।

আরও পড়ুন-রাজ্যপাল কি সরকারের বাইরে? বোসের আলটপকা মন্তব্য, ধুইয়ে দিলেন ব্রাত্য বসু

গোড়ার দিকে সাগরদ্বীপের এক জমিদার, তাঁর নাম যদুরাম, মেদিনীপুর থেকে এসেছিলেন। যদুরামই রামানন্দী সাধুদের কপিল মুনির মন্দিরের দায়িত্বে প্রথম নিয়ে আসেন। সেই মন্দির রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভগীরথের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কপিল মুনিও স্বয়ং বিষ্ণু। তাঁর বাবা কর্দম মুনি বিষ্ণুকে পুত্র হিসাবে চেয়েছিলেন। ফলে বিষ্ণু কপিল হিসাবে জন্ম নেন। বিষ্ণু ও রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষদের এই মন্দিরের অধিকারী তাই আজও অযোধ্যার শ্রীরামানন্দী আখড়ার সাধুরা, মেদিনীপুরের জমিদার বংশের লোকেরা নন।
গঙ্গাসাগর যে প্রয়াগ, হরিদ্বারের কুম্ভমেলার চেয়ে আলাদা, তার কারণ এই বৈষ্ণব আখড়ার জনসংস্কৃতি। আজও সাগরে ভোরবেলায় এক দিকে কপিলমন্দিরে স্তোত্রপাঠ, অন্য দিকে ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের মন্দিরে নামগান। কুম্ভমেলায় দশনামী শৈব ও বৈরাগী আখড়া পাশাপাশি, আর গঙ্গাসাগরে বৈষ্ণব একাধিপত্য।
আরও আছে। কুম্ভ মেলায় ট্রেন এবং সড়ক পথে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু গঙ্গাসাগর মেলায় আসতে হলে জলপথে আসতে হয়। ফলে যোগাযোগের দিক থেকে এটি অনেক বেশি কঠিন। আগে এখানে কিছুই ছিল না। সেইজন্যই সব তীর্থ বারবার হলেও গঙ্গাসাগর একবার। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেষ্টায় এখন গঙ্গাসাগর মেলাকে কেন্দ্র করে সব ধরনের পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ২০২৪-এ অন্তত ৮০ থেকে ৯০ লক্ষ পুণ্যার্থী মেলায় আসতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। কাল ১৫ জানুয়ারি গঙ্গাসাগরে মকর স্নান।

আরও পড়ুন-কেজরিওয়ালকে ফের তলব ইডির

কিন্তু এসব কথা মোদিজীদের বোঝাবে কে? তাঁরা তো হিন্দি বলয়ের মেকি হিন্দুত্বের রাজনৈতিক কারবারি। তাঁরা এসব শুনতে চাইবেন কেন?
আর সেই কারণেই জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ঝরে পড়ে অনুযোগ, ‘কুম্ভমেলার থেকেও গঙ্গাসাগর মেলা অনেক বড়। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী আসেন। তবু কেন্দ্র আজও স্বীকৃতি দিল না। কুম্ভমেলায় কেন্দ্র টাকা দেয়। অথচ আমাদের গঙ্গাসাগর মেলায় ১ পয়সাও দেয় না।’
গৌরব সুপ্রাচীন। বঞ্চনাও অন্তহীন।

Latest article