তাহির চাচা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। কিন্তু পয়লা বৈশাখে আচার-বিচারের নিরিখে অন্য মানুষ। কানে আতর গুঁজে, টুপি পরে লাল রঙের সুতোয় বাঁধা খেরোর খাতায় হলুদের ফোঁটা দিয়ে হালখাতা তাঁর। এই আমাদের ভারতবর্ষ। স্মৃতির কালিতে কলম ডুবিয়ে লিখছেন মইনুল হাসান
তাহির চাচার মনিহারি দোকান। এখন যার পোশাকি নাম ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ছুঁচ থেকে কম্বল, সিমেন্ট থেকে হাঁড়ি-কড়াই অথবা ১ পয়সা দামের লবঞ্চুস আর রঙিন চুড়ি— সব পাওয়া যাবে। আগের দিন বিকেল থেকে সেখানে সাজো-সাজো রব। লাল-সবুজ-হলুদ রঙের কাগজ কেটে শিকলি বানিয়ে দোকানে টাঙানো হচ্ছে। বিস্তর বট আর কাঁঠালপাতা এনে গেট বানানো হচ্ছে।
আরও পড়ুন-চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হচ্ছে ২৫শে
দোকানের দাওয়াটা এমন পরিষ্কার করা হয়েছে যেন মাজা কাঁসার থালা। আমরা দুই ভাই ১০ টাকা নিয়ে, পরনে নতুন জামা। পায়ে জুতো, হাজির। আজ পয়লা বৈশাখ। তাহির চাচার দোকানে হালখাতা। সব খদ্দের হাজির। যার যা পুরাতন বকেয়া মেটাচ্ছে। সঙ্গে মিষ্টির প্যাকেট। এখনকার মতো চৌকোনা, রাবার জড়ানো প্যাকেট নয়। কাগজের ঠোঙা। একটু অদ্ভুত গন্ধ আর মাদকতা। দাদা বলতেন তাহির চাচা আতর মেখেছেন আর ধূপের গন্ধ দিয়েছেন। আমাদের খেতে দেওয়া হত মতিচুরের নাড়ু। সঙ্গে দুটো কাগজের ঠোঙা। একটা বড় খাতায় আব্বার নাম লিখে ১০ টাকা জমা করা হত। রাস্তায় ফেরার সময় ঠোঙা খুলে ফেলতাম। গুনে গুনে ১০টা রসগোল্লা। কোনওদিন বেশি বা কম হয়নি। বাড়িতে পৌঁছেই দেখেছি পাশের পাড়া থেকে রাসু কাকা এসে গেছে। রাসু ঘোষ। আজ নববর্ষ। মা নিচ্ছেন দই, মিষ্টি বোঁদে আর ছোট ছোট গুজিয়া। বাড়ির ছোটদের তখন আনন্দ ধরে না। পড়ালেখা বন্ধ। দুপুরে কী রান্না হচ্ছে তারই অপেক্ষায় সময় কাটানো।
আরও পড়ুন-পরিবেশবন্ধু চাষে ও উদ্ভাবনে দৃষ্টান্ত মৌসুমি
আগাপাছতলা একটা মুসলমানদের গ্রাম। নববর্ষের অনুষ্ঠান হতে আটকায়নি। এ তো বাঙালিদের উৎসব। কোনও ধর্মই বাঙালিত্বকে খাটো করতে পারে না। আমাদের গ্রামে ছোটবেলা থেকেই দেখেছি ইদ ও বকরিদের পর বড় অনুষ্ঠান নববর্ষ। পয়লা বৈশাখ।
আমার নানা (মায়ের বাবা) একজন ছোটখাটো জমিদার ছিলেন। আমার মায়ের ভাষ্যে, বাংলা বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে পুণ্যাহ হত। অর্থাৎ সেদিন প্রজারা জমিদারের সব পাওনা মিটিয়ে দিতে চাইতেন। সবাই পারতেন এমন নয়। কিন্তু সবাই এসে হাজির হতেন জমিদার দালানে। এক বিশাল আয়োজন সেখানে। রান্না, খাওয়াদাওয়ার এলাহি ব্যাপার। আসল ব্যাপারটা বিকেলবেলায় নানাজি ঘোষণা করতেন। কাল এখানে সবার জিয়াফৎ। কাল নতুন বাংলা বছর শুরু হচ্ছে। পয়লা বৈশাখ। সবাই আসবেন। মুসলমান সবাই। পাশের গ্রামের হিন্দুরা আসতেন। তাঁরা মূলত বাংলাদেশ থেকে আসা। ঘোষ পাড়াতে তৈরি নানা রকম মিষ্টি বিতরণ হত। সবাই নতুন জামাকাপড় পরতে পারেনি।
আরও পড়ুন-বৃষ্টি নেই, জল নেই কংসাবতীতেও, পুরুলিয়া পুরসভা পাম্পে তুলে দিচ্ছে পানীয় জল
কিন্তু জামা লুঙ্গি পাজামা সাবানে কেচে পরেছে। কানে তুলোয় মাখা একবিন্দু আতর গুঁজেছে, যেন অকালে কোনও পরবে তারা মিলিত হয়েছে। গান-বাজনা না হলে নববর্ষ ঠিক জমাট বাঁধে না। গ্রামে তখন একটাই রেডিও। নানার বাড়ির দোতলায়। গাঁক গাঁক করে সেটাতে বিবিধ ভারতী বা রেডিও সিলোন বাজছে। আমিন ভাই-এর জাদুকণ্ঠ ভেসে আসছে। তবুও ফাঁকা থেকে যাচ্ছে। লক্ষ্মীনারায়ণপুরে কীর্তন পঞ্চরসের আসর। আর যায় কোথা। একছুটে আমরা সবাই সুমতি মাসির বটতলা পেরিয়ে সোজা মজুমদার বাড়ির আঙিনায়। শ্রোতাদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। গান উপলক্ষে সেখানে একটা ছোটখাটো মেলা বসে গেছে। হাতের চুড়ি থেকে মদন-কুটকুট বিস্কুট— সব বিক্রি হচ্ছে। তখন কীর্তনের খোলে চাঁটি পড়ছে। ভাবের সাগরে ভাসছে সবাই। হঠাৎই মনে পড়ছে প্রায় ৩০০ বছর আগে জন্মেছিলেন সাধক রামপ্রসাদ। তাঁর গানে মুসলমান শ্রোতারা মাতোয়ারা হচ্ছেন। সংস্কৃতিবন্ধন এটাই। ক্ষমতা এটাই। কোন পরিচয় নির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে। আবার বলি মানুষের মধ্যে। তখন মানুষের পরিচয় হয় মানুষ। অন্য সব পরিচয় থাকে, কিন্তু গাছের গায়ে থাকা শুকনো বাকলের মতো। বাংলায় যে নববর্ষ আজ আমরা পালন করি তা সম্রাট মহামতি আকবরের কাছ থেকে পাওয়া। রাজস্ব আদায় ও শাসন পরিচালনার সুবিধাতে এ-কাজ তিনি ও তাঁর সভাসদেরা করেছিলেন। সম্রাট আকবর সংগীত ও উৎসবের পক্ষপাতী ও উৎসাহদাতা ছিলেন। মুঘল সম্রাটরা বহুজন দোল উৎসবে সক্রিয় অংশ নিতেন। নববর্ষে জাঁকজমক করে সংগীতের আসর বসাতেন।
আরও পড়ুন-দলের নির্দেশে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন নেতা
এরই নাম ভারত। তাহির চাচার মতো মানুষরা মাথায় টুপি দিয়ে, কানে আতর গুঁজে হালখাতা করেন। কেন যে মোটা লালরঙের সুতোয় জড়ানো খেরোর খাতাটির উপর একটি হলুদ টিপ পরিয়ে রাখতেন জানি না। বড় হয়ে জিজ্ঞাসা করলে এক ভুবনভুলানো হাসি ছাড়া কিছু পায়নি। সত্যিই তো। সত্যিই তো ব্যক্তি মানুষের তল কে কবে পেয়েছে।
সেই ভারতেই আজ আকবর বাদশাহকে অত্যাচারী শাসক বলে ইতিহাসের পাতায় মাত্র দেড় পাতা বরাদ্দ করেছে। এরই নাম ভারত। ধর্ম একটা নির্দিষ্ট সংস্কৃতির জন্ম দেয়। সেটা আর এক ধর্মের মানুষের থাকে না। তাজমহল, কুতুবমিনার বা বিশ্বনাথমন্দির এখন আর হিন্দু বা মুসলমানের নয়। সবার। এখানে ভারতের বহুত্ববাদের জয়। সেই জয়ের সামনে বড় বাধা হয়ে আসছে দেশের শাসকবর্গের কুৎসিত সিদ্ধান্তগুলি। মানুষের পছন্দ-অপছন্দগুলি তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। ধর্মের উৎসবের সবার আনন্দ ভাগ বন্ধ হবে। সে কারণেই নবরাত্রির সময় দিল্লিতে মাংসের দোকান বন্ধ করা হচ্ছে। হিজাব নিষেধের নামে শিক্ষার দফারফা হচ্ছে।
আরও পড়ুন-নামেই নমামি গঙ্গে, দূষণে বিপন্ন মৎস্যজীবীরা
তা হলে আমাদের তাহির চাচা ও রমেশ কাকারা নববর্ষের উৎসবে মেতে, মিষ্টি বিতরণ করে কোন অপরাধে অপরাধী হলেন? অথবা আমার নানা, যিনি পুণ্যাহ ও নববর্ষে ডেকেছেন প্রকৃত ভারতকে। যা আছে মাটির কাছে জাতি-ধর্মের সীমানা পেরিয়ে। মনে করিয়ে এ ঘটনা অক্ষয়। এই তারটা যেদিন কেটে যাবে (যা কোনওদিন হবে না) সেদিন আমরা মানুষের পরিচয়ে থাকব না। বাঙালির পরিচয়ে থাকব না। তাই, আজকের নববর্ষ পালনের ঝাঁ-চকচকে মৌতাতকে হারিয়ে দিয়ে তহির চাচার দোকানের কাগজের ঠোঙার রসগোল্লা আর মজুমদার বাড়ির উঠোনের রামপ্রসাদি গান একতারে বাঁধা পড়ে। আজও। এই আমাদের বাঙলা। আমাদের নববর্ষ।