এই প্রচণ্ড গরমে রোজ ভোর উঠেই পর্ণা লেগে পড়ে হেঁশেলে। ঘড়ির অ্যালার্ম একদিন মিস হলে নাকে চোখে দ্যাখে সে। সাতসকালের রান্নাঘর তখন যেন যজ্ঞিবাড়ি। অর্চিষ্মানের অফিস। ছেলের স্কুল। একে প্রবল গরম তারপর এতটা সময় বাড়ির বাইরে থাকে অর্চিষ্মান। অন্তত তিনটে টিফিন তাঁকে না দিলে কী চলে। তার মধ্যে অফিস যেতে যেতেই তো শরীরের সব জল ঘাম হয়ে বেরিয়ে যায়। একটু গ্লুকোজ জল, ফলের রস তো দিতেই হয়। সকালে ব্রেকফাস্টে ব্রেড টোস্ট, ওমলেট রেডি করে দুপুরের লাঞ্চ এবং বিকেলের জন্য টিফিন প্যাক করে তবেই রেহাই। এরপর ছেলের শুরু। এখন গরমে দুটো ব্রেক তাই একটা ছোট আর একটা বড় টিফিন দিতেই হয় তাকে। গরম যখন থেকে শুরু হয়েছে তখন থেকেই পর্ণা রাতে বাতাসা, মৌরি জলে ভিজিয়ে রাখে। সকালে খালি পেটে ছেলেকে আর বরকে এক গ্লাস করে দেয়। সারাদিন ওদের শরীর ঠান্ডা থাকবে ভেবে শান্তি পায় সে। ক’দিন আগে তীব্র দাবদাহে স্কুল আর অফিস সব বাড়িতেই বসেছিল। তখন তো পর্ণার আরও চাপ। টাইমে টাইমে খাবারের ফরমাশ চলতে থাকত দু’জনের। কোনও কোনওদিন সেই ফরমাশ মেটাতে গিয়ে নিজের জলখাবারটা খেতেই ভুলে যেত সে। এত ঘাম হয় রান্নাঘরে কিন্তু নুন-চিনির জলটা খাওয়ার কথাও তার মনেই থাকে না। তবু পরোয়া করে না পর্ণা (Homemaker) কারণ সে হল তীব্র দাবদাহকে তুচ্ছ করে চলা দামাল ঘরনি। প্রতিটা সংসারের মহিলাদের (Homemaker) যে এই একই গল্প।
মাথার ওপর চাঁদি ফাটা রোদ, ভ্যাপসা গরম, ঘাম সঙ্গে কখনও বৃষ্টি। ওয়েদার কন্ডিশন যাই হোক, গরমের পারা ঊর্ধ্বগামী। সকালে একটু মেঘলা তো রাতে গুমোট গরম। প্যাচপেচে ঘামে সব্বাই কাবু। স্কুল, কলেজে তুরন্ত অনলাইন ক্লাস চালু, স্কুল টাইমিং-এ সত্বর বদল। গরমের ছুটিও এগিয়ে এনেছে স্কুল। কোভিডের পর এখন তো উনিশ থেকে বিশেই অফিসে ওয়র্ক ফ্রম হোম ঘোষণা করা হয়। প্রবল গরমেও তাঁর ব্যতিক্রম নেই। সবকিছুর সলিউশন রয়েছে কিন্তু সর্বঘটের যিনি কাঁঠালি কলা তাঁর জীবনের ঝক্কি ঝামেলার কোনও সলিউশন নেই। সব পুজোয় তাঁকে লাগলেও দেবতার কৃপা থেকে তিনি যে চির বঞ্চিত। তাঁরা হলেন হাউজ ওয়াইফ। জেট যুগে পদোন্নতি পেয়ে যাঁদের আধুনিক নামকরণ ‘হোমমেকার’ (Homemaker)। শুনতে বেশ ভাল লাগলেও হোমমেকারদের থ্যাঙ্কলেস জবের বৃত্তান্তটি বড়ই করুণ। তাপপ্রবাহ চলুক বা হোক ভূমিকম্প, তাঁদের ছুটি নেই। গরমে অফিস ফেরত হাজব্যান্ডের হাতে নুন-চিনির জলটা বাড়িয়ে দিলেও নিজের দেখভালের সময় তাঁদের এতটুকুও নেই। ‘শীত গ্রীষ্ম বর্ষা হাউজ-ওয়াইফ-ই ভরসা’ এটাই গৃহিণীদের জন্য সেরা ট্যাগ লাইন। ওয়র্ক ফ্রম হোমের মজাটা আসলে কী— একমাত্র তাঁরাই বোঝেন। শনি, রবি, শিবপুজো, ইতুপুজো, দুর্গাপুজো, স্বাধীনতা দিবস সবদিনই তাঁদের কাজের দিন। একটানা চলে যাওয়া অন্তহীন দায়দায়িত্ব। শ্রমিক দিবস যাঁদের জন্য নয়। এই গরমে বিনা পারিশ্রমিকের সেই খুব কাছের কাজের লোকটির খেয়াল কে রাখে বরং অসুস্থ হয়ে বাড়ির ঠিকে কাজের হেল্পারটি না এলে বা রান্নার লোকটি কামাই দিলে তারা তো রয়েছেই ২৪X৭ সার্ভিস দেওয়ার জন্য। সত্যি তাঁরা দামাল ঘরনি। দাবদাহ তো কী হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের এক্সপেক্টেশন পূরণ করে ক্লান্ত দেহে রাতে ঘুমিয়ে সকালে আবার হাসিমুখে দায়িত্ব পালনে লেগে পড়া এই ম্যাজিকটা শুধু তাঁরই জানা।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন তাঁদের এই দামালপনার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে নিজের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা। কিন্তু যে পরিবারের ভরকেন্দ্র তাঁর সুস্থতাই সবচেয়ে আগে জরুরি। যিনি সবার খেয়াল রাখেন হাজার কাজের ফাঁকে তাঁর নিজের খেয়ালটাও তাকেই যে রাখতে হবে।
ঘুম থেকে উঠে ফ্রিজ খোলা গৃহিণীদের (Homemaker) প্রথম কাজ। তখনই খালি পেটে দুটো খেজুর আর, দুটো আমন্ড বাদাম খেয়ে নিন। এতে আপনার ওজন সারাবছর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বাড়তি কোলেস্টেরল ঝরে যাবে। রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
আরও পড়ুন-সংগীত জগতের ‘আপ্পাজি’ বিদূষী গিরিজা দেবী
সকালে লিকার বা দুধ চা না খেয়ে এক কাপ ডিটক্স টি দিয়ে দিন শুরু করলে কেমন হয়। চা-টা তো করতেই হবে, তার আগে নিজের এক কাপ ডিটক্স টি তৈরি করে নিন। সময় লাগবে খুব বেশি হলে পাঁচ-সাত মিনিট। হালকা চায়ের লিকার সঙ্গে চার- পাঁচটা তুলসী পাতা আর আদা ফুটিয়ে নিন সারারাতে শরীরে জমে থাকা সব টক্সিন বেরিয়ে যাবে এই চা খেলে। এতেও সময় নষ্ট তাহলে বাজার থেকে ডিটক্স টি কিনে নিন।
একটা ডিটক্স ওয়াটার তৈরি করে হাতের কাছে রাখুন। এক বোতলে জলে চারটে পাঁচটা গোল করে কাটা পাতিলেবু দিয়ে দিন আর সঙ্গে পাঁচটা পুদিনা পাতা। একটু ফ্রিজে রেখে দিন। ওই জলটাই সারাদিন সিপ সিপ করে খান। এতে সারাদিন ধরে শরীরে একটা ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া চলবে। আলাদা করে সময় নষ্ট হবে না। কাজ আর স্বাস্থ্য দুয়ের দেখরেখ চলবে জমিয়ে।
যতই ব্যস্ত থাকুন ব্রেকফাস্টে পাতে এমন খাবার রাখতে হবে যা সারাদিনের জ্বালানি সরবরাহ করবে। হোম মেকারদের এটাই তো একমাত্র চাহিদা। সেই সঙ্গে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার ব্রেকফাস্টে রাখলে বহু অসুখ থেকে দূরে থাকবেন। কারণ গোটা পরিবারের দায়িত্ব যে আপনারই কাঁধে। প্রোটিন হল শরীরের বিল্ডিং ব্লক। পেশি তৈরি থেকে শুরু করে নানারকম হরমোন, উৎসেচক তৈরিতে জরুরি এই প্রোটিন।
যেমন জলখাবারে একটা ডিম খান রোজ। কুসুম ছাড়া হলে দুটো ডিমের সাদা খান। সঙ্গে একটা কলা বা পেয়ারা। এতে গোটা ফলটাও খাওয়া হয়ে যাবে। হাজব্যান্ডের ব্রেকফাস্টের সঙ্গেই নিজেরটাও রেডি করে নিন।
গরমের দিনে লাঞ্চে টকদইটা নিশ্চয়ই স্বামীর টিফিনে ভরে দেন তাহলে দু’চামচ নিজের জন্যও নয় কেন! টকদইয়ে রয়েছে ল্যাকটোব্যাসিলাস। গরমে সারাক্ষণ উনুনের ধারে মানেই পেট গরম। দইয়ে পেট থাকবে ঠান্ডা। দই ফেটিয়ে একটু বিটনুন আর অল্প চিনি দিয়ে ঘোল করে খেয়ে নিন বা ভাত পাতে খেতে পারেন।
সারাক্ষণ বাড়ির লোকে পছন্দের মেনু রাঁধছেন আর নিজের পছন্দ? নিজের জন্য আর কে ভাবে— এমন বস্তাপচা ধ্যানধারণা নিয়ে আর থাকবেন না। রোজ একটা পদ নিজের (Homemaker) পছন্দের রাখুন। সারাদিন পরিশ্রম করছেন নিজের পছন্দকেও গুরুত্ব দিন। না হলে কাজের উৎসাহে একদিন ভাটা পড়বেই।
এত দিকে সময় যাচ্ছে আর একটু শরীরচর্চার সময় নেই। তার জন্য তো পনেরো মিনিটই যথেষ্ট। কয়েকটা প্রাণায়াম আর ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ সারাদিনে যে কোনও সময় করে ফেলুন। সকালে হলেই সবচেয়ে ভাল, না হলে আর কী করা যাবে। তবে ভরা পেটে করবেন না।
সারাদিন জল খান অনেকটা। যদি মনে হয় খুব ঘাম হচ্ছে নিজের জন্যও একটু নুন- চিনির জল তৈরি করে নিন। কারণ আপনার সুস্থতা কারও হাতে নেই।
বিশ্রাম শরীরের জন্য মাস্ট। তাই একটু জিরোতে ভুলবেন না। এই গরমে ডিনার হাল্কা খান, সুস্থ থাকবেন। দেখবেন রাতের ঘুমটা যেন পর্যাপ্ত হয়।
যদি মনে হয় সারাদিনে পুষ্টির ঘাটতি থেকে যাচ্ছে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট খেতে পারেন। এতে শরীর সুস্থ এবং এনার্জিটিক থাকবে।
প্রেশার, সুগার, কোলেস্টেরলের রুটিন এক্সাম করিয়ে রাখুন। একবার দেখে নেওয়া— এত অযত্নে সব ঠিক আছে তো।