প্লাস্টিক দূষণ রুখতে

সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই অগ্রগতির পাশাপাশি পরিবেশ ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

Must read

মানবসভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে প্লাস্টিক ভক্ষণ করে প্লাস্টিকখেকো অনুন্নত জীবেরা । লিখছেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই অগ্রগতির পাশাপাশি পরিবেশ ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার যেমন মানুষের জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে তেমনই পরিবেশ দূষণের ভারে ভারাক্রান্তও করে তুলেছে। বর্তমানে পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত কথা উঠলেই সবচেয়ে আগে যেটি মাথায় আসে, সেটি হল প্লাস্টিক দূষণ।

আরও পড়ুন-বিএসএফ ত্রাসে সংকটে চাষি

বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের তাগিদে যথেচ্ছহারে প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এর অন্যতম কারণ। পরিসংখ্যান বলছে, সারা পৃথিবীতে বছরে প্রায় ৪০০০ লক্ষ মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক তৈরি হয়, যা পরিশেষে প্রকৃতিতেই এসে জড়ো হয়। এই প্লাস্টিক সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি যেটা চিন্তার, সেটা হল এর জীবনকাল, যা কমপক্ষে ৪০০-৫০০ বছর অর্থাৎ প্লাস্টিক ক্ষয় হতে সময় লাগে প্রায় ৪০০-৫০০ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে এরা প্রায় একইভাবে কোনওরকম পরিবর্তন ও ক্ষয় ছাড়াই পরিবেশে থেকে যেতে পারে। আর শুধু এই কারণেই প্রকৃতিতে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ দিনে দিনে আরও বাড়ছে।

আরও পড়ুন-Agartala: ভয় পাবেন না, পাশে আছি: আক্রান্তদের আশ্বাস অভিষেকের

আজ সমগ্র পৃথিবীর ত্রাস হয়ে উঠেছে এই প্লাস্টিক। সবচেয়ে বড় কথা হল এই প্লাস্টিক ক্ষয় পেয়ে আবার এই প্লাস্টিকেরই একক তৈরি করে, যা প্লাস্টিক ব্যতীত অন্য কিছু তৈরি করতে পারে না। শুধু তাই নয়, এই প্লাস্টিক অণু ক্রমে খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশের মাধ্যমে সোজা পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের শরীরে যা ধীরে ধীরে আমাদের অজান্তেই আমাদের দেহের ক্ষতিসাধন করছে। আজ প্রায় অর্ধেক পৃথিবীই এই প্লাস্টিকের কবলে আর মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে। এমতাবস্থায় মানবসভ্যতা তথা সমগ্র পৃথিবীকে বাঁচাতে বিজ্ঞানীরা ভরসা করছেন কিছু এমন অনুন্নত জীব তথা জীবাণুর ওপর, যারা নাকি প্লাস্টিক ভক্ষণ করতে পারে।

আরও পড়ুন-অভিজ্ঞতা বিক্রি হয় না বাজারে, রাহানে ও পূজারাকে নিয়ে শাস্ত্রী

প্লাস্টিকের ইতিবৃত্তান্ত
প্লাস্টিকস নামক গ্রিক শব্দ থেকেই প্লাস্টিক কথাটির উৎপত্তি। যার অর্থ হল সহজেই ছাঁচযোগ্য বা ঢালাইযোগ্য। প্লাস্টিক আবিষ্কারের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, লন্ডনে ১৮৬২ সালে আলেকজান্ডার পার্ক সর্বপ্রথম পার্কেসিন বা পার্কেসাইন নামক মনুষ্যসৃষ্ট প্লাস্টিকের সঙ্গে সকলকে পরিচয় করান। তবে এটি ব্যবসায়িক দিক থেকে ততটা সাফল্যলাভ করতে পারেনি। তবে ১৮৬৯ সাল নাগাদ জন ওয়েসলি হায়াত পার্কেসাইন–এর উন্নত সংস্করণ সেলুলয়েড তৈরি করেন।

আরও পড়ুন-পৌষমেলা হবেই, তৎপর পুরসভা

এর বেশ কিছু বছর পরে ১৯০৭ সালে ড. লিও বেকল্যান্ড সম্পূর্ণ কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত করেন ব্যাকেলাইট। যা আধুনিক প্লাস্টিক শিল্পজগতের সূচনা করে। এরপর ১৯২০ সালে মানুষ সর্বপ্রথম পলিমার কথাটির সঙ্গে পরিচিত হয়। এর আবিষ্কারক ছিলেন হারমান স্টডিনজার। আবার এরও অনেক বছর পর প্রায় ১৯৩৩-১৯৪৫ সাল নাগাদ বিভিন্ন রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পলিমার আবিষ্কার হয়, যেমন- পলিইথিলিন, পলিস্টাইরিন, নাইলন ইত্যাদি। ১৯৫০ সাল নাগাদ আসে পলিএস্টার, পলিপ্রপিলিন এবং হাই ডেনসিটি পলিইথিলিন। যা বর্তমান যুগে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্লাস্টিকের অন্যতম।

আরও পড়ুন-বিরোধী নেতাকে তোপ ফিরহাদের

সাধারণত এই সাল থেকেই মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে প্লাস্টিক প্রীতি বাড়তে থাকার ফলে শিল্পজগতেও প্লাস্টিক ধীরে ধীরে নিজের জায়গা করতে থাকে এবং ১৯৬০ সালে পলিসালফোন (অতিরিক্ত উষ্ণতা সহনকারী) আসার পর থেকে এর চাহিদা তথা বাজার দুটিই সমানভাবে বাড়তে থাকে। এমনকী আজও প্লাস্টিকের চাহিদা প্রায় প্রথম সারিতেই বলা যায়।
প্লাস্টিকের রাসায়নিক গঠন সম্বন্ধে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্লাস্টিক আসলে সম্পূর্ণ কৃত্রিম বা অর্ধকৃত্রিম জৈব পলিমার আর তার উপাদান হল কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ক্লোরিন, সালফার ইত্যাদি। সাধারণত এই উপাদানগুলির বিভিন্নতার ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক যেমন- পলিএস্টার, পলিপ্রপিলিন, পলিস্টাইরিন, নাইলন ইত্যাদি তৈরি হয়।

প্লাস্টিকখেকো ব্যাকটেরিয়া
জাপানের একদল বিজ্ঞানী প্লাস্টিক বর্জ্যের একটি অংশ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে অদ্ভুত এক ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পায়, যারা নাকি প্লাস্টিক খায় এবং এর দ্বারাই নিজেদের পুষ্টি সম্পন্ন করে। ২০১৬ সালে প্রথম এই ঘটনাটি সকলের সামনে আসে। ব্যাকটেরিয়াটির নাম হল ইডিওনেল্লা সাকায়াসিস (Ideonella sakaiensis)। ইডিওনেল্লা বংশোদ্ভূত ও কোম্যামোনেডেসি পরিবারের অন্তর্গত এই ব্যাকটেরিয়াটি সাধারণত পলিইথিলিন টের‍্যাপথ্যালিন (PET) নামক প্লাস্টিক উপাদানকে ধ্বংস করতে সমর্থ।

আরও পড়ুন-BREAKING : রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্ধকারে ডুবে দিল্লির সাউথ এভিনিউ

পলিইথিলিন গ্লাইকল ও টের‍্যাপথ্যালিন অ্যাসিড এই দুটি উপাদান পলিমারাইজেশনের মাধ্যমে গড়ে তোলে পলিইথিলিন টের‍্যাপথ্যালিন। এর এক-একটি মনোমারকে বলা হয় মনো ২ হাইড্রক্সিইথাইল টের‍্যাপথ্যালিন (MHET)। এই পলিইথিলিন টের‍্যাপথ্যালিন মূলত সমস্ত ধরনের বোতল তৈরিতে কাজে লাগে। ইডিওনেল্লা সাকায়াসিস PETase (PET-এজ বা PET হাইড্রোলেজ) নামক উৎসেচকের সাহায্যে হাইড্রোলাইসিস প্রক্রিয়ায় প্রথমে পলিইথিলিন টের‍্যাপথ্যালিনকে ভেঙে মনোমারিক মনো ২ হাইড্রক্সিইথাইল টের‍্যাপথ্যালিন-এ পরিণত করে। তারপর MHETase (MHET-এজ বা MHET হাইড্রোলেজ) উৎসেচক এই মনোমারিক মনো ২ হাইড্রক্সিইথাইল টের‍্যাপথ্যালিনকে ওই একই প্রক্রিয়ায় ভেঙে পলিইথিলিন গ্লাইকল ও টের‍্যাপথ্যালিন অ্যাসিড-এ পরিণত করে।

আরও পড়ুন-মেট্রোয় ফিরছে টোকেন, থাকছে স্মার্ট কার্ডও

পরবর্তীতে ব্যাকটেরিয়া এই সমস্ত উপাদান থেকেই পুষ্টিলাভ করে। তবে এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে মূল প্রতিবন্ধকতা হল সময়। কারণ এই গোটা প্রক্রিয়াটি ঘটতে প্রচুর সময় লাগে এবং ব্যাকটেরিয়াগুলিও উপযুক্ত পরিবেশ ছাড়া ক্রিয়াশীল হয় না। তবে বিজ্ঞানীরাও হাল ছাড়বার পাত্র নন। তাঁরাও ব্যাকটেরিয়ার এই উৎসেচকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের সুপার এনজাইম তৈরি করার চেষ্টা করছেন যাতে খুব কম সময়ের মধ্যেই প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ করা যায়। এমনকী তাঁরা উক্ত ব্যাকটেরিয়াটির বিভিন্ন মিউট্যান্ট প্রজাতি তৈরি করারও চেষ্টা করছেন যাতে ব্যাকটেরিয়াগুলি যে-কোনও পরিবেশে অনেক দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারে।

আরও পড়ুন-হিংসা নয়, উন্নয়ন চাই: পথসভায় বার্তা দিলেন ব্রাত্য বসু

প্লাস্টিকখেকো ছত্রাক
মোটামুটি ২০১১-২০১২ সাল নাগাদ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী আমাজনের জঙ্গলে প্লাস্টিকখেকো একপ্রকার ছত্রাকের আবিষ্কার করেন। পেস্টালোটিওপসিস মাইক্রোস্পোরা (Pestalotiopsis microspora) নামক এই ছত্রাক পলিইউরেথেন নামক প্লাস্টিক উপাদানকে পাচিত করে ও এর নির্যাসের ওপরই বেঁচে থাকে। এমনকী এরা বায়ুবিহীন বা অক্সিজেনবিহীন পরিবেশেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। প্রথমে ভাবা হয়েছিল কেবলমাত্র আমাজনের জঙ্গল ছাড়া এটি আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয় এবং একমাত্র ওখানেই এরা বেঁচে থাকতে পারবে।

কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে এরা যে-কোনও অক্সিজেনবিহীন পরিবেশেই জন্মাতে পারে। এর ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ক্যাথারিনা আঙ্গার, ইউট্রিচেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্যে বাড়িতেই প্লিউরোটাস অসট্রিয়েটাস (Pleurotus ostreatus) ও স্কিতজোফাইলাম কমিউন (Schizophyllum commune) নামক দুই প্রকারের খাদ্যযোগ্য ছত্রাকের মাইসেলিয়াম (সরু সূত্রাকার অংশ) নিয়ে ফাংগি মিউটেরিয়াম নামক যন্ত্রে চাষ করেন। বলাবাহুল্য এই যন্ত্র তিনি ছত্রাকচাষের জন্যই বানিয়েছিলেন। এই যন্ত্রে তিনি প্লাস্টিক ভর্তি করে রেখে দিতেন এবং ঠিক দু-সপ্তাহ পর দেখতেন ওই যন্ত্রে থাকা ছত্রাকগুলি এই সমস্ত প্লাস্টিক খেয়ে নিয়েছে।

আরও পড়ুন-কঙ্গনার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের

এমনকী ওই ছত্রাকের কোথাও প্লাস্টিকের কোনও চিহ্নও থাকত না। এই সমস্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এইসকল ছত্রাকের চাষ এমন কিছু জায়গায় করার কথা ভাবা হচ্ছে যেখানে কিনা প্লাস্টিক বর্জ্য স্তূপাকারে জমে থাকার প্রবণতা থাকে। সেইসব মাটিতে এই সমস্ত ছত্রাকের চাষ এই বিশাল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণে তথা প্রকৃতিকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে সাহায্য করবে। যদিও বিজ্ঞানের আবিষ্কার কখনও এক জায়গায় থেমে থাকেনি তাই শুধুমাত্র এই ক’টি ছত্রাকই নয়, আরও অনেক এরকম ছত্রাকের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা নাকি প্লাস্টিক ভক্ষণ করতে পারে।
প্লাস্টিকখেকো পোকা

স্পেনের ক্যান্টাব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রেডেরিকা বার্টোসিনি ২০১৭ সালে মৌচাক থেকে পাওয়া গ্যালেরিয়া মেলোনেল্লা (Galleria mellonella) নামক একপ্রকার মোমখেকো পোকা বা ওয়াক্স ওর্মকে প্লাস্টিক ব্যাগে কিছু ঘণ্টার জন্য রেখে দিয়ে দেখেন তারা সেই ব্যাগে ফুটো তৈরি করেছে অর্থাৎ এরা পলিইথিলিন জাতীয় প্লাস্টিককে পাচনে সক্ষম। এই ভাবনাটিকে আরও দৃঢ় করতে পরবর্তীকালে তিনি তাঁর বাকি বিজ্ঞানী বন্ধুদের সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে এই ঘটনাটির পুনারাবৃত্তি করেন। তাঁরা ১০০টি এরকম পোকা নিয়ে তাদের প্লাস্টিক ব্যাগে রেখে দেন এবং দেখেন প্রতি ঘণ্টায় এরা প্রায় ২-৩টি ফুটো করছে এবং এক রাতের মধ্যে এরা প্রায় ৯২ মিলিগ্রাম প্লাস্টিক খেয়ে ফেলেছে।

আরও পড়ুন-ঘরেই বয়কট বিজেপি, না জানিয়ে কমিটি, দলেই বিক্ষোভ চরমে,অনুপস্থিত অনেকে

উক্ত এই সমস্ত গবেষণা, আবিষ্কার পৃথিবীকে প্লাস্টিক দূষণ থেকে রক্ষা করার জন্য হলেও আমরা এই দূষণ মুক্তির সমস্ত দায় এই জীবদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না। কারণ প্রত্যেক দিনে যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয় তা এই সমস্ত জীবের মিলিত কার্যের দ্বারাও দূরীভূত করা সম্ভব নয়। প্রত্যেক দিন প্রায় ৮০ লক্ষ প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে সমুদ্রে মেশে। যা জলজ বাস্তুতন্ত্রকে বিধ্বস্ত করার পাশাপাশি জলে বসবাসকারী প্রাণীদেরও ব্যাপকভাবে ক্ষতিসাধন করছে। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য সাফাইয়ের কাজ এই ক’টি জীবের মাধ্যমে করা অসম্ভব। তাই পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে, প্রকৃতিকে সুস্থ রাখতে আমাদের প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতেই হবে।

Latest article