‘ও মন, রমজানের ঐ রোজা শেষে এল খুশির ইদ’ (Eid ul-Fitr)।
কাজী নজরুলের লেখা ও সুর। কণ্ঠ আব্বাসউদ্দিন। বাংলা সংগীত জগতের এক অজানা দরজা খুলে দিলেন কাজী সাহেব ও আব্বাসউদ্দিন। উপলক্ষ— ইদ। মুসলমানদের অন্যতম প্রধান বাৎসরিক উৎসব। একমাস কঠোর সিয়ামব্রত পালনের পর আসে সওয়াল মাসের একখণ্ড সরু তারের মতো চাঁদ। শুরু হয়ে গেল উৎসব। এই চাঁদকেই বোধ হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘ইলেকট্রিকের তারে লটকে আছে চাঁদ।’ ইদের চাঁদ দেখা আমাদের ছোটবেলায় বড় উৎসব ছিল। উপবাস নিয়ে টুপি মাথায় দিয়ে সবাই মুখ তুলে উঁকি মারত আকাশে। ‘ঐ যে’ ‘ঐ যে’ রবে পাড়া মাতোয়ারা। একবার আমার এক ছোট ভাই ইদের চাঁদ প্রথম দেখেছিল। তারপর তাকে কাঁধে করে যুবকদের কী নাচ! কী নাচ! সারা পাড়া তাকে কাঁধে করে ঘোরানো হল। এখন সেই আমেজটা আর নেই। বিজ্ঞান যত এগিয়েছে চাঁদ দেখার সেই সন্ধ্যাবেলাটা তত ছোট হয়েছে।
ইদ (Eid ul-Fitr) মানে খুশির দিন। একা এই খুশি করা যায় না। সবার সঙ্গে ভাগ করে তা করতে হয়। সেই জন্য ‘ফিতরা’ বলে একটা জিনিস আছে। যা পরিবারের সবার মাথাপিছু হিসাব করে গরিব-দুঃখীদের দিতে হবে। যাতে সবার মুখে হাসি ফোটে। ১ দিনের শিশুর জন্যও ‘ফিতরা’ দিতে হয়। এই মহা আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ।
ইদের সকালটা খুব চমৎকার। স্নান। তারপর একটা আতর-মাখানো তুলোর গুলি কানে গোঁজা। পরিষ্কার সুন্দর কাপড় পরা। সামাই-এর পায়েস আর লুচি খেয়ে বড়দের সকলকে সালাম করে ইদগাহে রওনা। বিশাল বাজার বসে সেখানে। ইদ শেষে কোলাকুলি। তারপর বাজারে মিষ্টি কেনা। এখন কিছুটা রকমফের হয়েছে। কিন্তু কাঠামো একই আছে। আমি ছোটবেলায় দেখেছি এবং এখনও দেখি আমাদের পাশের হিন্দু পাড়ার বয়স্ক মানুষরা আসছেন ‘ইদমুবারক’ জানাতে। আমাদের মাস্টারমশাইরা তো আসতেনই। আমাদের বাড়িতে তাঁদের নিমন্ত্রণ। আমার মায়ের হাতের ভুনা খিচুড়ি ও মাংস প্রবাদ ছিল। তাই খেয়ে আমার মাস্টারমশাইরা নানা জায়গায় গল্প করতেন। মা নেই। ভুনা খিচুড়ির জায়গায় বিরিয়ানি এসেছে। পুরনো দিনের মা খালা ফুপুদের আদরটা ‘মিস’ করি।
আরও পড়ুন-জহরের ট্যুইট, বিশ্বভারতীর উপাচার্য আসলে নির্লজ্জ
একবার ইদের (Eid ul-Fitr) সময় প্রদীপ (ভট্টাচার্য) আমার স্কুলের বন্ধু (নবম শ্রেণি তখন) এল বাড়িতে। সকালে সে ঝোঁক ধরল সে-ও ইদ পড়তে যাবে। মহা হট্টগোল। মা তো বারবার নিষেধ করলেন। ‘না বাবা! এসব করতে নেই।’ কে কার কথা শোনে? শেষ পর্যন্ত আমি বললাম ‘চল। তবে আমি যা করব তাই করবি’। পাজামা। পাঞ্জাবি। টুপি পরে আমাদের সঙ্গে চলল। প্রদীপ মাথায় ছোট ও ফরসা, দারুণ দেখতে ছিল। গোটা ব্যাপারটা সে ভাল উতরে দিয়েছিল। বাড়িতে ফিরলাম। গ্রামসুদ্ধ লোক প্রদীপকে দেখতে আসছে। সে এক ভিআইপি। ১৯৭৫ সালের পর তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। মনে হয় কোনওদিন কোনও বিমানবন্দরে, অথবা রেল স্টেশনে পিছন থেকে ডাক দিয়ে বলবে ‘কী রে মইনুল? চিনতে পারিস’! ইদ এলেই প্রদীপের কথা বেশি করে মনে পড়ে। ইদের চাঁদ তো বছরে ২ বার আসে। প্রদীপ আসেনি।
ইদের সকালে আব্বা সাইকেলে ইদগাহে যেতেন। যাবার সময় আমাদের সাবাইকে ২ টাকা করে দিতেন। আমাদের ইচ্ছামতো কিছু কিনে যেন আমরা খেতে পারি। আমরা ছোট থাকতে থাকতে আব্বা ৫ টাকা পর্যন্ত উঠে ছিলেন। আমি তখন সাংসদ। সেবার আমার খালা আমাদের বাড়িতে। তাঁকে সালাম দিয়ে ইদগাহে যাব। যেতেই ৫ টাকা আমাকে দিলেন। আবাক হয়ে বললাম ‘এটা কেন দিচ্ছ’। বললেন ‘ইদের দিনে ছোটদের দিতে হয়। নে।’ আমি তখন রীতিমতো একটা ‘ছোট’র বাবা। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন কথায় কথায় বলতে শিখেছে ‘জামানা বদল গিয়া।’ সুতরাং সকালে উঠে ৫০০ টাকা তাদের হাতে দিতে হয়।
ইদ খুশির দিন। সব বাঙালির আজও হয়ে ওঠেনি। আমি একটা ছোট সূত্র বলি— মুসলমানরা একে অপরকে ইদ মুবারক বলে। একজন মুসলমান এক হিন্দুকে ইদ মুবারক বলে। এটা খুব স্বাভাবিক। একজন হিন্দু একজন মুসলমানকে ইদ মুবারক বলে— এটাও খুব স্বাভাবিক। কিন্তু দু’জন হিন্দু একে অপরকে ইদ মুবারক বলবে— তখন ইদ সকলের হয়ে উঠবে। আসুন সেই প্রক্রিয়া শুরু করি। ইদ সকলের হোক। সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিই।