সাল ১৯৮৯। কলকাতায় এসেছিলেন জার্মান চ্যান্সেলার বিসমার্কের নাতনির পুত্র আর্নল্ড কাইসারলিঙ। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক আর্নল্ডের পিতা কাউন্ট কাইসারলিঙ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের (Rabindra jayanti) বন্ধু। তিনিও ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত। আর্নল্ড গত শতকের ষাটের দশকে কলকাতায় দীর্ঘ দুবছর একাদিক্রমে ছিলেন। সেই সময়ে আমার পিতার সঙ্গে তাঁর সখ্য হয়, শরৎ বসু অ্যাকাডেমির সূত্রে। কলকাতায় এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিকের জীবনযাত্রা ছিল নেহাতই সাধারণ। ১৯৮৯-এ তিনি আবার আসেন। আমাদের বাড়িতেও এসেছিলেন। সম্পর্কে বিসমার্কের নাতির এই কলকাতা-প্রেম সম্পর্কে গর্বোদ্ধত শহর কিছুই খেয়াল রাখেনি।
সে যা-ই হোক! আমি তখন কলেজের ছাত্র। স্বভাবতই চপল এবং তর্কশীল। বাড়িতে তাঁকে পেয়ে জুড়ে দিয়েছিলাম নানা বিষয়ে। তুমুল তর্ক। শান্ত, ঋষিতুল্য প্রশান্তিতে তিনি ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শনের মিল, অমিলগুলো বুঝিয়েছিলেন। বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গান রোম্যান্টিক কিন্তু তাঁর দর্শন, যার শিকড় রয়েছে ভারতীয় দর্শনের অন্তরে, তা বিশ্বজনীন। ওই বয়সে আমি বুঝিনি সংগীতকে কীভাবে মূল দর্শনের থেকে আলাদা করা সম্ভব! বিশেষত রবীন্দ্রনাথের গানকে। প্রেম, পূজা, প্রকৃতির ভারসাম্যই আমাকে চিরকাল আকর্ষণ করেছে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের (Rabindra jayanti) গানের ভাস্কর্য যখন বাস্তবের রুক্ষ হৃদয়ের নিকটবর্তী হয় আমরা শব্দের অন্তরে, ছন্দের পারম্পর্যে বুঝতে চেষ্টা করি কীভাবে তা হয়তো স্পর্শ করতে চাইছে বিশ্বমানবকে। তাঁর জীবনদেবতা তো শুধু নিরাকার নন, তিনি বিশ্বজনীন। সব ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে তিনি বিরাজমান। তা যেমন দেশ ও কালকে অতিক্রম করে যায় তেমনি আমাদের মানবসত্তার আধারকেও স্থাপন করে বৃহত্তর কোনও এষণায়।
রবীন্দ্রনাথ (Rabindra jayanti) রোম্যান্টিক যখন তিনি শুধু ভালকেই অগ্রাধিকার দেন, মানুষের ক্ষুদ্রতাকে নিঃশেষ করতে বলেন। কিন্তু বিরোধাভাস তো জীবনের অঙ্গ। তা আসে, যায়। কিন্তু নিঃশেষ হয় না। কবি একইসঙ্গে নির্মলতাকে আহ্বান করেন, এটা হয়তো আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। তিনি চান, ‘কলুষ, কল্মষ, বিরোধ, বিদ্বেষ /হউক নির্মল, হউক নিঃশেষ’।
আরও পড়ুন: বাংলার দাবিতে উত্তাল হবে দিল্লি : অভিষেক
দর্শনশাস্ত্রের প্রধান বিবেচ্য হল মেটাফিজিক্স যা জীবনের প্রথম সূত্রগুলির সন্ধান করে। সেখানে দেশ, কাল অতিক্রম করে যেতে হয়। এই সন্ধানের অন্তর্নিহিত অবস্থান হল মানুষ ও প্রকৃতির বিচিত্র সহাবস্থানের তাৎপর্য। বহু ব্যক্তিগত শোকে বিক্ষত কবি কখনও নিজের অনুসন্ধান থেকে সরে আসেননি। তবে তিনি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লেখা কবি?
কবির এক প্রিয় ছাত্র একবার অত্যন্ত বিচলিত হয়ে তাঁকে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন ‘জীবনের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত এবং কী করলে হৃদয়ের শুষ্কতা দূর হয়?’ আরও হয়তো কিছু কথা সেই ছাত্র লিখেছিলেন যা তাঁর ব্যক্তিগত সমস্যার সঙ্গে জড়িত। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ (Rabindra jayanti) তাঁকে লেখেন, ‘আমরা যে কোনও কাজ এবং যে কোনও অবস্থার মধ্যেই থাকি না কেন নিজেকে যেন সত্য করে উপলব্ধি করতে পারি এই লক্ষ্যই মনে স্থির রাখতে হবে। ‘… যে আমি টাকাকড়ি খ্যাতি প্রতিপত্তির মধ্যে বদ্ধ সে আমি আজ আছে কাল নেই, সে আমি বাইরের জিনিষের দ্বারা ফেঁপে ওঠে এবং বাইরের জিনিষের অভাবে ছোট হয়ে যায়— কিন্তু আমার মধ্যে যে সত্য আছে বিশ্বজগতের সঙ্গে তার যোগ, অনন্ত আনন্দস্বরূপের সঙ্গে তার চিরদিনের অন্তরতম সম্বন্ধ— মৃত্যু তাকে বিনাশ করে না, ক্ষতি তাকে ক্ষুদ্র করে না, তার সম্পদ তার অন্তরের মধ্যে— নিজের সেই চির সত্যের প্রতি যদি দৃঢ় আস্থা রাখি তাহলে অন্তরে বাহিরে আর কোনো ভয় থাকে না’।
কথাগুলো শুনতে চমৎকার! কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ করব কীভাবে? কবি তারও পথ নির্দেশিকা দিয়ে দিয়েছেন সহজ ভাবে ওই পত্রের অন্তে। তিনি ছাত্রকে লিখছেন, ‘বড় বড় কথা শোনবার এবং বড় বড় কথা আবৃত্তি করবার লোভ যদি পেয়ে বসে তাহলে পথ হারাবে। জানতে চাও, বলতে চেয়ো না, পেতে চাও, লোকের কাছে ফলাতে চেয়ো না। মিতাচারী, মিতভাষী হয়ে নম্র হয়ে শ্রদ্ধাবান হয়ে অন্তর্যামীর প্রতি নির্ভর স্থির রেখে গোপনে আপনার সাধনার পথে অগ্রসর হতে থাক।’
কবি শুধু লিখে যাননি। কর্মমুখর তাঁর জীবন। ভারতীয় দর্শন তাঁকে যে বিশ্ববীক্ষা প্রদান করেছিল তা দেশের খাঁচায় সদা বদ্ধ নয়। পূর্ব পশ্চিমের মিলনতীর্থ হিসেবে তিনি নির্মাণ করেছিলেন তাঁর আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শান্তির দূত শুধু বাক্যব্যবহারে নয়, তা জড়িত আছে বিশ্বজগতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও পড়ুয়ার মেলবন্ধনে। তা প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক, উভয় ক্ষেত্রেই। তাঁর বিশ্বভারতীতে এসেছেন সবাই। জাতীয় নেতারা যেমন এসেছেন বারংবার, তেমনি এসেছেন বিশ্ববিশ্রুত নানা গুণিজন। বাধাহীন এক অনন্য মেলবন্ধনের ক্ষেত্র ছিল শান্তিনিকেতন। উপরোক্ত ছাত্রটি পরে শিক্ষক হয়েছিলেন। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন— ‘গুরুদেবের সান্নিধ্য লাভের ইচ্ছায় এবং শান্তিনিকেতনের শান্তিলাভের আশায় পৃথিবীর নানা দেশের কত কৃতী, কত গুণী, কত যে পণ্ডিত আশ্রমে এসেছেন, কত সাধকের নীরব সাধনা যে সেখানে পুঞ্জিভূত আছে, তারও ইতিহাস বিচিত্র এবং রক্ষণযোগ্য।
ফরাসি সাধক পল রিশারের কথা মনে পড়ে। (এঁরই সহধর্মিণী ছিলেন পণ্ডিচেরী আশ্রমের শ্রীমা) পল রিশার শ্রীঅরবিন্দের ভক্ত ছিলেন। … পল রিশারের সৌম্য, শান্ত, ঋষিতুল্য চেহারার কথা মনে আছে। স্বল্পভাষী, সন্ধ্যায় আমরা কেউ কেউ তাঁর কাছে গিয়ে বসতাম, তাঁর সান্নিধ্য খুব ভাল লাগত মনে আছে।
বেনোয়া সাহেবের কথা মনে পড়ে। ফরাসী ভাষা শিক্ষা দিতেন। আমি তাঁকে বাংলা শেখাতাম, তিনি আমাকে ফরাসী ভাষা শিক্ষা দিতেন। বিশীও বেনোয়াকে কিছুদিন বাংলা শিক্ষা দিয়েছিল। (আশ্রমস্মৃতি, ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়)।’
শিক্ষা হল আনন্দের ভোজ। তা শান্তিনিকেতনে কবি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। আজ কি তা হারিয়ে যাচ্ছে? ক্ষুদ্রতার সাধনা দেখলে অবাক হই না আর। শুধু ভাবি ওই মাটিতেই কবি গড়ে তুলেছিলেন পূর্ব পশ্চিমের মিলনক্ষেত্র। তিনি ধ্বনির প্রতিধ্বনি শুনতে চাননি। তাকে বিহঙ্গের মতো বিস্তৃতি দিয়েছিলেন। ‘স্বর তরঙ্গিয়া গাও বিহঙ্গম/ পূর্ব, পশ্চিম বন্ধু সঙ্গম’।
এই বাংলা বহু কিছুর সাক্ষী। কিন্তু তার শ্রেষ্ঠ সম্পদটি লুকিয়ে আছে বৃহৎ অন্তরে। যা পরাধীন দেশে সম্ভব হয়েছিল, স্বাধীন দেশে তা অ-সম্ভব কেন? আমরা তো গড়ে তুলতে পারি সেই ক্ষেত্র যেখানে সবাই পারস্পরিক আদান প্রদানের জন্য মিলিত হবেন। ‘জ্ঞান যেথা মুক্ত’ তেমন কল্পনা কি একেবারেই রোম্যান্টিক?