একদলীয় হিন্দুত্ববাদী অধিপত্যের অভিযান চলছে দেশ জুড়ে। পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে তাতে অচিরেই পূর্ণমাত্রায় ফ্যাসিস্ত (fascism) শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে আর বেশি দেরি নেই। ক্রমশই সেই সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে। ভারতের গণতন্ত্র আজ অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত, ভারতকে ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র’ বা গণতন্ত্রের জননী বলে যতই বড়াই করা হোক না কেন, প্রকৃত সত্য হল— গণতন্ত্রের আসল সাফল্য তার প্রয়োগে। ভারতের বর্তমান বাস্তবতায় গণতন্ত্রের ঠাটবাট বজায় থাকলেও তা ক্রমাগত বিপদগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সে চলেছে একদলীয় অধিপত্য প্রতিষ্ঠার দিকে। কেন্দ্রের বর্তমান শাসকরা সেই লক্ষ্যে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ২০১৪ থেকে আধিপত্যের যা অনুশীলন শুরু হয়েছে ২০১৯-শে তা প্রতিষ্ঠানিক রূপ গ্রহণ করেছে। গত নয় বছরে মোদি-শাসনে গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণা ও চরিত্রটাই বদলে ফেলার সচেতন শাসকীয় প্রয়াস চলছে।
আধুনিক বিজ্ঞান চেতনা এবং যুক্তিবাদ গণতন্ত্রের যে অবয়ব ও বিন্যাস গড়ে তুলেছে তাতে বহু দলীয় সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভাষা-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকেরই সমান অধিকার দিয়েছে। ভারতের সংবিধান ভারতীয় গণতন্ত্রের যে কাঠামো তৈরি করেছে তাতে প্রতিটি ভারতবাসীর জন্য এই অধিকারগুলি মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই অধিকারগুলি সুরক্ষিত না থাকলে গণতন্ত্র অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকারের দায়বদ্ধতা হল, সাংবিধান প্রদত্ত গণতন্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও প্রসারিত করা এবং গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে আরও জীবন্ত ও আরও অর্থবহ করে তোলা। আমরা লক্ষ্য করছি মোদি জমানায় এই দায়বদ্ধতাই সরকারের আচরণ ও কর্মপ্রণালী থেকে ক্রমশই হারিয়ে হাচ্ছে। তার বদলে শাসকরা একদলীয় ও মন্ত্রিসভার বদলে এক ব্যক্তির শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছে। যেখানে ইলেক্টোরাল ডেমোক্র্যাসি পর্যন্ত পরিণত হচ্ছে স্বৈরতন্ত্রী নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, নির্বাচনী কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা কমিশন, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিশন— সবই শাসক দলের ইশারায় চলতে বাধ্য হচ্ছে। বিচার ব্যবস্থা পর্যন্ত এখন প্রশ্নের মুখে। এই একদলীয় শাসনতন্ত্র সর্বগ্রাসী। তাই তাকে সর্বাধিপত্যবাদী শাসনও বলা যায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জবরদস্তি।
আরএসএস-বিজেপি যেহেতু বিজ্ঞান চেতনা ও যুক্তিবাদে বিশ্বাস করে না, তাই তারা বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গবেষণা ও তার বিশ্লেষণ পদ্ধতিকে অস্বীকার করে। ধর্মান্ধতায় বিশ্বাসী এই শক্তি আশ্রয় করে কল্পনাশ্রয়ী নানা পৌরাণিক কাহিনিতে। বহুমাত্রিকতা ও বহুত্ববাদের বিপরীতে তারা এক ধর্ম, এক ভাষা, এক চিন্তা, এক ভাষ্য ও এক মতের শৃঙ্খলে দেশ ও মানুষকে বেঁধে ফেলতে চায়। এই এককেন্দ্রিকতা তাদের আদর্শগত ভিত্তির উৎস। একদলীয় গণতন্ত্র (স্বৈরতন্ত্র) ও একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য। তাই প্রতিপদে সংবিধানকে লঙ্ঘন করে তারা দলীয় হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত (Fascism) আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। দেশ, রাষ্ট্র, সরকারের সর্বত্র শাসকের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অন্যমত বা ভিন্নতা, স্বাধীন ভাবে মতপ্রকাশ ও নিরপেক্ষতা বলে কোনও কিছুই তারা সহ্য করে না। একতান্ত্রিকতা ও অসহিষ্ণুতাই তাদের পথ চলার দিশা। তাই গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলিকে তারা দলীয় মতাদর্শ অনুসারে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বদ্ধপরিকর। দেশের প্রতিটি সাংবিধানিক ভাবে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সংস্থাকে তারা কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে চায়। অর্থাৎ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, ভিজিলেন্স কমিশন, সিএজি, সিবিআই, ইডি, লোকায়ুক্ত থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশন, এমনকী বিচার ব্যবস্থাকেও দলীয় নিয়ন্ত্রণে আবদ্ধ করতে চায়। স্বাধীন নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যকেও ভয় দেখিয়ে, কিনে নিয়ে বশংবদ করে ফেলার পথে শাসকরা অনেকটাই সফল। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ তাই আজ ক্রীড়নকে পরিণত। সাহসী সাংবাদিকদের ধরে ধরে জেলে পোরা হচ্ছে। গণতন্ত্রের এই অবনমন দেশের লজ্জা।
আরও পড়ুন- বিলকিসের ধর্ষকদের মুক্তি, কেন্দ্র ও গুজরাত সরকারকে সুপ্রিম কোর্টের নোটিশ
বিরোধী দলগুলির নেতাদের পিছনে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইডি, সিবিআই। এদের ৯৫ ভাগ মামলাই বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে। পার্লামেন্টে বিরোধী দলগুলির মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা আগে দেখা যায়নি যে, পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত করে দেওয়া হচ্ছে শাসকপক্ষের স্লোগান ও চেঁচামেচিতে। সম্প্রতি সংসদের এক বিরোধী নেতার সাংসদপদ যেভাবে কেড়ে নেওয়া হল তা অভূতপূর্ব। এক শাসককে দেবতা বানাতে বিরোধীদের দানব বানানো হচ্ছে। এই একরোখা প্রবণতা অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। যে কোনও ব্যক্তিই তিনি যে পদেই থাকুন সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন।
মনে রাখা দরকার, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনায় যদি শান্তিপূর্ণ অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসক নির্বাচিত না হয় তাহলে সেই শাসকের হাতে কখনও গণতন্ত্র নিরাপদ থাকতে পারে না। জনতার রায়ের প্রতিফলন ঘটে তখন, যখন স্বাধীন, সৎ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে। তাই শাসকের পছন্দের লোক নিয়ে কমিশন গঠনের ব্যবস্থা তুলে দিয়ে নিরপেক্ষ ও সৎ কমিশন গঠন করতে হবে। দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির দীর্ঘদিনের এই দাবির পক্ষে সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে। এটা শুভ লক্ষণ। আইনের চোখে সবাই সমান— এই নীতিকে বরবাদ করে দেওয়া হচ্ছে।
শাসকের সমস্ত অপচেষ্টাকে রুখে দিয়ে গণতন্ত্র রক্ষাই এখন প্রথম ও প্রধান কতর্ব্যরূপে উপস্থিত হয়েছে। গণতন্ত্র-প্রিয় মানুষকে সেই কর্তব্য পালনে লড়াইয়ের ময়দানে শামিল করা আজ বিরোধী শক্তির মূল কর্তব্য। সেই লড়াইয়ের মহাপ্লাবনে উৎখাত করতে হবে একদলীয় আধিপত্যের অভিযানকে।