গাছমানব

'গাছমানব' একটি বিরল রোগ। তার চিকিৎসা নিয়ে সারা বিশ্বের চিকিৎসাজগৎ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্ব জুড়ে অনেক কম হলেও, এক বিরল ভাইরাসের শিকার 'গাছমানব'। এই বিষয়ে আলোকপাত করলেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

না, রূপকথার গল্পে থাকা কোনও অবাস্তব চরিত্রের তথা বলছি না। বাস্তবে এটি হল এক ধরনের জিনগত রোগ, যার ফলে মানুষের ত্বক ঠিক গাছের বাকলের মতো হয়ে যায়। এই রোগের সন্ধান সর্বপ্রথম পাওয়া যায় ১৯২২ সালে এবং এখনও অবধি এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২০০টির মতো। এই রোগটি (Treeman) যেমন বিরল তেমনই এর চিকিৎসা পদ্ধতিও বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রায় ২ বছরের দীর্ঘ চিকিৎসা তথা বারংবার শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে এক ৪৪ বছর বয়সি ভদ্রলোক মাহমান্দ তালুলি এই রোগ থেকে মুক্তি পান। এমনকী বাংলাদেশেও এমন আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় ২৮ বছর বয়সি আবুল বাজনদারের ক্ষেত্রে। সাধারণত ২৫টি শল্যচিকিৎসার পর তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসেন। ২০০৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার এক কারিগর ডেডের শরীরেও এই রোগের (Treeman) সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে কী এই রোগ আর কেনই-বা এর চিকিৎসা পদ্ধতি এতটা জটিল এবার আসা যাক সেই প্রসঙ্গে।

এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরুসিফরমিস

গাছমানব বা ট্রিম্যান ডিজিজকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরুসিফরমিস নামেই ডাকা হয়। দেহকোষীয় জিনের মিউটেশনজনিত ত্রুটির কারণে রোগী হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসকে প্রতিহত করার ক্ষমতা হারায়। ফলে রোগীর ত্বক শুকনো, খসখসে, অসংখ্য গুটিযুক্ত ও ফাটা-ফাটা হয়ে থাকে। যাকে দেখতে অনেকটা গাছের বাকলের মতো লাগে। জিনগত তথ্যের আরও একটু গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে ১৭ নম্বর ক্রোমোজোমে দু-ধরনের জিন থাকে, যথা- EVER1 অথবা EVER2। এই জিনগুলি সাধারণত কোষের নিউক্লিয়াসে জিঙ্ক আয়নের বিন্যাস নিয়ন্ত্রণ করে। এই জিঙ্ক আয়ন হল ভাইরাল প্রোটিনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এটি তাদের সামগ্রিক বৃদ্ধির জন্য দায়ী। সক্রিয় EVER1 ও EVER2 জিন সাধারণত ভাইরাসের প্রোটিনকে জিঙ্ক আয়ন অবধি পৌঁছতে দেয় না ফলে স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ মানুষই হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সমস্ত প্রজাতিকেই প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু কোনওভাবে এই দুটি জিনের মিউটেশন ঘটলে উক্ত ভাইরাসের বাড়-বাড়ন্ত দেহের ক্ষতিসাধন করতে সমর্থ হয়। তারই ভয়াবহ ফল হল এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরুসিফরমিস। এই রোগে কিছুটা হলেও মানুষের অনাক্রম্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে প্রায় সমস্ত প্রকারের হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস দ্বারা রোগীর আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে। বলা বাহুল্য এটিই হল এই রোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ের কারণ। যদিও মনে করা হয় ২০ বছর বয়স থেকেই নাকি এই রোগটি রোগীর শরীরে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশু বয়স থেকেই এই রোগের প্রকাশ ঘটতে থাকে এবং মধ্যবয়সে এই রোগটি সম্পূর্ণরূপে দেখা দেয়। GARD বা Genetic and Rare Diseases Information Center থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৬১.৫ শতাংশ মানুষ যাদের ক্ষেত্রে এই রোগটি দেখা গিয়েছে তাদের শিশু বয়স থেকেই এই রোগের লক্ষণ আত্মপ্রকাশ করা শুরু করে দিয়েছে, ২২ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে এটি দেখা গিয়েছে তাদের বয়ঃসন্ধিকালে আর ৭.৫ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশু বয়সেই এই রোগটি তার উপস্থিতি জানান দিতে লেগেছে।

রোগীর পরিস্থিতি

এই রোগ সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করার প্রথমেই বলেছিলাম যে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর দেহের ত্বক ঠিক গাছের বাকলের মতো হয়ে যায়। তবে এই রোগের একেবারে গোড়ার দিকে পরিস্থিতি এতটাও জটিল থাকে না। কারণ আমরা সকলেই জানি যে এই প্যাপিলোমা ভাইরাস মূলত দেহ ত্বকের বিভিন্ন জায়গায় গুটি সৃষ্টির জন্য দায়ী। তাই এই ভাইরাস তার নিজ ধর্ম অনুযায়ী প্রথমে দেহের বিভিন্ন স্থানে ত্বকের ওপরে লাল বা হালকা গোলাপি বা বাদামি বর্ণের ছোট ছোট গুটির সৃষ্টি করে। যা ধীরে ধীরে আঁশের মতো আকার নিতে থাকে, যার ওপরের দিকটি চ্যাপটা আর কিছু কিছু সময় সেখানে লাল লাল ফোল ফোলা অংশ দেখা যায়। তবে এই রোগের একেবারে শেষ পর্যায়ে ত্বক শক্ত হয়ে সম্পূর্ণরূপে বাদামি বর্ণ ধারণ করে ও শুকনো খসখসে হয়ে যায়, ঠিক গাছের বাকলের মতো। সাধারণত অসংখ্য গুটি একত্রিত হয়েই কিন্তু এই মারাত্মক শক্ত স্তরীভূত গঠনের জন্ম হয়। চ্যাপটা স্তরের মতো গঠন দেহের সেই সমস্ত জায়গাতেই বেশি দেখা যায়, যে সমস্ত জায়গা সবচেয়ে বেশিক্ষণ সূর্যালোক পায়। যেমন হাত, পায়ের পাতা, মুখ, কান ইত্যাদি। আবার দেহের অনেক স্থানে প্লাক বা ফলকের মতো গঠনও দেখা যায়। সাধারণত যে সমস্ত অংশ সূর্যালোকে খুব বেশিক্ষণ থাকে না, যেমন-ঘাড়, হাতের বা পায়ের তালু ইত্যাদি স্থানে এইরকম প্লাকের মতো গঠন দেখা যায়। এই সময় রোগী সারা দেহে ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। শুধু তাইই নয়, এই রোগের সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে রোগীর দেহে ক্যানসার হওয়ারও খুব বেশিমাত্রায় সম্ভাবনা থাকে। তাই এই রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও ত্বকের ক্যানসারের সমস্যায় ভোগেন।

প্রতিকার ও প্রতিরোধ

যদিও জিনগত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার পন্থা যে অত সহজ নয় বরং এটি একটি দীর্ঘকালীল প্রক্রিয়া তার উদাহরণ আমরা আগেও পেয়েছি। তবে এই রোগের লক্ষণ দেখার সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিষয়ে নজর দিলে বা সেটা অনুসরণ করতে পারলে এই রোগের ভয়ঙ্কর প্রকোপ থেকে কিছুটা হলেও মূক্তি পাওয়া যাবে। প্রথমেই আসা যাক রেটিনয়েড প্রয়োগে। এটি ত্বকের ওপর প্রয়োগ করলে বা ওষুধ হিসেবে গ্রহণ করলে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় সম্ভাবনা অনেকটা কমে যায়। এ ছাড়াও ইন্টারফেরন আলফা, ত্বকীয় কোষের আস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে প্রতিহত করে এবং কোলেক্যালসিফেরল যা কিনা ভিটামিন D এর একটি সক্রিয় রূপ, সেটি ত্বকীয় কোষের সুরক্ষা প্রদান ও মেরামতিতে সাহায্য করে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সূর্যালোক থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা উচিত। এমনকী তাদের ধূমপানও করা উচিত নয়। এসব মেনে চললে এই রোগের ভয়াবহতাকে কিছুটা হলেও এড়ানো সম্ভব হয়। এবার আসা যাক এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতিতে। সাধারণত ক্রায়োথেরাপি (অতিরিক্ত ঠান্ডা পরিবেশে রোগীর ত্বকীয় কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে প্রতিহত করা আর সেই সঙ্গে দেহে সৃষ্ট অস্বাভাবিক কোষগুলিকে সরিয়ে ফেলা), লেসার সার্জারি(লেজার রশ্মি প্রয়োগের দ্বারা) বা ইলেক্ট্রোসার্জারির (ইলেক্ট্রিকাল কারেন্ট প্রয়োগের দ্বারা) মাধ্যমে রোগীকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয় ঠিকই এমনকী রোগী সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনেও ফিরে আসে কিন্তু সেটি হতে সময় লাগে প্রচুর। অনেকের ক্ষত্রে ২৫ বার বা তার বেশিও শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। তবে এটি খুবই হতাশাজনক যে এত কিছুর পরেও প্রায় ৩০-৬০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় রোগী নন-মেলানোমা স্কিন ক্যানসারের শিকার। তাই এটি স্বীকার করতে কোথাও কোনও দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে এই রোগের সম্পূর্ণ প্রতিকার এখনও আমাদের নাগালের বাইরে।

Latest article