২০১১ সাল। বিধানসভার নির্বাচন। বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএম-বিরুদ্ধ জনাদেশে মহাকরণ থেকে সমূলে উপড়ে গেল। সরকার গড়ল তৃণমূল কংগ্রেস (Trinamool Congress Government)। মুখ্যমন্ত্রী হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুলেট নয়, ব্যালটের মাধ্যমে এতবড় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ভারতের অন্য কোনও রাজ্যে আর হয়েছে কি? উত্তর হল, না। এই বিপ্লবের নেপথ্য কারিগর আর কেউ নন, মমতা। আমজনতাকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৮৪ সাল থেকে একভাবে লেগে থেকে ‘অগ্নিকন্যা’ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ছিলেন।
তারপর ১১ বছর কেটেছে। আজ রাজ্যবাসী খোলা চোখে দেখতে পাচ্ছে, পরিবর্তনের জেরে পশ্চিমবঙ্গে সার্বিক চেহারাটাই কীরকম পালটে গিয়েছে। সমাজকল্যাণমূলক কাজ এবং উন্নয়ন তো বটেই, পরিবর্তন হয়েছে রাজনীতিরও। জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য—সিপিএমের ৩৪ বছরে রাজ্যটার কী হাল হয়েছিল সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বাংলার মানুষ। তাদের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল, বিভীষিকার বাম অপশাসনে। মানুষকে সেই বিভীষিকার দিন যাপন থেকে মুক্তির আলো দেখিয়েছেন মমতাই।
১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত রাজ্য রাজনীতির মূল ধারা হয়ে উঠেছিল কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট। তখন তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়নি। জনসঙ্ঘের নামও কেউ জানত না। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত রাজ্য রাজনীতির মূল ধারা হিসাবে দাঁড়িয়েছিল সিপিএমের বামফ্রন্ট। কংগ্রেস চলে গিয়েছিল দ্বিতীয় স্থানে।
আরও পড়ুন: জলের দরে এলআইসির শেয়ার বিক্রি, মোদি সরকারের সিদ্ধান্তে ক্ষতি ৫৪ হাজার কোটি টাকা!
২০১১ সালে কী অদ্ভুত পরিবর্তন। রাজ্য রাজনীতির লাগাম চলে গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। কংগ্রেস, সিপিএম তথা বামফ্রন্ট অস্তাচলে যেতে বেশি সময় লাগল না। ২০০৬ সালে বিধানসভা ভােটের পর দম্ভের সঙ্গে বুদ্ধদেববাবু বলেছিলেন, ‘আমরা ২৩৫, আর ওরা (তৃণমূল কংগ্রেস) শুধুমাত্র ৩০!’ মাত্র ৫ বছরের মধ্যে তৃণমূুল কংগ্রেস (Trinamool Congress Government) এবং মমতাকে এই তাচ্ছিল্যের জবাব দিয়েছিলেন জনগণ। ২০১১ সালের ভােটে খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছিল লালপার্টি।
কেউ যদি মনে করেন, হঠাৎই মমতা সব দখল করে নিয়েছিলেন তা হলে, মস্তবড় ভুল হবে। গোটা রাজ্যটাই হার্মাদদের সন্ত্রাসে বোবা হয়ে গিয়েছিল। ভোটে সন্ত্রাস-রিগিং ছিল রুটিন। এ রাজ্যে যে নারকীয়, নৃশংস সন্ত্রাস বছরের পর বছর ধরে সিপিএমকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছিল তা এই প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়েই জানে না। কংগ্রেসের নেতা-নেত্রীরা সেই সময় কাগুজে বাঘ হিসাবেই দিন অতিবাহিত করেছেন। আর রীতিমতো বাঘিনির মতো ঝড়ের গতিতে মমতা রাজ্য চষে বেড়িয়েছেন। নিজের জীবন বাজি রেখে তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই করেছিলেন।
শুধু এই লড়াই নয়, বাম আমলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়ে মমতা প্রমাণ করেছিলেন, দুটি জিনিস। এক, রাস্তায় নেমে গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে যেমন তিনি পারদর্শী। ঠিক তেমনি দুই, রাজ্যের উন্নয়নেও তিনি আন্তরিক। রেলমন্ত্রী হয়ে মমতা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, উন্নয়ন কাকে বলে। কেবল নতুন নতুন ট্রেন চালু নয়, একের পর এক রেলপ্রকল্প এনে বঙ্গবাসীর মনে নিজের কর্মদক্ষতার একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেছিলেন। আর রাজ্যপাটে আসীন সেই সময়ের বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমের সরকার পদে পদে রেল প্রকল্পের কাজে বাধা দিয়েছে। ১৯৯১ সালে কেন্দ্রে প্রথম মন্ত্রী হয়ে মমতা সৌজন্যের ফুল আর উপহার দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে রাইটার্সে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, আসুন রাজনীতি দূরে সরিয়ে রেখে রাজ্যের উন্নয়নে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করি। কিন্তু জ্যোতিবাবুরা যতটা প্রতিহিংসাপরায়ণের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, সেটা টের পেতে বেশি সময় লাগেনি। কিছুদিনের মধ্যে নদিয়ার শান্তিপুরের এক নির্যাতিতা মেয়েকে নিয়ে মমতা মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। দেখা করা দূরের কথা, একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে মাঝরাতে পুলিশ দিয়ে চ্যাংদোলা করে রাইটার্স থেকে বের করে দিতে সিপিএমের সরকারের সেদিন রুচিতে বাধেনি।
কিন্তু ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে মমতা কোনও বদলার রাজনীতির পথে হাঁটেননি। অথচ রাজ্যের পরিস্থিতি তখন ছিল অগ্নিগর্ভ। জেলায় জেলায় ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে দেননি স্বয়ং মমতা। প্রথমেই তৃণমূল কংগ্রেসের (Trinamool Congress Government) বিজয়মিছিল বন্ধ করে দেন। রাইটার্সে ঢুকেই প্রশাসনকে জানিয়ে দেন, রাজনৈতিক রেষারেষি, সংঘর্ষ বরখাস্ত করা যাবে না। দলের রঙ না দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে শুধু অশান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা নয়, রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের কাজে ডুবে যান মমতা। সবুজসাথী থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসাথী-সহ একশোরও বেশি সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প মুখ্যমন্ত্রীরই মস্তিষ্কপ্রসূত। জন্ম থেকে মৃত্যু, দলমত নির্বিশেষে রাজ্যবাসী এইসব প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন। বাংলার লক্ষ্মীরভাণ্ডার চালু হতেই বিভিন্ন রাজ্য সরকার প্রকল্প কী করে শুরু করা যায়, সেই ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। মমতার সমাজকল্যাণমূলক একাধিক প্রকল্প শুধুমাত্র ভিন রাজ্যের সরকারগুলি অনুসরণ করেছে তাই নয়, প্রকল্পের স্বীকৃতি মিলেছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও।
১১ বছর ধরে এইভাবে জনগণের মধ্যে নিজেকে মেলে দিয়ে মমতা তাঁর সরকার এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ভিত মজবুত করেছেন। এদের পর এক ভোটে তার প্রমাণ মিলছে। বাংলা এখন মমতাময়ী। সিপিএম এবং কংগ্রেসের বিদায়ের পর মাথা তুলেছিল বিজেপি। কিন্তু হায়রে! মমতার উন্নয়নের জোয়ারে তারাও হারিয়ে যেতে বসেছে। মমতার রাজনীতি নিয়ে বিরোধীরা দু’চার কথা বলতেই পারে। কিন্তু উন্নয়নের কাজ এবং সমাজকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলি নিয়ে কী বলবে? বিরোধীদের মনের ভেতরে হিংসার জ্বালা আছে। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলে বিরোধীদের যেটুকু অস্তিত্ব আছে মানুষের অভিশাপে সেটাও বিপন্ন হবে। মমতার আমলে যে বাংলাটাই আমূল পালটে দিয়েছে।