রাঢ়বঙ্গে যে সত্যিটা বেআব্রু হয়ে গেল

ভারতের গণতন্ত্র ধ্বংসকারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

সোজা কথাটা প্রথমেই সাফ সাফ বলে নেওয়া যাক। রাজনীতির অনুশীলনে হিংস্রতা ইদানীং প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান। সৌজন্যে বিজেপি। এই অপকর্ষের শিকড় রয়েছে ওই দলের রাজনীতিকদের মনের গভীরেই। সেই সত্যিটা এবার ফাঁস হয়ে গেল। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বৃহত্তম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একযোগে কিছু ভয়াবহ বাক্য উচ্চারণ করে বিষটিকে, থুড়ি বিষয়টিকে, পোক্ত করলেন।

আরও পড়ুন-নিজ্জর খুনে কানাডায় গ্রেফতার ৩ ভারতীয়

ভোটের মরশুমে এঁরা সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে আকথার পিঠে কুকথা মিলিয়ে দেওয়ার একটি নোংরাতম পন্থা আবিষ্কার করেছেন। কয়েকদিন আগে কেন্দ্রীয় শাসক দলের দুই মহারথী পশ্চিমবঙ্গে পদার্পণ করেছিলেন—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। মেমারিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্তা, ‘তিরিশটা আসন জিতিয়ে দিন, যারা পয়সা খেয়ে নিয়েছে, উল্টো করে ঝুলিয়ে সোজা করবে বিজেপি।’ বীরভূমের সিউড়িতে যোগীর ঘোষণা, ‘রামনবমীর শোভাযাত্রায় সংঘর্ষ ও ভাঙচুর করার সাহস যদি কেউ উত্তরপ্রদেশে দেখাত, তা হলে তাকে উল্টো করে টাঙিয়ে তার পুরো সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হত।’ দুই জেলা, দুই মঞ্চ, দুই বক্তা, দুই উপলক্ষ, কিন্তু বিধান এক এবং অদ্বিতীয়। উল্টো করে ঝুলিয়ে কিংবা টাঙিয়ে দেওয়া। একই ভাষায় উচ্চারিত প্রায় অভিন্ন হুমকি। ক্ষমতার রাজনীতি, ক্ষমতা দখলের রাজনীতি এঁদের চিন্তা ও চেতনাকে এমন ভাবেই গ্রাস করে ফেলেছে যে স্বাভাবিক ভদ্রতা বা বাক্‌সংযমের বিন্দুমাত্র বাসনা তাঁদের নেই। প্রশ্নটা নিছক বাক্‌সংযমের নয়, মনের কথা ভদ্রতার খাতিরে মনে রেখে দেওয়ার ব্যাপার নয়। প্রশ্ন জাগে, কেমন সেই মন, যেখানে প্রতিপক্ষকে সতর্ক করার বা ভয় দেখানোর লক্ষ্যে এমন হিংসার চাষ করা যায় অক্লেশে! এই কাজটাই এঁরা করেছিলেন গুজরাতে, দাঙ্গা বেধেছিল তাতে।
১০ বছর দেশ শাসনের পর বোঝা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদি স্বৈরতান্ত্রিক মতবাদের পাশাপাশি যুক্ত করেছেন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদের মিথ্যে অহং, যা বিষিয়ে দিয়েছে মানুষের বিবেচনা ও হৃদয়। গোটা দেশের গণতন্ত্র-সংক্রান্ত ভাবনাই তাতে বদলে গিয়েছে।

আরও পড়ুন-সিবিএসই-আইসিএসই-র ফলাফল প্রকাশ শীঘ্রই

দারিদ্র, অনাহার, দেশভাগ, দাঙ্গা, নির্যাতন, বৈষম্য সত্ত্বেও ১৯৬৯ সালে চারটি সাধারণ নির্বাচন অতিক্রমনের পর ইংরেজ সাংবাদিক জন টেলর ভারতের গণতন্ত্রের বিষয়ে লিখেছিলেন, ‘…এই প্রকাণ্ড দেশটিতে আছে ৫২.৪ কোটি লোক, প্রধান পনেরোটি ভাষা চালু আছে। ধর্মে ধর্মে রয়েছে সংঘাত, রয়েছে নানা জাতবর্ণ। এমন একটি দেশকে মনের মধ্যে ধারণ করাই তো দুঃসাধ্য, অথচ ভারতের মধ্যে কোথায় যেন আছে একটা নমনীয়তা, যা টিকে থাকার একটা নিশ্চয়তা রূপে কাজ করে।’ এই নমনীয়তা আমাদের গণতন্ত্রকে লালন করেছে, শত হিংসা ও অসাম্যের মাঝেও বপন করেছে এক সম্পূর্ণতার বীজ। অথচ দেশের মাটি থেকে সেই বীজ উপড়ে ফেলে সেখানে আজ বিদ্বেষ ও বর্বরতার বীজ বপন করছে বিজেপি। এরা গুলিয়ে দিয়েছে মানুষের বিবেচনা, বিষিয়ে দিয়েছে তাদের হৃদয়।
বিজেপির নেতা-নেত্রীদের দ্বিচারিতা এবং যেনতেনপ্রকারেণ ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার লোভের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ অবশ্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি। গোটা বিশ্ব যে কারণে আমাদের সম্মান করে, সেই সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়েছে তাঁর আমলে। প্রথম দফার নির্বাচনের পর ‘চারশো পার’ হওয়ার স্বপ্নে সামান্য আঁচড় পড়তেই উনি এবং ওঁর দল ফিরে গেছেন দেশের সংখ্যালঘু মানুষদের বেলাগাম আক্রমণ করার নিকৃষ্ট রাজনীতিতে।

আরও পড়ুন-বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি নিয়ে জল্পনা খারিজ রাজ্য সরকারের

সাধারণ মানুষ, যাঁরা নিজেদের প্রতি দিনের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছেন নরেন্দ্র মোদির এবং ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী সঙ্কল্পপত্র ভাঁওতা ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ তাঁদের একাংশ ভেসে চলেছেন এক গোয়েবলসীয় প্রচারের স্রোতে। অন্ধ ভক্তের দল শিকার হচ্ছেন ভাঁওতাবাজির।
একটা কথোপকথনের কথা তুলে ধরা যাক। এটি যোগেন্দ্র যাদবের লেখা থেকে নেওয়া।
‘কেমন চলছে?’ ‘খুব খারাপ।’
‘রোজগারপাতি?’
‘কিছু হচ্ছে না, বাবু।’
‘ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, চাকরি?’
‘কোথায় কী? কিচ্ছু নেই। রোজকার জিনিসের দাম যা, কী করে সংসার চলবে বুঝতে পারছি না।’
‘আপনার গ্রামের হাল?’
‘একই রকম, বাবু, সবার হাল খারাপ।’
‘দেশের খবর রাখেন?’
(এইবার মানুষটির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল) ‘দেশ এগিয়ে চলছে, বাবু। খুব উন্নতি হচ্ছে। সবাই তো তা-ই বলছে।’

আরও পড়ুন-সবটা সাজিয়েছে শুভেন্দুদা

এইজন্যই মোদি যখন রামনবমীতে আমিষ খাওয়াকে ‘মোগল মানসিকতা’ বলে আক্রমণ করেন, তখন অন্যদিকে পুষ্টির অভাবে ধুঁকতে থাকা শিশুদের সংখ্যাটি ভয়াবহ, কিন্তু টিভি চ্যানেল সেটা নিয়ে টক শো-র আসর বসায় না। দেশের ছ’টি প্রধান চ্যানেলের ৪২৯টি অনুষ্ঠানের মধ্যে ২২৪টি অনুষ্ঠান হয় দেশের বিরোধী দলগুলিকে আক্রমণ করে, ১১৬টি অনুষ্ঠানে হয় মোদি-বন্দনা, ২৪টি হয় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে উসকানিমূলক প্রচার, ছ’টি কেন্দ্রীয় সরকার-বিরোধী এবং মাত্র একটি বা দু’টি কর্মসংস্থান বা বেকারত্ব নিয়ে।
২০১৪ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত যে পঁচিশ জন নেতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থা তদন্ত শুরু করেছিল, সেই সবাইকে বিজেপি আপন করে নিয়েছে। তাঁরা শুধু বিজেপিতে যোগদানই করেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে চলা সমস্ত তদন্ত প্রত্যাহারও করা হয়েছে। এরকম একটা দলে নাম লিখিয়েছেন রাতারাতি ‘ঈশ্বর’ হয়ে ওঠা এক প্রাক্তন বিচারপতি, যিনি চুরির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় চোর বিজেপিতে যোগদান করেছেন।
সবশেষে একটা কথা। গান্ধী না গডসে, বেছে নিতে যাঁকে বা যাঁদের ভাবতে হয়, এবং উত্তর না পেয়েও যাঁকে বা যাঁদেরকে বলতে হয়, ‘পরে বলব’,তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শ শুধু ভুল তা-ই নয়, ভয়ঙ্কর।
এই ভীতিকর রাজনীতির বিরুদ্ধে জমতে থাকা ক্ষোভের আগুনেও যদি আমরা জল ঢেলে দিই, তবে আমরাই অবধারিতভাবে পাপ-পঙ্কে নিমজ্জিত হব।

Latest article